কবি মদন পাটোয়ারী এবং বই নিয়ে কেলেঙ্কারি

দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমরা মুখে বলব, বক্তৃতা করব কিন্তু ব্যবস্থা নেব না। এই হচ্ছে প্রবণতা।

আনিসুর রহমানআনিসুর রহমান
Published : 4 Sept 2022, 08:22 PM
Updated : 4 Sept 2022, 08:22 PM

সম্প্রতি ব্যাপক সমালোচনার জেরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় আমলা-লেখকদের বইয়ের একচেটিয়া প্রাধান্য দেয়া কলঙ্কময় বইয়ের তালিকাটি বাতিল করেছে। ইতিবাচক পদক্ষেপ। কিন্তু তারপরও গল্প থাকে। থাকে প্রশ্ন। সেই সব গল্প আর প্রশ্ন নিয়েই এই লেখার অবতারণা।

প্রথমে গল্পটাই বলতে চাই। গল্পের শিরোনাম, ‘কবি মদন পাটোয়ারী’। কবি মদন পাটোয়ারীর জীবনের খায়েশ আর খোশের বিত্তান্ত বলে সম্প্রতি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বই কেনার তুঘলকি ব্যাপার স্যাপার নিয়ে কয়েকটি প্রশ্ন তুলে ধরব।

গল্পটি এরকম– জীবনে এত কিছু করলাম যে, বলে শেষ করা যাবে না। কোনো জায়গায় বিমুখ হইনি, বিফল হইনি। এই ভূবঙ্গে একটা সফল মানুষের নাম নিলে, নিরপেক্ষ বিচারে আমার নাম নিতে হবে। জীবনে যা করতে চেয়েছি, করেছি। যা হতে চেয়েছি, হয়েছি। জীবনে আমলা হতে চেয়েছি, আমলা হয়েছি। জীবনে কবি হতে চেয়েছি, কবি হয়েছি।

আমলা হিসেবে যতগুলো ধাপ সবগুলো পেরিয়ে একদম চূড়ান্ত পর্যন্ত গিয়েছি। এই দেশে একটা সফল আমলার নাম নিলে আমার নাম নিতে হবে। এত সরকার আইলো-গেলো আমার অবস্থানের কোনো হেরফের হয়নি। আমি ঠিক ঠিক জানি কোন সরকারের কি দাওয়াই। কোন দলকে কোন ব্রান্ডের তেল দিতে হবে। আরে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘তৈল’ প্রবন্ধ পড়া আছে না।

সাহিত্য পড়ার একটা প্রায়োগিক বা অ্যাপ্লায়েড দিক আছে না। সাহিত্য পড়ে খালি ভাব নিলে হবে? তা কাজে প্রয়োগ করতে হবে না? আমি যেমন তেমন আমলা না। আমার লেখা কবিতা সরকারের গরু বিষয়ক মন্ত্রী অনেকবার সংসদে পড়েছে। সেই খবর দেশের সব সংবাদমাধ্যম প্রচার করেছে।

বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে এরকম ঘটনা কি আর একটাও আছে? থাকলে নিজের ইতিহাস ঘাইটা-ঘুইটা একটা নাম বের করুক তো দেখি। কবি হিসেবেও আমি কি ফেলনা? দেশের যেকোনো পত্রিকার সাহিত্য পাতা আমার কবিতা পেলে ধন্য ধন্য করে। সম্পাদকেরা আমার সঙ্গে সেলফি উঠায়। সাহিত্য সম্পদকরা ওই সব ছবি হা কইরা দেখে। আমার কবিতা দরকার হলে প্রথম পাতায় ছাপা হয়। আমি কি ভাতে মরা কবি নাকি? প্রকাশকরা একরকম লাইন ধরে থাকে।

কবিতার জন্যে যত পুরস্কার সব তো আমি পেয়ে গেছি। শুধু বাকি আছে নোবেল পুরস্কারটা। এটাও পেয়ে যাব। সেই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যের কয়েকজন মাস্টার এই বিষয় নিয়ে কাজ করতেছে।

তারপর গবেষণা, বিদ্যাচর্চা কোনটা না করেছি। পিএইচডি পর্যন্ত করেছি। কেউ যাতে বলতে না পারে ও এমন কি করেছে কবিতা লেখা আর আমলাগিরি ছাড়া! এখন আমার নাম সকলকে সমীহের সঙ্গে নিতে হয়। সরকারের সর্ব উচ্চের সচিব ডক্টর কবি আব্দুল আবুল পাটোয়ারী।

আমার কবি নাম যদিও আলাদা– মদন পাটোয়ারী।

এত সফলতার পরেও মনের ভেতর একটা না দুইটা বড় খচখচানি সবসময় যন্ত্রণা দেয়। সারাজীবন লালন করেছি কবিযশ। মানুষ আমাকে ‘কবি’ই বলুক। আফসোস মানুষ আগে পিছে আমাকে ‘আমলা’ বলে। এই আমলা পরিচয় থেকে রেহাই পেলাম না।

অন্যদিকে আমার বউটাও একজন। উনি বলবে তুমি আমলা ছিলে সেইটাই তোমার সঙ্গে যায়। তুমি খামোখা কবিতা লিখে সময় নষ্ট করতে গেলে কেন? তুমি কিসের কবি? শামসুর রাহমানের ধারে কাছেও তো কিচ্ছু লিখতে পারলে না।

কী যে বলি? কী যে করি? মনটায় কয় নিজেরে গুলি করি।

---

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আমলাদের বিদ্যাবুদ্ধির দাওয়াই খাওয়ানোর উদ্দেশে প্রশাসনের অন্দরে কেন্দ্র থেকে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন পর্যন্ত আমলা বাহাদুরদের জন্যে গ্রন্থাগার এবং সেই নিমিত্তে বই ক্রয়ের বরাদ্দ আর বরাদ্দকৃত বাজেট ব্যবহারের জন্যে বই ক্রয়ের যে তালিকা করা হয়েছিল তা দেখে তো অনেকেরই চক্ষু চড়ক গাছ। আমি যদিও একটুও অবাক হয়নি। কেননা এরকম ঘটনা এটাই প্রথম নয়।

সামরিক বেসামরিক সকল সরকারের সময় এরকম ঘটনা ঘটে আসছে। পত্রিকায় এসেছে, ফেইসবুকিং হচ্ছে– ওই পর্যন্তই। দেশের মানুষকে ঘুম পাড়ানোর জন্যে তদন্তের উদ্যোগ, একটু এদিক-সেদিক ‘সংশোধন অথবা সংশোধন নয়’ করে চলছে বই কেনার নামে আমলা তোষণ, ঠগবাজি আর জোচ্চুরি।

হাল আমলের কয়েকটা ঘটনা মনে করিয়ে দিতে চাই। কয়েক কোটি টাকার রবীন্দ্র রচনাবলী ক্রয়ের জন্য শাহবাগকেন্দ্রিক একটি প্রকাশনার নাম উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা জারি করা হয়েছিল। ঘটনাটি ঘটেছিল স্বয়ং সাবেক ও প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের সময়ে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু কর্নারের জন্যে নির্দিষ্ট একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে অধিকাংশ বই অন্তর্ভুক্ত করে তালিকা করা হয়েছিল। পরে তালিকা একটু আধটু এদিক সেদিক হয়তো করা হয়েছে। কিন্তু কাউকে কি শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে?

এসব ব্যাপার নিয়ে বাদ-প্রতিবাদ হলেও কারও বিরুদ্ধেই কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমরা মুখে বলব, বক্তৃতা করব কিন্তু ব্যবস্থা নেব না। এই হচ্ছে প্রবণতা। যে কারণে, যা হবার তাই হচ্ছে। আমলারা এত বাড় বেড়েছেন যে, ওনাদের ভাষা ও ভঙ্গি হাবভাব অনেকটাই কি কোম্পানি আমলের মতো নয়?

আমলাদের বই তালিকায় ঢোকাতে লাভ এবং লোভের যুৎসই রসায়ন কাজ করে একশ্রেণির আমলা আর প্রকাশকের। আর মাঝখানে দু-একজন ব্যতিক্রম ছাড়া হাল আমলে নতুন আবির্ভুত নির্লজ্জ প্রজাতির আমলা-লেখকগোষ্ঠী পুরস্কার বাগিয়ে নেওয়ার পথ করে এগোতে থাকেন। কতিপয় প্রকাশক রাতারাতি কোটিপতি হয়ে যায় যেন কেমন করে। এর বিপরীতে কত দায়বদ্ধ লেখক ভাতে মরে।

এর মধ্যে বুদ্ধিজীবীদের নিয়েও একটু কথা বলতে চাই। মন্ত্রণালয়ের বাইরে বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে কমিটি করে যখন বই ক্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়, সেখানেও দু-একজন ব্যতিক্রম ছাড়া কমিটির লোকজন নিজেদের এবং নিজেদের পছন্দের মানুষদের বই তালিকায় ঢুকিয়ে থাকেন। যেসব বুদ্ধজীবী তালিকার বাইরে থাকেন তারা কেউ কেউ মুখ খোলেন। আর তালিকার ভেতরে থাকলে চুপ থেকে একটু নিরপেক্ষ ভাব নেওয়ার চেষ্টা করেন।

এরকম ঘটনা কেবল বই ক্রয়ের ক্ষেত্রে নয় সরকারি প্রকাশনার ক্ষেত্রেও ঘটে থাকে। এই তো দিন কয়েক আগে আমাদের ঢাকা নগরের এক বয়োজ্যেষ্ঠ কবি ফেইসবুকে আক্ষেপ করে লিখেছেন, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা দফতর থেকে প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের একটি সংকলনে দুই জাঁদরেল আমলা-কবির তিনটি করে কবিতা ছাপা হয়েছে আর ওই খোদ ‘অ-আমলা’ কবির দুটি কবিতা স্থান পেয়েছে। আহারে আমলা কবি আহারে ‘অ-আমলা’ কবির আক্ষেপ। এরকম ঘটনা অহরহ ঘটতেই আছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বই ক্রয়ের জন্যে এরকম উদ্যোগ একটা প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়। যেখানে দেশের উপজেলা পর্যায়েই গ্রন্থাগার নেই সেখানে আমলাতোষণের জন্যে প্রশাসনের অন্দরে গ্রন্থাগার স্থাপন করে আমলাদের জন্যে কোটি কোটি টাকা খরচ করার মানে কি? এর চেয়ে বরং প্রতি উপজেলা পর্যায়ে গণগ্রন্থগার স্থাপনের জন্যে ধাপে ধাপে উদ্যোগ নেওয়া দরকার। একই সঙ্গে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, টেলিফোন ও ডাকযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ডাকঘরগুলোকে আধুনিক গ্রন্থাগার ও ডিজিটাল ডাক ও তথ্যকেন্দ্র হিসেবে উন্নীত করা যেতে পারে।

তবে ভবিষ্যতে বই ক্রয়ের এই সংস্কৃতি ও প্রশাসনিক পর্যায়ে কেলেঙ্কারি রোধ করতে চাইলে এবং আমলা বুদ্ধিজীবীদের লাগাম টেনে ধরতে হলে দেশে অবশ্যই একটি আধুনিক কার্যকর গ্রন্থনীতি এবং জাতীয় সংস্কৃতি নীতি থাকা প্রয়োজন। বেশ কয়েক বছর আগে অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন এবং মুনতাসির মামুনকে প্রধান করে গঠিত দুটি কমিটি দেশের সংস্কৃতি এবং গ্রন্থাগার বিষয়ে চমৎকার সুপারিশসহ দুটি প্রতিবেদন দাখিল করেছিল সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে। এই প্রতিবেদনের আলোকে পরবর্তী সময়ে কার্যকর কোনো উদ্যোগ কেন নেওয়া হলো না? এই প্রশ্নটি বর্তমান সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী এবং সাবেক সংস্কৃতি মন্ত্রী বরাবর রাখতে চাই।

এই লেখার আগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক আমলা বরাবর কতগুলো প্রশ্ন পাঠিয়েছিলাম। প্রশ্নগুলো আমার মনে উদয় হয়েছিল কবি মদন পাটোয়ারী গল্পের সুবাদে। প্রশ্নগুলো উল্লেখ করে লেখাটির যবনিকা টানতে চাই:

আপনার নিজের লেখা বই আপনার মন্ত্রণালয়ের ক্রয়কৃত তালিকায় ঢোকাতে পেরে লেখক হিসেবে এবং আমলা হিসেবে আপনার কেমন লাগছে?

এখানে কি নৈতিক বা আইনগত কোনো বিধিনিষেধ ডিঙাতে হয়েছে আপনাকে?

আসলে কোন বিবেচনায় এরকম একটি তেলেসমাতি কাজ করতে পেরেছেন?

ভবিষ্যত লেখক এবং আমলার জন্যে এই ঘটনার দ্বারা কি ইতিবাচক এবং অনুপ্রেরণামূলক বার্তা দিতে পেরেছেন?

এরকম একটি সফল আমলনামা জাতির সামনে হাজির করার পেছনে ইতিপূর্বেকার কোনো আমলা লেখক অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছেন? করে থাকলে ওনারা কারা?

তালিকায় অন্তর্ভুক্ত বই থেকে আপনি কত টাকা লেখক সম্মানী পাবেন? এই টাকা দিয়ে কী করবেন?

আপনার মতো একজন সফল আমলা-কবি হবার উপায়গুলো কী?

অতীতের কোনো একটা কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি দেওয়া হলে আমলার আজকের এই কেলেঙ্কারি করার সাহস পেতেন না। তাই জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীর উদ্দেশে একটি কথা বলতে চাই। বইয়ের তালিকা বাতিলই যথেষ্ট নয়। মন্ত্রণালয়ের বই ক্রয় নিয়ে অদূরদর্শী প্রকল্পটিই বাতিল করে প্রকল্পের সকল পর্যায়ের অনিয়মের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্টদের প্রতীকী হলেও ন্যূনতম শাস্তির আওতায় আনা বাঞ্ছনীয়। বই নিয়ে যা ঘটেছিল বা ঘটছে আদতে তা দুর্নীতি। এই সত্যটা স্বীকার করে নিলে জাতি হিসেবে আমাদের মঙ্গল হতে পারে।