Published : 22 Mar 2018, 06:13 PM
গত জানুয়ারিতে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে চলছিল বন্যা, জলাবদ্ধতা ও ভূমিধস বিষয়ক বিশেষ সম্মেলন। একেক কক্ষে একেক উপস্থাপনা। উল্লেখযোগ্য ছিল প্রতিটি কক্ষের নদীর নামে পরিচিতি। কোনটার নাম পদ্মা। কোনটা ব্রহ্মপুত্র। আগ্রহিরা এভাবে পরস্পরের কাছে কক্ষগুলো খুঁজে নিচ্ছিল নদীর নাম ধরে।
নদী সচেতনতা গড়তে আজকাল অনেক কর্মসূচির নাম নদীর নামে হয়। আবাসন প্রকল্প অথবা জনকল্যাণকর প্রকল্পের নাম, সেমিনার কক্ষের নামও হচ্ছে নদীর নামে। এ চর্চা আশা জাগায়। আবার এ চর্চা শঙ্কা জাগায়। আগামিতে নদী না কেবল নামফলকেই রয়ে যায়!
বিশ্ব নদী দিবসে নদী বাঁচাও কার্যক্রমের শ্বেতপত্র খোলা হয় বিশ্ব জুড়ে। প্রতি বছর সেপ্টেম্বরের চতুর্থ রোববার বৈশ্বিক নদীগতিপথের অধিকার নিয়ে পরিবেশবাদিরা সম্মিলিত আওয়াজ তোলেন। যুক্ত করেন নদীবর্তী জনপদকে, নদীকেন্দ্রিক জাতিকে। বিশ্বের ৬০টিরও বেশি দেশে পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব নদী দিবস। বিশ্ব নদী দিবসের পাশাপাশি পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস।
বিশ্ব নদী দিবস যতটা ঘটা করে পালিত হয়, মার্চের আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস ততটাই অজানায় চলে যায় আমাদের দেশে। অবশ্য ২০১৮ সালের ১৪ মার্চ পালিত আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস তুলনামূলক ব্যতিক্রম। এবার গণমাধ্যমে গতবারেও চেয়ে সামান্য বেশি কাভারেজ পেয়েছে দিবসটি। কোনো চ্যানেলে সরাসরি দিবসের প্রসঙ্গ না এলেও উঠে এসেছে ধূ ধূ তিস্তার প্রতিবেদন। এসবের বাইরে এবার নদী রক্ষায় কাজ করা বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবক ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন কর্মসূচি ছিল উল্লেখযোগ্য। এসব কর্মসূচির প্রচারণায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছিল ছবি-ভিডিও এবং হ্যাশট্যাগের স্রোত। ছিল তরুণ প্রজন্মের ঢেউ। সবটাই নদীর জন্য।
ইন্টারন্যাশনাল রিভারস এর ওয়েবসাইটে আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস পালনকারী দেশের মানচিত্রে বাংলাদেশ বেশ স্পষ্ট। বাংলাদেশের বিভিন্ন কর্মসূচিগুলোও গুরুত্বের সাথে উপস্থাপিত হয়েছে তাদের ফেইসবুক প্রচারণায়। নদী নিয়ে তরুণ প্রজন্মের এবারের আয়োজন ছিল চোখে পড়ার মতই।
দেশের দশটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পরিবেশবান্ধব বাহন সাইকেলে চড়ে বেরিয়েছিল নদী অভিমুখে। উদ্দেশ্য জনপদে নদীর কথা ছড়িয়ে দেয়া। আমাদের তরুণদের 'সাইক্লিং ফর রিভার' কর্মসূচি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হয়ে দেশ ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে বিশ্বের অসংখ্য নদী আর মানুষের কাছে। নদীর কথা যত জোরালোভাবে উচ্চারণ হবে মানুষের কণ্ঠে, নদীরগতিপথ বাধাহীন হবে ততই।
খুলনার নদীবর্তী নারীরা বুঝেছিল, জনবসতির অস্তিত্ব রক্ষায় নদীই তাদের অধিকার। পানি অধিকার এবং উন্মুক্ত জলাশয়ের জন্য নারীদের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসা অসংখ্য কাগুজে প্রকল্প আর পেশিশক্তিকে প্রত্যাহবান করেছিল বারবার। তারপর ওইসব এলাকায় নদী ও নারী সমার্থক হয়ে ওঠে। জল ও জীবন গতিপথ পায়।
যে আইলা দুর্যোগ নামিয়েছিল, সেই আইলাই আবার জাগিয়েছিল সম্ভাবনার সূত্র। আইলার আগে লবণাক্ত কামারগোদা খাল ছিল সরু। গ্রামবাসীরা বলছে এখন খালটির দৈর্ঘ্য ৬০ কিমি, প্রস্থ বেড়ে হয়েছে ৩০০ ফুট, গভীরতা ২৫ ফুটের মত।
আইলার পরে তিন বছর বাধহীন খালের কারণে ভাসমান আর গৃহহীন জীবনযুদ্ধে বিবমিষার জীবন কাটিয়েছিল গ্রামবাসীরা। বাধ নির্মাণের পর কৃষি ও পান উপযোগী স্বাদু পানির সরবরাহে ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হয়। তারপর থেকে ঘুরে যেতে থাকে গ্রামবাসীদের জীবন। এক কামারগোদা খালকে ঘিরে গড়ে ওঠে স্বাবলম্বীতা আর অধিকার সচেতনতার গল্প। আর সেই গল্পের নেতৃত্বে থাকে নারীরা। নারীরাই কেন? অথবা নারীরা কেন নয়?
নিয়মিত জীবনব্যবস্থায় নারীর জন্য ঘরের লক্ষণরেখা সুনির্দিষ্ট হলেও এর ভিন্নচিত্রও রয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্বিপাকের প্রতিটি চিত্রে যখন জীবনের প্রতিটি স্তর ভাসমান তখন নারীকে দেখা যায় দু'হাতে সামলাতে। গলা পর্যন্ত বন্যায় নারী এগিয়ে চলে এক হাতে সন্তান আর এক হাতে শুকনো খাবারের পোটলা হাতে। অথবা গৃহপালিত প্রাণীটিকে বাঁচাতে সাঁতারাতে থাকে নারীটিই। প্রশ্নটা যখন অস্তিত্বের তখন সকল কুসংস্কারও ভেসে যায় স্রোতে। সমাজ অথবা পুরুষ, নারীর গতিপথে তখন আর প্রতিবন্ধকতা নয়, সহযোগী হয়ে দাঁড়ায়।
এভাবেই গল্পগুলো সাফল্যগাঁথা হয়ে ওঠে অনিতা রায়, কুলসুম বিবি, আলেয়া বেগম, মনীষা রায়ের মত অনেক নারীমুখের। খুলনার এই নারীরা মনে করিয়ে দেয় জলাশয়ের সাথে কতটা নিবিড় জনজীবন। খুলনার নদীবর্তী নারী জানিয়ে দেয় উঠান পেরিয়ে কেবল পানীয় জল আনতেই নারীর জলাশয় আসা-যাওয়া নয়। তারা মাছ ধরেছে, জাল ফেলেছে, বৈঠা টেনেছে নৌকার, বাধ ঠেকাতে ছুটে গেছে মাঝরাতে, কৃষিতে ধরেছে হাল পুরুষের সাথে।
নদীকে কেন্দ্র করে যে যুথবদ্ধতা, তা দিক নির্দেশনা দেয় অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতারও। খুলনার বসুরাবাদ গ্রাম, তেঁতুলতলা গ্রাম এবং হোগলাডাঙ্গা গ্রামের পানি ব্যবস্থাপনা কমিটি কিংবা নদী-খাল রক্ষা কমিটিতে নারীদের প্রাধান্য তো রয়েছেই, বিভিন্ন প্রশিক্ষণ আর সমবায় কাঠামোও গড়ে তুলেছে গ্রামবাসীরা।
এক জলাধার জনজীবনকে দেখিয়েছে তাদের বেঁচে থাকার অধিকারের সকল দিক। অধিকার সচেতনতার যা্ত্রায় নারী আর গ্রামবাসীরা স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে থাকলে তারা বাল্যবিবাহের মত পশ্চাৎপদ ফাঁদ থেকেও নিজেদের টেনে আনতে শুরু করে। তাই তো খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার বসুরাবাদ গ্রামের নারী-পুরুষ একযোগে আজকে বলছে, "এই গ্রামে বাল্যবিবাহ নাই, নাই নাই।"
নদী-খাল উদ্ধারের সাফল্য, ধারাবাহিক ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি নতুন সংকটও সামনে আসে- নদী দূষণ, খাল দূষণ। আর এসবের বিপরীতে প্রয়োজনীয়তায় উঠে আসে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, প্রশাসনিক সহযোগিতা, নীতিমালা।
প্রকৃতির কোলে ফ্রান্সের লেক আনসির জন্ম হয়েছিল নাকি ১৮ হাজার বছর আগে। পর্যটন আকর্ষণ ছাড়াও লেক আনসি ইউরোপের স্বচ্ছতম লেকের পরিচিতি নিয়ে বয়ে যাচ্ছে। এই লেকের নিবিড় ব্যবস্থাপনায় ১৯৬০ সাল থেকে প্রণিত নীতিমালার কারণেই লেকের প্রাকৃতিক স্বচ্ছতা ধরে রাখা গেছে। দুর্ভাগ্য আমাদের রংপুরের রংপুরের ঐতিহ্যবাহী শ্যামাসুন্দরী খালটির। ১০০ বছরের পুরনো খালটি এককালে এর স্বচ্ছ পানি প্রবাহে জীবন দিয়েছিল নগরবাসীকে। এখন খালটি দুর্নীতির খপ্পরে দূষিত হয়ে মৃত।
আন্দোলন আর দিবস দিয়ে নদী-খাল-জলাশয় রক্ষা করা আমাদের দেশে হয়ত কিছুটা অসম্ভবপরই। এই উপলব্ধি নিয়েই হয়ত দেশের পরিবেশবাদীরা ২২ মার্চ পালন করবেন বিশ্ব পানি দিবস। গবেষণা বলে, বিশ্বের ২.১ বিলিয়ন মানুষ পানীয় জল সংকটে বাস করে। পানি দিবস নিয়ে খুলনার প্রত্যন্ত এলাকার নারীরা হয়ত নাও জানতে পারেন। তারা হয়ত গবেষণার পরিসংখ্যানের কথাও জানেন না। কিন্তু পানীয় জলের জন্য তাদের রয়েছে দাবি। তাদের রয়েছে অধিকারের উচ্চারণ। নদীবর্তী, খালবর্তী জনবসতির এই অধিকার সচেতনতাই বিশাল অবলম্বন এখন জলাধারগুলো বাঁচাতে।