Published : 28 Jun 2012, 10:42 PM
এটিএন-এর মালিক মাহফুজুর রহমানকে কোনও প্রাণীর সঙ্গে তুলনা করতে চাই না। তবে মানব সমাজে পরিচিত স্বল্পবুদ্ধির যে কোনও প্রাণীর সঙ্গে তুলনা চলতে পারে। একের পর এক বেবুদ্ধি কাজ করে যেতে পারে সচরাচর এমন মানুষ দেখা যায় না। এমনকি বাংলাদেশেও না, যেখানে আয়োডিন ঘাটতিজনিত কারণে জাতিগতভাবে আমরা সবাই একটু 'বোকা বোকা' বলে পরিচিত, সেখানেও তিনি 'মহাবোকা' উপাধি পাবার যোগ্যতা প্রায় অর্জন করতে যাচ্ছেন। অন্য কেউ কি এই সমাজে নেই যারা গার্মেন্টসের টাকা দিয়ে গণমাধ্যমের কেউকেটা হয়েছেন? কিন্তু তেমন ক'জন আছেন যারা নিয়মিতভাবে এমন সব কথা বলছেন যাতে সবাই তার 'ঘাড় ও গর্দানের মধ্যেকার সম্পর্ক' ছিন্ন করতে চায় যথাশীঘ্র সম্ভব?
তবে একটা প্রতিভা নিশ্চয় আছে তার। আর সেটা হলো সবাইকে খেপিয়ে তোলা। মাহফুজ এমন কিছু কি বলেছেন যেটা অন্যরা বলেননি ? বলেছেন যে, পরকীয়া প্রেমের কারণে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। বলেছেন যে, তার কাছে এইসবের ভিডিও প্রমাণ আছে। বলেছেন যে, এই দম্পতির বাসায় মদের আসর বসত, ইত্যাদি ইত্যাদি। মাফ করবেন সবাই কিন্তু বাংলাদেশের একাধিক পত্রিকায় এই কথা অনেকবার বলা হয়েছে। রুনি সাগরকে ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে চান, এটি ইত্তেফাক পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার সংবাদ ছিল। আর যদি সংবাদিকদের জিজ্ঞাসা করেন তবে কেউ এই বিষয়ে আলাপই করবে না যেহেতু এইসব তথ্য সবার জানা। যেহেতু এ বিষয়ে কোনও অনুসন্ধানী রির্পোট বার হয়নি, তাই সবাই গুজব-নির্ভর কথা বলছেন। যেটা পার্থক্য সেটা হচ্ছে সবার গুজব বা অনুমান প্রায় একই রকম। জিজ্ঞাসা করলে সবাই বলেন যে, তথ্যসূত্রের মধ্যে পুলিশও আছে।
অতএব আমরা সবাই যেটা জানি বলে মনে করি সেটাই মাহফুজুর রহমান বলেছে। কিন্তু এই লোকের স্থান-কাল-পাত্রজ্ঞান এত কম যে সে শুধু এই সব বলেইনি, তার ভিডিও ধারণ করেছে। যদি এই কাজটি তার অজান্তে হয়ে থাকে তবে কি তাকে সেই নামে ডাকব যেটা অনেকে ডাকছে 'গবেট?'
একজন মানুষ যে এত বড় একটা মিডিয়া সাম্রাজ্যের মালিক, সে কী করে এই রকম কিশোরসুলভ কাজকর্ম করতে পারে সেটা বোঝা গেল না।
মাহফুজ শিশুসুলভ আচরণ করবে সেটা তার ব্যাপার কিন্তু শিশুদের গণমাধ্যম পরিচালনা করার বিধান নেই। ওটা প্রাপ্তবয়স্কদের বিষয় এবং সেই কারণেই সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। এই একই কারণে তার নির্বাসনে যাওয়া উচিত।
এই 'দম্পতি হত্যাকাণ্ড' আমাদের সমাজের গাঢ় পর্দায় ঢাকা অবয়ব কিছুটা ফাঁক করছে। তার ফলে যে আলোটা পড়েছে, যা জেনেছি, তাতেই আমরা অনেকে ভড়কে গেছি। ভাবছি আমাদের এই সব জীবনযাপনের চিত্র প্রকাশ পেলে আর ইজ্জত থাকবে না। যেন গণমাধ্যম কর্মীদের মধ্যে, বিশেষ করে যাদের আমরা 'তারকা' বলি, তাদের ব্যক্তিগত জীবনের কথা প্রকাশিত হলে আমাদের মান-ইজ্জত হারাতে হবে। অর্থাৎ লুকিয়ে-ছাপিয়ে রাখি আমাদের ব্যক্তিগত জীবন। আর সবার সামনে নিজেদেরকে সমাজের শিষ্ট সদস্য হিসেবে তুলে ধরে দিন যাপন করি। সেই কারণে অনেকেই চান যে, যা জানা গেছে তা গুজব হিসেবেই থাকুক। প্রকৃত তথ্য সরকারিভাবে প্রকাশিত হলে গোটা গণমাধ্যমের নৈতিক অবস্থা নিয়ে যে সদম্ভ উচ্চারণ করা হয় সেটা আর করা যাবে না। অর্থাৎ আমাদের যে 'সবার সেরা আমরা' মনোভাব সেটায় চিড় ধরতে পারে।
আমার মতে, এই দুর্ভাবনার কোনও ভিত্তি নেই। সমাজের কোন অংশ এই 'আকাম-কুকাম' মুক্ত সেটা কি বলতে পারবে কেউ? এই দেশে এখন যে পরিবর্তন চলছে তার ঢেউয়ে অনেকে গা ভাসিয়েছে। সমাজের সকল স্তরেই এইসব রয়েছে। আজকের বাংলাদেশে মানুষের হাতে ক্ষমতা, অর্থ ও সুযোগ সবই রয়েছে। যেটার অভাব সেটা হলো, স্ব স্ব কাজে যোগ্যতার অভাব কিন্তু এটা বাংলাদেশে আর কোনও সমস্যা নয়। বুদ্ধির বদলে যখন আবেগ স্থান করে নেয়, কার্যক্রমের বদলে যোগাযোগ, সেই সমাজে আর যাই হোক, যোগ্যতা লাগে না। যে গ্রাম্য সমাজে আধুনিক ভাবনার বদলে কেবল জীবনধারা (lifestyle) প্রতিষ্ঠিত হয়, সেই সমাজের এটাই স্বাভাবিক চিত্র।
এক অর্থে এই গ্রাম্য 'বউপেটানো' মানসিকতা থেকেই সবই রুনির ব্যাপারে এত কিছু বলছে কিন্তু সাগরের ব্যাপারে সব দোষ মাপ করে দিয়েছে যেন। গণমাধ্যমের যারা কর্মী বিশেষ করে তাদের বন্ধু-বান্ধব অনেকেই বলছেন এই কথাটা প্রথম থেকেই। কিন্তু মাহফুজ মিয়ার কথা থেকে সবাই ধরে নিয়েছে যে এটা একজনের ক্রিয়াকর্মের ফল। তার কথা অনেকের এই ধারণাটাকেই সবল করেছে। এটা আমাদের সমাজের নারী-বিরোধী ভাবনাকে প্রশ্রয় দিয়েছে যেটা বিশ্বাস করে যে নারী-পুরুষ একই কাজ করলেও পুরুষের দোষ কম হয়।
কিন্তু বিষয়টা এই নিহত দম্পতিকে নিয়ে নয়, এটা মাহফুজ মিয়াকে নিয়ে যিনি জান দিয়ে প্রমাণ করতে চাইছেন যে তার মানসিক পরিপক্কতার ভীষণ অভাব। তার শিক্ষার ব্যাপারেও প্রশ্ন উঠেছে। কেউ কেউ বলেছেন যে উনি ১৯৭৫-৭৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। এতে অনেকেই আবার আপত্তি করেছেন। তাদের বক্তব্য হলো, ওই প্রজন্মের কেউ বুকের কাছে বেল্ট বেঁধে প্যান্ট পরে না যেমনটা তিনি করেন। তার প্যান্ট তিনি মাথায় বাঁধবেন না পায়ে বাঁধবেন সেটা তার বিষয়। যেটা তিনি একজন মিডিয়া হাউসের মালিক হিসেবে করতে পারেন না সেটা হলো প্রধানমন্ত্রীকে 'বাচাল' বলা। হতে পারে তিনি 'বাচাল' কিন্তু এটা কে বলতে পারে আর কে পারে না তারও একটা অবস্থানগত তালিকা আছে। মাহফুজ মিয়া তার মধ্যে পড়ে না। এটা যে তিনি চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছেন তা নয়। এটা তার কাণ্ডজ্ঞানহীনতার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে সবার সামনে উপস্থিত করেছেন।
তার এই কাণ্ডজ্ঞানের অভাবের সবচেয়ে সবল প্রমাণ তার গান গাওয়া। এ রকম বেসুরো গলায়, তাল-জ্ঞান ছাড়া কেউ গান গেয়েছে তার প্রমাণ বাঙালির ইতিহাসে কমই আছে। প্রথমে তার বেসুরো স্ত্রী ইভা রহমানকে দিয়ে যত্রতত্র গান গাইয়ে, সিডি বার করে প্রচুর অত্যাচার করেছে সে। যেহেতু সে নিজেই চ্যানেলটির মালিক তাই সেই সব নিয়মিত প্রচার করা হয়েছে ওই চ্যানেলে।
আচ্ছা, না হয় ধরা গেল নতুন বিয়ে করা স্ত্রীকে খুশি করতে এই সব অপকর্ম করা, অত্যাচার করা কিন্তু মাহফুজ নিজে গান গেয়ে যা করেছে সেটা গণ-নির্যাতন। তার এটা করার কোনও অধিকার নেই। সবার মনে রাখতে হবে আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারীকে পছন্দ করেন না। অনেক বদদোয়ার 'ফল' এটা।
কিন্তু এতসব কি হত যদি এই কেসের সুরাহা হয়ে যেত? প্রায় প্রতিটি মানুষ মনে করে যে তদন্তে প্রকৃত তথ্য বের হয়েছে কিন্তু সেটা জানানো হচ্ছে না। না হওয়ার ফলে বাকি সব সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এখন যত দিকে কলের পানি গড়াক আর যত মাহফুজের ওপর এই সব অভিযোগ আসুক এটা শুরু হয়েছে মামলাকে ধামাচাপা দেবার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। যদি এই ঘটনার মধ্যে বিবিধ রাজনৈতিক ও গোষ্ঠী-স্বার্থ প্রবেশ না করত তবে এই সব জটিলতা কিছুই হত না। যে বা যারা দোষী সে বা তারা যেই হোক ধরা পড়ত, বিচার হত; তাহলে যতসব উদ্ভট গুজবের দিন শেষ হত।
এই সবকিছুর মূলে হচ্ছে ব্যাঘাতপ্রাপ্ত অনুসন্ধান প্রক্রিয়া ও গোপন করার প্রচেষ্টা। দুর্ভাগ্যবশত এখন এতটাই দিন গড়িয়েছে যে সত্য উদঘাটনও অনিশ্চিত হয়ে গেছে। যারা সরকারকে এই জোড়া খুনের মামলাকে জাতীয় বিষয় বানাতে সাহায্য করেছেন তাদের মনে রাখতে হবে যে সবচেয়ে বেশি খুশি হচ্ছে বিএনপি। কারণ আগামী নির্বাচনে এটি একটি বিষয় হয়ে উঠবে। সেটার জন্য যারা বিষয়টিকে চাপা দিয়েছেন বা দিচ্ছেন, দায়ী তারাই।