Published : 05 Oct 2019, 10:00 PM
প্রকৃতিতে সত্যিকারের সুন্দর, সুশৃঙ্খল ও মনোহর মানুষ মানে শিক্ষক। এরা তাদের দর্শনেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে নীতিনৈতিকতা তৈরি ও পোষণ করেন। আর আদর্শ চিন্তার মাধ্যমে সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্রকে স্বাস্থ্যপ্রদ করে তোলেন। নন্দনতত্ত্ব চর্চার ফলে সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্রের সৌন্দর্য বৃদ্ধির বিষয়ে মনোনিবেশ করে থাকেন এরা। সাধারণ মানুষের মনকে শান্ত, সঠিক চিন্তার অনুকূলে নিয়ে আসেন শিক্ষক সমাজ। যদিও এদের ব্যক্তি জীবন রয়েছে। তবু ব্যক্তির উর্ধ্বে মৌলিক প্রয়োজনগুলো বিসর্জন দিয়ে দিতে তারা কখনো কার্পণ্য করেন না। মূলত 'মানবীয়' শব্দটির প্রতিশব্দ হিসেবেই শিক্ষক সমাজের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। জ্ঞান বিতরণ যাদের প্রথম ও পরম কর্ম। এর বিনিময়েই তারা জীবিকা নির্বাহ করেন। প্রাচীন গ্রিসে সোফিস্টরা সর্বপ্রথম জ্ঞান বিতরণের বিনিময়ে টাকা গ্রহণ করে থাকতো। কিন্তু অতিরিক্ত টাকা উপার্জন করতে হবে, এমনটি কখনো মনে করেননি তারা।
কিন্তু কালের বিবর্তনে বিশাল পাকস্থলির অধিকারী হয়েছেন একশ্রেণীর শিক্ষকরা। বিশেষত আমাদের রাষ্ট্রের প্রেক্ষিতে ভালো শিক্ষক হওয়ার চেয়ে ভোগবিলাসের দিকেই অনেকের নজর। আর এক্ষেত্রে কার্পণ্য নয়, যেভাবেই হোক ভোগবিলাসে জীবনকে উপভোগ্য করে তুলবে হবে। বিশেষত আমাদের বঙ্গরাষ্ট্রে আজ এমন অবস্থায় এ পরিস্থিতি চলে গিয়েছে যে, একটা বড় অংশের শিক্ষক বাড়ি, গাড়ি, টাকাকড়ি, ব্যাংক ব্যালান্সে পিছিয়ে থাকতে চান না।
পৃথিবীর যেকোনো সভ্য রাষ্ট্রের শিক্ষকরা রাষ্ট্র ও সমাজ কীভাবে চলবে তার বিষয়ে একটি বড় ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, উপাচার্যরা এই নীতি-নীতিনির্ধারণীর নেতৃত্ব দেন। কিন্তু আমার মনে হয় না যে, স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশে এসব অধ্যাপক, উপাচার্যরা এমন কোনো ব্যাপারে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন! অথচ স্বাধীনতার পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা যথেষ্ঠ বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করতেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা? পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ, উৎপীড়ণ থেকে মুক্তি বাংলার আপামর জনগোষ্ঠির মুক্তি নিয়ে তাদের কাজ ও অ্যাক্টিভিজম ছিল চোখে পড়ার মতো। সমাজকে আলোকিত করতে তাদের প্রচেষ্টা ছিল ঐকান্তিক।
কিন্তু আজকালের বিবর্তনে বাংলাদেশের শিক্ষকরা যেন নির্দিষ্ট কোন না কোন দলের দলদাস বা গোলাম হয়ে গেছে। তারা দলীয়ভাবে একটা করে 'গোলাম পরিষদ' খুলে গোলামি করে যাচ্ছে নির্দ্বিধায়। ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের জন্য শিক্ষকদের অনেকেই গোলাম পরিষদে সক্রিয় থাকেন তেলবাজী ও দুর্নীতির মধ্য দিয়ে। আর এই পরিষদের নির্বাহীরা পরবর্তীতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, প্রক্টর বা হর্তাকর্তা বনে যান। সুযোগমত বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ-বাণিজ্য করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত প্রক্রিয়া দরপত্র প্রক্রিয়ার সাথে স্বার্থান্বেষী ক্রিয়ায় জড়িত হন। তথা কমিশন খেয়ে নেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ড লুটপাট করে থাকেন। ইতিমধ্যে রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের এসব দুর্নীতির অভিযোগ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে এসেছে। যা রীতিমতো আতঙ্কিত করে তোরার মতো। সবশেষ খবরে এসেছে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের লিফট কেনার জন্য উপাচার্য ও তার দলের বিদেশ সফর সংক্রান্ত দুর্নীতির চিত্র। এমনকি এই শিক্ষক, অধ্যাপকরা অবৈধভাবে যৌনসম্পর্ক পর্যন্ত করে থাকেন ছাত্রী ও সহশিক্ষকদের সঙ্গে। ভুয়ো ডক্টরেট ডিগ্রি নেয়ার নজিরও রয়েছে। অনৈতিক পদায়নসহ সমস্ত অবৈধ প্রক্রিয়ায় জড়িত হন। এরকম আরো নানা অপকর্মের চরিত্র চিত্রায়ণ করা যায় বটে। তবে শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে তাদের মস্তিষ্ক ঠিক করা যাবে কি? যদিও জাতির মগজ হলো এ-ই শিক্ষক সমাজ। কিন্তু আজ এই মগজে যখন স্বয়ং পচন ধরেছে। তখন পচা মগজের কথা বলে লাভ নেই। বীজ হৃষ্টপুষ্ট হলে নাকি ফল ভালো হয়। কিন্তু আজ শিক্ষা সম্পর্কিত সমস্ত বিভাগের দুর্নীতির চিত্র সাধারণ জনগণকে নাড়া দেয়!
আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, অধ্যাপকরা সেখানকার সমাজ ও রাষ্ট্রীয় নীতি নৈতিকতা এবং আদর্শ বাস্তবায়নের কৌশলগুলোর চিন্তা করেন। রাজনীতিবিদরাও প্রশাসন তো সেসব নীতি বাস্তবায়ন করেন মাত্র। আর সেখানে এই বঙ্গরাষ্ট্রের শিক্ষক, অধ্যাপকরা স্বার্থান্ধ হয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের তোয়াজ, তোষামোদ ও খয়েরখাঁ মার্কা আচরণ করেন। সুতরাং দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়বে না আদর্শিক প্রণোদনা সুনির্দিষ্ট হবে রাষ্ট্রে! হয়েছেও তাই। দুর্নীতি আজ কৃষ্টি সংস্কৃতিতে বিরাজমান হয়ে গেছে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে দুর্নীতি। সরকার কোথায় হাত দিবে! কথায় আছে না, 'সর্বাঙ্গে ব্যথা ওষুধ দিব কোথায়।'
আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই কতিপয় শিক্ষক, অধ্যাপক আর উপাচার্যরা আজ সমাজ, জাতি সর্বোপরি রাষ্ট্রকে নিজেদের অযোগ্যতার কারণে দুর্নীতির আঁতুড়ঘরে পরিণত করেছেন। আর এ কারণেই শিক্ষক দিবসে 'শিক্ষক'দের অন্তর থেকে সাধুবাদ জানানোটা কঠিন হয়ে পড়েছে।