Published : 05 Jun 2012, 08:03 PM
চুরি করে প্রায় সবাই। বিভিন্নভাবে করে, বিভিন্ন কারণে করে। প্রয়োজনে করে, অপ্রয়োজনেও করে। অভাবে করে, স্বভাবেও করে। তবে চুরি করে কেউ ধরা খায়, কেউ খায় না। যে খায় না সে নির্বিকার ভদ্রবেশে ঘুরে বেড়ায়। যে ধরা খায় সে-ও পারতপক্ষে একগাল হেসে ব্যাপারটা এড়াতে চায়। যে এড়াতে পারে সে যখন-তখন ভদ্র বেশে জনারণ্যে মিশে যায়। তখন তাক চোর বললে তার আঁতে ঘা লাগে। তাই চোরকে সরাসরি চোর বলতে নেই।
আর বিবেচ্য এটিও যে, চুরি মানে তো শুধু ধনচুরি নয়। চুরি মানে হতে পারে মনচুরি, মানচুরি, জানচুরি, জ্ঞানচুরি, বিদ্যাচুরি, জাতচুরি, পাতচুরি, ডিগ্রিচুরি, বইচুরি, মইচুরি, ভোটচুরি, জোটচুরি, তথ্য চুরি, পথ্য চুরি, কৌশল চুরি, পদ্ধতি চুরি, – আরো কতো-চুরি ভুরি ভুরি। সনাতন কাল থেকে চুরি কাজটা মূলত নিশিরাইতেই চলে। তাই চোরের আরেক নাম নিশিকুটুম্ব । এ-কারণে চুরিরও কাব্যগন্ধী পরিভাষা 'নিশিকুটুম্বিতা'।
নিশি মানে শুধু রাত নয়; নিশি মানে নিকষ কালো অন্ধকার; অর্থাৎ আলোর অভাব। নিশিরাইতে কুটুম্ব সেজে অন্যের ঘরে ঢুকতে গেলে আলো নিভিয়ে ঢোকার কৌশল আয়ত্ত করতে হয় নিশিকুটুম্বকে। আর যারা রাতে অন্য গৃহস্থের ধনচুরি না করে দিবালোকে বা অন্য প্রহরে বিদ্যাচুরি, তথ্য চুরি, ভোটচুরি বা অনুরূপ অন্য কোনো ভদ্র চুরিতে হাত পাকায়, চুরির মুহূর্তে তারাও আপন মনের নৈতিকতার আলোটা নিভিয়ে রেখে অনৈতিকতার অন্ধকারে পা বাড়ায়। মনের সেই অজ্ঞান অন্ধকারে তারা ঠিকই সবার অলক্ষ্যে তাদের লক্ষ্যবস্তু কুড়ায়। সমাজ, রীতিনীতি, আইনআদালত, লোকভয়, লোকলজ্জা ইত্যাদি তাদের জন্য বিবেচ্য ঠেকে না। বিবেচ্য ঠেকে কেবল নিজের স্বার্থ, নিজের অর্থবিত্ত। 'স্বার্থ' কথাটির ইশারাও কিন্তু তাই। স্ব + অর্থ, অর্থাৎ আপন অর্থ। অর্থ এখানে শুধু টাকাকড়ি নয়, মানুষের মূর্ত বা বিমূর্ত সকল সম্পদ বা অনুরূপ বস্তু বা অবস্তু।
তবে নিজে কেউ মানতে রাজি নয় যে সে নিশিকুটুম্ব। 'চোর' বললে তো সঙ্গে সঙ্গে গায়ে জ্বালা ধরে যায়। তখন যে তাকে চোর বলেছে ছলে-বলে-কৌশলে তার গোষ্ঠি উদ্ধার করাটাও একটা প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায়। এভাবেই চোর হিসেবে চিহ্নিত ব্যক্তি অন্যকেও চোর আখ্যায় প্রত্যাঘাত করে। উপরন্তু যে তাকে চোর বলেছে তাকে সে কেবল চোর বলেই ক্ষান্ত হয় না, বরং তার জীবনের নানান অনুষঙ্গে নিশিকুটুম্বিতার গন্ধ শুঁকে বেড়ায়। শুরু হয় চরিত্র হনন।
তারো চেয়ে বড় কথা, যাকে চোর বলা হলো সে যদি সমাজে প্রতিপত্তিশালী হয়ে থাকে, তাহলে সে বিত্তবল, বাহুবল ও ক্ষমতার বলে প্রতিপক্ষের মুণ্ডু চিবিয়ে খেতে চায়। চরিত্রহননের পাশাপাশি শুরু হয় দ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ, গুম, খুনসহ অমানবিক সামাজিক অস্থিরতা। এই অস্থিরতাই সমাজকে চরম নীতিবিবর্জিত ও দুর্নীতিপরায়ণ করে তোলে। সমাজের সব মূল্যবোধ ক্রমে ক্রমে অকার্যকর হয়ে পড়ে। এমন একটি মূল্যবোধবিবর্জিত দুর্নীতিপরায়ণ সমাজের চিহ্ন ক্রমেই সুষ্পষ্ট হচ্ছে বাংলাদেশের চলমান সমাজে। প্রত্যক্ষে হোক পরোক্ষে হোক এই সমাজের পরতে পরতে দুর্নীতি ও হননবৃত্তি অনুপ্রবেশ করছে বিরতিহীন। সেই দুর্নীতি ও হননবৃত্তি মানুষকে চরম অমানবিক করে তুলেছে। ভোগের পর প্রেমিকাকে খণ্ডবিখণ্ড করছে সন্ত্রস্ত প্রেমিক। এই অবস্থার পরিবর্তনের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু কিভাবে আসবে সেই পরিবর্তন? না, আমাদের কাছে সহজ বা বৈপ্লবিক কোনো উত্তর নেই তারও।
শুরুতেই বলেছি, চুরি প্রায় সবাই করে। 'প্রায়' বলে এটিই বোঝাতে চেয়েছি যে, এর ভিতরেও হঠাৎ কিছু ব্যতিক্রম আছে। উপরন্তু চুরির যেমন প্রকারভেদ আছে, তেমনি আকারভেদও আছে। আকৃতি ও প্রকৃতি ভেদে সব চুরিই শাস্তিযোগ্য, তবে সমান শাস্তিযোগ্য নয়। তেষ্টায় যে কলসির জল চুরি করেছে, তার অপরাধ অবশ্যই 'পুকুরচুরি'র সমতুল্য নয়। 'পুকুরচুরি' প্রয়োজনীয় বা চাহিদাজাত চুরি নয়, বরং অপ্রয়োজনীয় সামাজিক ও সামষ্টিক অপরাধ। মুষ্ঠিমেয় কিছু লোক আছে সব সমাজে, সেই সুবাদে আমাদের সমাজেও, যারা অন্তত পুকুরচুরিতে সিদ্ধহস্ত বা প্রলুব্ধ নয়। 'চুরি-টুরি' নিয়ে কথা বলার সাধ হয় তাদেরও। কখনো কখনো আমাদের মতো কথক বা কথাবাজদেরও। যিনি বড় কথক তিনি আরো মজার কথা বলতে পারঙ্গম, আর যত্রতত্র তেমন কথা বলেনও তিনি বা তারা। আমাদের সাম্প্রতিক সমাজে তেমন একজন বিদগ্ধ কথক অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। বিগত ষাটের দশক থেকে এ-পর্যন্ত দীর্ঘ অর্ধ শতাব্দী ধরে সভাসমিতি, ক্লাশ, রেডিও-টিভি থেকে শুরু করে পথে-প্রান্তরেও তিনি আমাদের সমাজে একজন প্রিয় কথক হিসেবে স্বীকৃত। সারাজীবন কথার পর কথা বলছেন, আলোকিত মানুষ তৈরির আন্দোলন করছেন; কিন্তু অর্থবিত্তের সন্ধানে জীবনপাত করেননি; বরং 'বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্র' নামক একটি জ্ঞানকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান গড়েছেন নিজের সর্বস্ব বিকিয়ে দিয়ে। আজ তার শাখা-প্রশাখা বাংলাদেশের বাইরেও প্রসারিত। তার অবদান দেশে-বিদেশে স্বীকৃত। আমরা তাঁকে নিয়ে গর্বিত, কেননা তিনি আমাদের, অর্থাৎ ষাটের দশকের লেখককবিদের প্রিয় সায়ীদভাই।
সেই সায়ীদভাই সম্প্রতি স্বভাবজাতভাবে আমাদের সমাজে 'চুরি' নিয়ে কটাক্ষ করেছেন একটি গণআলাপে। আর এক অসতর্ক প্রতিবেদক তার বক্তব্যের ভিন্নরূপ ভাষ্য ছেপেছেন, যা আমাদের তিনজন মাননীয় সংসদ সদস্যের উষ্মার কারণ হয়েছে। আগ-পাছ যাচাই না করে তারা তাকে তুলোধূনো করেছেন আর সংসদে এসে প্রকাশ্য ক্ষমা চাওয়ার কথা বলেছেন। মাননীয় স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের অবর্তমানে সংসদে সভাপতিত্বকারী একজন মাননীয় সংসদ সদস্যও এই দাবীর সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে পরের দিন সায়ীদভাই কৈফিয়তের সুরে বলেছেন, তিনি সংসদ, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী প্রমুখ মান্যবরদের মানহানিকর কোনো কথা বলেননি। তার বক্তব্যকে বিশ্লেষণ করে আমাদেরও মনে হয়েছে তিনি ব্যঙ্গচ্ছলে নীতি ও দুর্নীতি কাকে বলে কিংবা এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য কী–এটা বোঝাতে চেয়েছেন। আজীবন যুক্তিপরায়ণ ও পরিহাসপ্রবণ আলোকিত কথক অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। তার যুক্তি, তর্ক ও র্যঙ্গরস বুঝতে হলে সংশ্লিষ্ট বোদ্ধাকেও সহনশীল, শ্রদ্ধাশীল ও বোধের ক্ষেত্রে স্ব-প্রশিক্ষিত হতে হবে।
কিন্তু এ-ক্ষেত্রে তার অন্যথা ঘটেছে বলে মনে হয়। অবশ্যই প্রথম ভুলটি করেছেন সংশ্লিষ্ট সংবাদপত্রের প্রতিবেদক। দ্বিতীয়টি মাননীয় সংসদ সদস্যবৃন্দ, যাঁরা তুলনামূলক যাচাই বাছাই ছাড়া এমন একটি নাজুক প্রসঙ্গকে সংসদে তুলে এনেছেন। অথচ ভুল করেননি সংসদের মাননীয় ডেপুটি স্পিকার, যিনি তার বিবৃতিতে এই ধরনের ঘটনাকে বাঞ্ছিত মনে করেননি। উপরন্তু তিনি অধ্যাপক সায়ীদকে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি হিসেবে সম্মান জানিয়েছেন এবং প্রয়োজনে প্রেস কাউন্সিল বা আইনের আশ্রয় নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। আমরা তার বক্তব্যে আশান্বিত। কেননা তিনি গড্ডলে ভেসে যাননি । তিনি সতর্ক চোখে আপন বিবেককে জাগ্রত রেখে বিষয়টা পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি অবশ্যই আমাদের সমাজের মুষ্ঠিমেয় 'প্রায়'দের দলে। স্বদীক্ষিত, স্বপ্রশিক্ষিত, আলোকিত ও মানুষের ইতিবাচকতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল তিনি। এ-ধরনের অঙ্গুলিমেয় মানুষ কথায় ও কাজে একটি সমাজকে বদলে দিতে পারেন। আমরা বিস্মৃত হইনি যে, মূলত সৃষ্টিশীল সংখ্যালঘুই একটি সমাজে ইতিবাচক পটপরিবর্তন ঘটায়। আমরা কি আমাদের সমাজের এই সৃষ্টিশীল, আলোকিত ও নীতিবান সংখ্যালঘুর দলটাকে জনে জনে বড় করে তুলতে পারি না?
০৫.০৬.২০১২
মুহম্মদ নূরুল হুদা : কবি ও লেখক।