সরকারি ব্যয় সীমিত রেখে, ঘাটতি অর্থায়ন কম রেখে, কম ঋণ গ্রহণ করে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ছাড় দিয়ে তূলনামূলকভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পূণরুদ্ধারকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে।
Published : 06 Jun 2024, 11:28 AM
বাজেট ঘাটতির কারণই হল বাজেটের প্রাক্কলিত রাজস্ব আয়ের চেয়ে প্রাক্কলিত রাজস্ব (চলতি) ও উন্নয়নমূলক ব্যয় (সরকারি মোট ব্যয়) বেশি, যে কারণে একটা পার্থক্য বা ঘাটতির সৃষ্টি হয়। এ ঘাটতি অর্থায়নের জন্য সরকারকে বিভিন্ন সূত্র থেকে অর্থায়ন অনুসন্ধান করতে হয়।
এখানে তিনটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য— সরকারি ব্যয়ের প্রথম অংশ রাজস্ব ব্যয়, বাংলাদেশে তার প্রায় সম্পূর্ণটাই রাজস্ব আয় দিয়ে মেটাতে হয় এবং সেখানে রাজস্ব বাজেটে কোনো উদ্বৃত্ত থাকে না। উদ্বৃত্ত থাকলে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির(এডিপি) ব্যয়ের একটি অংশ অন্তত এই উদ্ধৃত্ত দিয়ে মেটানো যেত, তাহলে ঘাটতি কম হত।
কিন্তু যেহেতু রাজস্ব-জিডিপির(মোট দেশজ উৎপাদন) হার বাংলাদেশে অনেক কম, তাই ঘাটতি অর্থায়নের প্রয়োজনীয়তা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।
দ্বিতীয়ত জিডিপির আকার বৃদ্ধির ফলে শতকরা হিসাবে আমরা ঘাটতি অর্থায়নের যে পরিমাপ করি (যেমন জিডিপির ৫ শতাংশের সমপরিমাণ), টাকার অঙ্কে এ পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে; তৃতীয়ত এটা যেহেতু ঘাটতি, তাই ঋণ দিয়েই অর্থায়ন করতে হবে। বাস্তবতা হলো আমাদের ঋণের পরিমাণ বাড়ছে, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক দু’দিক দিয়েই।
এটা ঠিক যে আর্থিক গভীরতার অভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঋণ অনেকাংশে ব্যাংকনির্ভর। কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিতে পারে। কিন্তু তা চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে আরো উসকে দেবে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষিত সংকোচনমূলক মূদ্রানীতির সাথেও সাংঘর্ষিক হবে; সুতরাং, এটা অপরিহার্য।
সরকার বিভিন্ন সঞ্চয় স্কিমের মাধ্যমেও এ ঋণ গ্রহণ করতে পারে। বাস্তবতা হলো, অভ্যন্তরীণ ঋণের অংশই ব্যাংক খাত থেকেই করতে হবে। এভাবে ব্যাংক খাত থেকে ঋণের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। কারণ যেটা আগে বলা হলো, ঘাটতি অর্থায়নের পরিমাণ বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে অভ্যন্তরীণ কম রাজস্ব আহরণের কারণে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।
ব্যাংকিং খাতে যথেষ্ট তারল্য থাকলে এবং সরকারের প্রদেয় ঋণের সুদের হার আকর্ষণীয় হলে, এখানে আপাত দৃষ্টিতে তাৎক্ষণিক সমস্যা হবার কথা নয়। সরকারও ঋণ পাবে, ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগের জন্য অর্থপ্রাপ্তির সমস্যা হবার কথা নয়।
কিন্তু সরকারের ঘাটতি অর্থায়ন মেটাতে ব্যাংক ঋণের নির্ভরশীলতা বাংলাদেশে বড় ধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। ব্যাংক ও বৈদেশিক ঋণের পরিষেবা (সুদ ও আসল পরিশোধ) রাজস্ব আয়ের একটি বড় অংশ নিয়ে নিচ্ছে। ঘাটতি অর্থায়ন বৃদিধর সাথে সাথে সুদাসল শোধের পরিমাণও ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। অন্যদিকে চলতি ও উন্নয়ন খাতে বিনিয়োগের জন্য সরকারের কাছে কম অর্থ থাকছে। এতে উন্নয়নমূলক কাজের জন্য আরো বেশি ঋণ নিতে হচ্ছে।
উন্নয়নমূলক কর্মসূচি সরকারকে অব্যাহত রাখতে হবে, দ্বিমত নেই। ঘাটতি অর্থায়নও থাকবে, এবং ঋণ (অভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং) ও বৈদেশিকের প্রয়োজনীয়তাও থাকবে; প্রশ্ন হলো রাজস্ব-জিডিপি দ্রুত না বাড়ালে (বাংলাদেশে এ হার দক্ষিণ এশিয়ার গড় হারের অর্ধেকেরও কম), বিপজ্জনক ও বাধ্যতামূলক ঋণ নির্ভরতা এবং ঋণ পরিষেবার দায়ভার আগামীতে আরো বাড়তে থাকবে। এজন্য সরকারি ব্যয় হ্রাস টেনে, ব্যয়ের দক্ষতা বৃদ্ধি করে কিছুটা সামাল দেয়ার চেষ্টাও করতে হবে।
সরকারের ঘাটতি অর্থায়নের ব্যাংক ঋণ নির্ভরতা ব্যক্তিখাতের ঋণ প্রাপ্তিতে যাতে সমস্যার সৃষ্টি না করে সে বিষয়ে সাবধান থাকতে হবে। বাংলাদেশ সরকার এক টাকা বিনিয়োগ করলে ব্যক্তিখাত করে তার চার গুণ। সুচিন্তিত, সাশ্রয়ী, সরকারি বিনিয়োগ ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগকে প্রণোদিত করে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও শোভন কর্মসংস্থানে অবদান রাখে। কিন্তু বাংলাদেশে সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে তা মধ্য-দীর্ঘ মেয়াদে বড় সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।
এজন্য সরকারকে নতুন ইনস্ট্রুমেন্ট নিয়ে আসতে হবে। সরকারের ঋণ-আশ্রয়ী বিনিয়োগ যাতে সাশ্রয়ীভাবে, সুশাসনের সাথে ও দক্ষতার ভিত্তিতে ব্যয় করা হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। আর মূল সমস্যায় শক্তভাবে হাত দিতে হবে, অর্থাৎ রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধি করে রাজস্ব ও উন্নয়ন ব্যয়ের বড় অংশ নিজস্ব অর্থায়নে করতে সচেষ্ট হতে হবে।
বাজেট ঘাটতি অর্থায়নের একটি অংশের জন্য সরকার ব্যাংক ঋণ নিতেই পারে, প্রশ্ন হলো পরিমাণ বৃদ্ধির প্রবণতা, সরকারের পুঞ্জীভূত ঋণ পরিষেবা বর্তমান ঋণ সক্ষমতা ও ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগকে প্রণোদিত করার শক্তিমত্তা কমাবে। অর্থনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় নিয়ে দেখতে হবে বাজেট ২০২৪-২৫ একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে হচ্ছে।
এ বছর সরকারি ব্যয় সীমিত রেখে, ঘাটতি অর্থায়ন কম রেখে, কম ঋণ গ্রহণ করে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ছাড় দিয়ে তূলনামূলকভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পূণরুদ্ধারকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে।