Published : 06 Feb 2011, 10:37 PM
বাংলাদেশে বিদ্যূৎ সরবরাহ বৃদ্ধি ও উৎপাদন খরচ হ্রাস করতে হলে বিকল্প জ্বালানির উৎস ব্যবহারের দিকে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। কৃষি বর্জ্য, যেমন ধানের ভূষি বিদ্যূৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। অধিকন্তু, পোড়া ভূষি থেকে প্রাপ্ত সিলিকা সমৃদ্ধ ছাই সিমেন্ট ফ্যাক্টরি সমূহে ব্যবহৃত হতে পারে এবং বর্জ্য দিয়ে জৈব সার তৈরি করা যেতে পারে। বাংলাদেশে ধান মাড়াই কলগুলোতে প্রচুর ভূষি উৎপন্ন হয়। সাধারণতঃ ধানের ওজনের শতকরা ২২ ভাগ ভূষি থাকে। বাকী ৭৮ ভাগ, চাল, খুদ ও কুড়ো। প্রতি বছর আমাদের দেশে প্রায় ৪ কোটি টন ধান মাড়াইয়ের ফলে প্রায় ৯০ লক্ষ টন ভূষি উৎপন্ন হয়। এই ভূষি ব্যবহার করে মূল্যবান বিদ্যূৎ উৎপাদন করে আবার সিমেন্ট তৈরির উপকরণও পাওয়া যেতে পারে।
বর্তমানে, দেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামে ধান মাড়াই কলে যে বিপুল পরিমাণে ভূষির স্তুপ জমা হয় তা প্রধানতঃ ধান সিদ্ধ করতে ব্যবহার করা হয়। ধান সিদ্ধ করার উপকারিতার থেকে অপকারিতা বেশি। সিদ্ধ ধানের চালের আকৃতি ভালো থাকে, পুষ্টিকর উপাদান ধরে রাখার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, পোকার আক্রমণ কম হয় এবং বেশি সময় ধরে সিদ্ধ করলেও ভাত নষ্ট হয় না।
অন্যদিকে, ধান সিদ্ধ করার ফলে চালে থাকা আমাদের শরীরের জন্য উপকারী প্রাকৃতিক এ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়, গুদামে রাখলে রয়ানসিডিটি (চর্বি জাতীয় পুষ্টি উপাদান পচনে গুণগত মান নষ্ট) হয়, চাল সিদ্ধ হতে অতিরিক্ত সময়ের প্রয়োজন হয়, চালে অতিরিক্ত আর্দ্রতার ফলে গুদামে থাকাকালে মাইকোটক্সিন উৎপন্ন হয় যা আমাদের স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর। পোড়া ধানের ভূষি থেকে উৎপন্ন ছাই যেখানে সেখানে বর্জনের ফলে জমির উর্বরতা নষ্ট করে দেয় এবং পরিবেশ দূষণ করে। আবার, পচা ভুষি থেকে মিথেন গ্যাস নির্গত হয়ে বিশ্বের তাপ বৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ধানের মিহি ও হালকা ভূষি আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যার কারণ হতে পারে। ফলে, আমাদের খাদ্য অভ্যাসের পরিবর্তনের সাথে সাথে ধান সিদ্ধ করার প্রথা রহিত করা প্রয়োজন।
সাধারণতঃ ৪০ থেকে ৫০ টন ধানের ভূষি থেকে ১ মেগাওয়াট বিদ্যূৎ তৈরি হতে পারে। গ্যাস্টিফিকেশন পাওয়ার জেনারেশন ও প্রসেস স্টিম ফ্যাসিলিটি প্রতিদিন ৫২৫ টন ভূষি/খড় থেকে ১২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে। যে সমস্ত গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ নেই, সেই সমস্ত এলাকায় ধানের ভূষি শক্তির উৎস হতে পারে। প্রাইভেট সেক্টর এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে সরবরাহ করতে পারে। এতে করে গ্রামে বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুযোগ দেয়ার সাথে সাথে প্রাকৃতিক গ্যাস বা খনিজ জ্বালানি থেকে উৎপন্ন বিদ্যুতের উপর নির্ভরতা কমে আসবে। তাছাড়া প্রাকৃতিক গ্যাস বা খনিজ জ্বালানি ব্যবহ্রত বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্রের তুলনায় কার্বন নির্গত হবে কম। ভারত ও থাইল্যান্ডসহ অনেক দেশের গ্রাম অঞ্চলে ছোট ছোট বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্রের জ্বালানি শক্তির উৎস্য ধানের ভূষি । বিহার রাজ্যে দুটো পাইলট কেন্দ্রে ধানের ভূষি থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে দশ হাজার গ্রামবাসীকে সরবরাহ করা হচ্ছে। এর ফলে ডিজেল বা কয়লা চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের তুলনায় ২০০ টন কম ক্ষতিকর গ্যাস নির্গত হচ্ছে।
ভস্ম হওয়ার পর ধানের ভূষি থেকে মোট ওজনের শতকরা ২৫ ভাগ ছাইয়ে পরিণত হয় এবং বাকী ৭৫ ভাগ উদ্বায়ী বা বাতাসে উড়ে যায়। এভাবে ধানের ভূষি থেকে বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ২০ লক্ষ টন ছাই উৎপন্ন হয়। এই ছাই বিভিন্ন কাজে ব্যবহ্রত হতে পারে। যেমন কংক্রিট তৈরিতে, সিরামিকে উজ্জলতার জন্য, ইনসুলেটরে, ছাদ আবরণে, জল প্রতিরোধক রসায়নিক দ্রব্যে, তৈল জাতীয় পদার্থ বিশোষক হিসেবে, বিশেষ ধরণের রং উৎপাদনে, অগ্নিশিখা রোধে, কীটনাশকের উপকরণ হিসেবে এবং জৈব সার প্রস্তুতে। ছাইয়ে শতকরা ৮৫-৯০ ভাগ সিলিকা থাকে। বিশেষ জাতীয় সিমেন্ট উৎপাদন ও কংক্রিট মিশ্রণে বিশ্বে মিহি এমোরফাস সিলিকার প্রচুর চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে সিলিকা ফিউম বা মাইক্রো সিলিকা ব্যবহার করে এই চাহিদা পূরণ করা হয়ে থাকে। নরওয়ে, চীন ও মিযানমার থেকে সিলিকা ফিউম বা মাইক্রো সিলিকা আমদানি করা হয়। সীমিত সরবরাহ ও অতিরিক্ত চাহিদার ফলে এর মূল্য টন প্রতি ৫০০ আমেরিকান ডলারে পৌঁছেছে। সিলিকা ফিউম বা মাইক্রো সিলিকার পরিবর্তে ধানের ভূষির ছাই থেকে প্রাপ্ত সিলিকা ব্যবহারের বিপুল সুযোগ রয়েছে।
সিলপোজ হিসেবে পরিচিত ধানের ভূষির ছাই থেকে প্রাপ্ত মাইক্রো সিলিকা বা এমোরফাস সিলিকা ব্যবহার করে অতি কার্যকরী কংক্রিট প্রস্তুত করা যেতে পারে। সিলপোজ সিমেন্ট থেকেও সুক্ষ্ণ। এতে ২৫ মাইক্রোন আকৃতির ছোট কণিকা থাকে। জল অনুপ্রবেশ প্রতিরোধে সিলপোজ খুবই কার্যকরী। ধানের ভূষির ছাই ও সিমেন্ট ৩:১ থেকে ১২:১ অনুপাতে মিশিয়ে বিভিন্ন প্রকারের অপরিবাহী ইট বা ব্লক তৈরি করা যেতে পারে। ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডে কম খরচে স্টোভ তৈরিতে এটা ব্যবহৃত হয়। করাত দিয়ে এই ব্লক সহজে কাটা যায়।
ধানের ভূষি বিদ্যূৎ উৎপাদনে সরকারী উদ্যোগ ও সহযোগিতা প্রয়োজন। যাতে করে দেশে রিনিউয়েবল সম্পদ ব্যবহার বৃদ্ধি পায় এবং বিদ্যূৎ উৎপাদনে দেশের মূল্যবান গ্যাস সম্পদ ব্যবহার হ্রাস পায় এবং আমদানিকৃত খনিজ জ্বালানির উপর নির্ভরশীলতা কমে। জ্বালানি বহুমুখী ব্যবহার নীতিতে রিনিউয়েবল শক্তি ব্যবহারের বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত করা যেতে পারে। এই নীতির অধীন জৈব বা বায়োমাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আগ্রহী বিনিয়োগকারী কোম্পানীগুলোকে যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য কর মওকুফ করা যেতে পারে। বিদ্যূৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এই ধরনের কোম্পানীগুলোর নিকট থেকে বিদ্যূৎ ক্রয় করে সরবরাহ করে সহযোগিতা প্রদান করতে পারে।
কিউ আর ইসলাম: ধানগবেষক।