Published : 21 Jul 2013, 09:50 PM
আমরা আজকে এমন একটি মে দিবস কাটাচ্ছি যার আগে ও পরে বিএনপি হরতাল ও সমাবেশ ডেকেছে ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার প্রতিবাদে | এক সপ্তাহের মধ্যে পর পর তিন দিন ও দুই দিন হরতাল কাটিয়ে গৃহবন্দী ও কর্মত্যাগী অনেক মানুষের কাছেই আজকের মে দিবস হয়ত একটা স্বস্তির দিন | মে দিবস না হলে হয়ত আজকেও হরতাল ডাকত বিএনপি | এপ্রিল মাসে অনেকগুলি ঘটনা পর পর ঘটে গেছে | রেইলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনকে নিয়ে বিতর্ক, ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়া, এদিকে আইএমএফের কাছ থেকে বাংলাদেশের ঋণ গ্রহণ, প্রধানমন্ত্রীর তুরস্ক সফর, ভারতীয় ঋণের শর্ত শিথিল, এবং সর্বশেষ নৌপরিবহন মন্ত্রীর গাড়ি এক্সিডেন্টের কারণে চালক আটক | এত খবরের ভীড়ে একটা খবর হারিয়ে গেছে | আর তা হলো ২০১২ র এপ্রিল মাসের ৪ তারিখ আমিনুল ইসলাম নামে একজন শ্রমিক নেতাকে অপহরণ করা হয় আশুলিয়া থেকে এবং পরদিন সকালে তার লাশ পাওয়া যায় টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে | জানা গেছে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে অমানবিক নির্যাতনের চিন্হ পাওয়া গেছে | তার পায়ের একটি অংশে ফুটা করা হয়েছে এবং বিভিন্ন স্থানে ক্ষত পাওয়া গেছে |
আমিনুল ইসলাম বাংলাদেশ গামের্ন্টস এন্ড ইন্ডাস্টিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের একজন সক্রিয় সংগঠক হিসাবে বহুল পরিচিত ছিলেন | আর তাছাড়া গার্মেন্টস শ্রমিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির সাথেও তিনি যুক্ত ছিলেন | ন্যূনতম মজুরী বৃদ্ধির দাবীতে আন্দোলন করতে যেয়ে তিনি শ্রমিক সমাজের নজরে আসেন | এর আগে ২০১০ সালেও একটি বিশেষ সংস্থা একবার আমিনুলকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে | এসব ঘটনা অহরহ এমনভাবে ঘটছে যে এই নিয়ে বাড়তি ভ্রুক্ষেপের প্রয়োজন পরছে না কারো | বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ লেবার স্টাডিজের একটি সমীক্ষায় দেখা যায় ২০১১ সালে ১৯১ জন শ্রমিককে অপহরণ করা হয় | এই সব অপহরণের আগে ও পরে কি ঘটেছে আমাদের জানা নেই | তাই ২০১০ সালের পর যখন ২০১২ সালে আমিনুল হত্যা হয় তখনও খুব বেশী কিছু বদলায় নি | এখন পর্যন্ত দুইটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে যাদের তদন্তের অগ্রগতি এক রকম শূন্য বললেই চলে | শ্রমিক সংগঠনগুলোর আন্তর্জাতিক যোগাযোগের কারণে এখন আমিনুলের হত্যার খবর বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে গেছে | কিন্তু তাতে কিছুই পরিবর্তন হয়নি | ব্যবসায়ী সমাজ যেমন একদিক থেকে শ্রমিকের জীবনের মান উন্নয়নের সাফল্যের কাহিনী নিয়ে গলাবাজি করছেন বিশ্ববাসীর দুয়ারে তেমনি একই সাথে চাপা পরে যাচ্ছে শ্রমিকদের উপর অন্যায়, অত্যাচারের খবর |
বিশ্বায়নের এই যুগে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা যত বৃদ্ধি পাচ্ছে তত বৃদ্ধি পাচ্ছে শ্রমিকদের নিরাপত্তাহীনতা | বছরের পর বছর ধরে যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের স্বীকার হয়ে আসছে আমাদের শ্রমিক শ্রেনী সেই শ্রমিক শ্রেনী যখন মজুরী বৃদ্ধির দাবীতে রাস্তায় নামেন তখন আমরা বলি রাস্তা বন্ধ করে গন্ডগোল করছে এরা | শ্রমিক রাস্তায় নেমে গেলে তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে তৈরি করা হয়েছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ বাহিনী | কিন্তু শ্রমিকদের দাবী মেনে নিতে যা যা করনীয় তা নিয়ে সভা সেমিনারে নানান প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও প্রকৃতপক্ষে আন্দোলন দমনকেই কৌশল হিসাবে বেছে নেওয়া হচ্ছে সব সরকারের আমলেই| আজকে ২০১২ সালের শ্রমিক দিবসে নতুন করে শ্রমিকদের দুরবস্থার আখ্যান লেখার কিছু নেই |
যত পরিসংখ্যান দেখিয়েই বলা হোক না কেন দুই ডিজিটের মূল্যস্ফীতির কারণে স্বল্প মজুরী নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে শ্রমিক শ্রেণী, তাতে শ্রমিকদের দুরবস্থার চিত্র পরিষ্কার হয় না | শ্রমিকেরা কী খেয়ে বাঁচে তা শ্রমিক না হলে বুঝবার ক্ষমতা নেই ব্যবসায়ীদের ও সুশীল সমাজের | আর তাই এই নিরন্তর সংগ্রামে যত সংখ্যা দিয়ে, যুক্তি দিয়ে শ্রমিকের অধিকারের স্থানটি পরিষ্কার করা হোক না কেন তাতে শাসক শ্রেণীর কিছুই যায় আসে না |
২০১১ সালে মোট ২৩৯ টি শ্রমিক আন্দোলন হয় বিভিন্ন ফ্যাক্টরীতে | তার মধ্যে ১৪ টি আন্দোলন হয় শ্রমিক নির্যাতন ও হত্যার প্রতিবাদে, ৭৮ টি হয় ন্যায্য মজুরীর দাবীতে, এবং ৩০ টি হয় চাকরিচ্যুতির প্রতিবাদে | কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা ও আক্রমনের স্বীকার হয়ে মৃত্যু হয় ১৯৬ জনের | কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার স্বীকার হয়ে মৃত্যু হয় ৮৭৯ জনের | বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই এই সব ঘটনা ভুলে যেতে আমাদের বেশী সময় লাগে না |
প্রথমত গুপ্ত হত্যা, অপহরণ, নির্যাতন সব কিছুই অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার ফ্যাসিবাদী রূপ | তার মধ্যেও আরো স্পষ্ট শ্রমিক শ্রেণীর বঞ্চনার রূপ | কারণ যত হরতাল, যত আলোচনা ইলিয়াসকে নিয়ে ততটা আলোচনায় নেই আমিনুলের মত শ্রমিক | আজকের গুম হত্যা, অপহরণ, নির্যাতন হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনা নয় | এই ব্যবস্থা তৈরি করেছি আমরাই | আমরাই ভোট দিয়ে নির্বাচিত করি একেকটি সরকার যারা এই ব্যবস্থাকে প্রতিপালন করেন | আজকে আমিনুল হত্যার বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিবাদ নেই | আমরা ন্যূনতম মজুরী বাড়ানোর পক্ষে কয়েক লাইন লিখতে পারি, কিন্তু যুগ যুগ ধরে ন্যূনতম মজুরী বৃদ্ধির পক্ষে, শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থে আন্দোলনে দাড়িয়েছেন শ্রমিকেরাই, জীবনও দিয়েছেন তারাই | আর তাই আমিনুলকে হত্যা করা মানে দুনিয়ার মজদুরের সংগঠিত হওয়ার চেষ্টাকে ভেঙ্গে দেওয়ার প্রয়াস| আমিনুলের হত্যা প্রমান করে আজকের মে দিবসে শ্রমিকেরা যখন স্লোগান দিবেন "দুনিয়ার মজদুর এক হও " তখন শাসক শ্রেণী তথা ব্যবসায়ী শ্রেণী মনে মনে স্লোগান দিবেন "দুনিয়ার মজদুর ভেঙ্গে পড়" |
মোশাহিদা সুলতানা ঋতু: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস ডিপার্টমেন্ট-এর অর্থনীতির প্রভাষক।