Published : 20 Oct 2014, 05:11 PM
গত পরশু, ১৭ অক্টোবর, ২০১৪, একটু রাত করে বাসায় ফিরেছিলাম সবাই। দরজা খোলার পর স্ত্রীর চোখ মেঝেতে পড়তেই গ্রিক পুরানের সেই দুর্ঘটনা-আঁচকারী কাসান্দ্রার মতো ওর মুখটা মলিন ও আতঙ্কে আচ্ছন্ন হয়ে ওঠে।
"কী হল তোমার?"
"দেখতে পাচ্ছ না মেঝেতে কী পড়ে আছে!"
ভালো করে তাকিয়ে দেখি গাঢ় ধূসর রঙয়ের প্রায় একই আয়তনের দুটো মৃত প্রজাপতি নিথর হয়ে পড়ে আছে। জীবৎকালে যারা এত চঞ্চল ও উড়ুক্কু, যাদের ডানার ছন্দোময় সঞ্চালন প্রকৃতির বিশাল ক্যানভাস প্রাণময় করে রাখে, সেই প্রাণি এখন স্থির হয়ে পড়ে আছে। এই দৃশ্য কী এমন বেদনার সৃষ্টি করতে পারে আমার কাছে, যে কিনা দৈনন্দিন মৃত্যু ও নিষ্ঠুরতার সংবাদে পচে গেছে? সে (স্ত্রী) কি আমার চেয়েও বেশি স্পর্শকাতর ও ভঙ্গুর মনের বলেই এই দৃশ্য তাকে ব্যথিত করে তুলেছে?
কিন্তু সে এই মৃত্যুর অন্য এক নিহিতার্থের দিকে ইঙ্গিত করে আমাকে বলল, "জান, মেহিকোতে কারও ঘরের মধ্যে মৃত প্রজাপতি দেখতে পাওয়া মানে নির্ঘাত কোনো প্রিয়জনের মৃত্যু।"
নিছক কুসংস্কার বলে আমি ওকে সহানুভূতিহীন কণ্ঠে আমার বিশ্বাসের কথা জানিয়েছিলাম। যদিও গার্সিয়া মার্কেসের নিঃসঙ্গতার একশ বছর নামক উপন্যাসটিতে লাতিন আমেরিকান জীবনে কুসংস্কারকে এমন বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে উপস্থাপন করা হয়েছে যে, তা খোদ যুক্তিনিষ্ঠ পাঠককেও রীতিমতো দ্বিধাগ্রস্ত করে তোলে। আমি এই কুসংস্কারকে বড়জোর সাহিত্যিক সম্ভাবনা ছাড়া আর কোনোভাবেই মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলাম না। এমনকি মার্কেস যখন পেয়ারার সুবাস নামক সাক্ষাৎকার গ্রন্থে কুসংস্কারের প্রতি তাঁর পক্ষপাতের কথা জানালেন, তখনও মেনে নিতে পারিনি।
কিন্তু ১৯ অক্টোবর, ২০১৪ সকাল ৯ টার দিকে সহকর্মী আজিজ হাসান যখন বললেন, "রাজু ভাই, শুনেছেন বোধহয়…." আমি ওকে কথা শেষ না করতে দিয়েই উৎকণ্ঠা আর আতঙ্কের এক মিশ্র স্বরে– কারণ গত পরশুদিনের কুসংস্কারের ব্যাপারটা আমার মনের মধ্যে কোথাও ঘুণপোকার মতো আস্থার মর্মশ্বাস কেটে গুড়িগুড়ি করে দেওয়ার জন্য জেঁকে বসেছিল হয়তো, সেই নড়বড়ে অবস্থান থেকেই– জানতে চাইলাম, "কোনো দুঃসংবাদ"?
এত সকালে ফোন করা মানেই যে দুঃসংবাদ তা সংবাদপত্রে চাকরির সূত্রে আর অজানা নেই।
"সালাহউদ্দীন স্যার মারা গেছেন।"
তাঁর বয়স অফিসিয়ালি নব্বই হয়ে গেছে, তিনি শিগগিরই মারা যাবেন তা আমরা মোটামুটি আন্দাজ করে নিয়েছিলাম। মনে আছে বছর দুয়েক আগে বনানীতে তাঁর বাসায় একবার তাঁর সঙ্গে আড্ডা ও তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সহকর্মী ফারহানা মিলিকে নিয়ে। তখন গল্পে গল্পে স্যার আমাদের জানিয়েছিলেন যে, তাঁর জন্মসাল ১৯২২, যদিও কাগজে-কলমে সেটি ১৯২৪। সে হিসেবে সালাহউদ্দীন স্যার বিরানব্বই পূর্ণ করেছেন এ বছর।
নব্বই পেরুনো কেবল বাঙালির জন্যই নয়, যে কোনো জাতির লোকের জন্যই রীতিমতো ঈর্ষণীয়। তবু এই মৃত্যু আমাকে হতবাক করে দিয়েছে এই জন্য যে, গত সোমবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১৪ তাঁর বাসায় গিয়েছিলাম তাঁকে একটি ছবি উপহার দেওয়ার জন্য। তখন তাঁকে দেখে আমার মুহূর্তের বেখেয়ালেও মনে হয়নি যে, মৃত্যু থেকে তিনি মাত্র পাঁচ দিনের দূরত্বে, হাস্যোজ্জ্বল সজীবতা নিয়ে অবস্থান করছেন। তাঁর হাসি, সুস্বাস্থ্য ও আড্ডাপ্রিয়তাকে এমন এক সুরক্ষা-প্রাচীর বলে মনে হয়েছিল যে, মৃত্যু তা পাঁচ দিনের মাথায় এসে গুঁড়িয়ে দেবে তা ছিল অকল্পনীয়।
বললে নিষ্ঠুরের মতো শোনাবে, তবু সত্যের খাতিরে উল্লেখ করা উচিত যে, ঐ শেষ সাক্ষাতে তাঁকে বললাম, "স্যার, আপনার কিছু বইপত্র আমাকে উপহার দিয়ে যান (বলিনি যে আপনি তো মরেই যাবেন, কিন্তু অলক্ষ্যে সেই ইঙ্গিতটাই তো এসেছিল)।''
তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাজিও হলেন। সেদিন এও বললেন, "বুঝলে, আমার কিন্তু অনেক এলপি আছে। এগুলো শুনতে পারছি না। যন্ত্রটা নষ্ট হয়ে গেছে। দেখ তো এগুলো সিডিতে ট্রান্সফার করা যায় কিনা।''
আমি রসিকতা করে তাঁকে বললাম, "স্যার, আমি সিডিতে ট্রান্সফারের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আপনি এলপিগুলো আমাকে দান করে দিন।''
স্যার সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন। আমাদের উভয়ের ইচ্ছাই এক ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়ার জন্য মৃত্যু এত ধারেকাছে ওঁত পেতে ছিল, তা কি আমরা জানতাম?
যাই হোক, যে ছবিটা উপহার দিয়েছিলাম সেটার একটু 'শানে নযুল' না দিলে উপহার দেওয়ার কারণটা জানা যাবে না।
২০১৩ সালের ২৩ অক্টোবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী বেশ ঘটা করেই উদযাপন করা হয়েছিল হোটেল র্যাডিসন-এ। এই অনুষ্ঠানে প্রতিটি ক্ষেত্রের গ্রহ-নক্ষত্রের এমন সমাবেশ ঘটেছিল যে, অতিথিদের মধ্যেই কেউ কেউ ব্যাপারটা উল্লেখও করেছিলেন বিস্ময়ের সঙ্গে। সালাহউদ্দীন স্যারও ছিলেন এই নক্ষত্রদের একজন। প্রধান সম্পাদক তৌফিক (ইমরোজ খালিদী) ভাই আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন বর্ষীয়ান দুই জ্ঞানতাপস, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান আর সালাহউদ্দীন আহমদকে বাসা থেকে অনুষ্ঠানে নিয়ে আসার জন্য। প্রয়াত হাবিব স্যারের গাড়িতে করেই প্রাজ্ঞ দুই ব্যক্তিকে নিয়ে এসেছিলাম আমাদের অনুষ্ঠানে।
আমাদের নিজস্ব ফটোগ্রাফার আসাদুজ্জামান প্রামাণিক রতন প্রচুর ছবি তুলেছিলেন অনুষ্ঠানে উপস্থিত অতিথিদের। বাদ যাননি, যাবার কথাও নয়, এই দুই অভিভাবকতুল্য বরেণ্য ব্যক্তিত্ব। তাঁরা দুজন বসেছিলেনও পাশাপাশি, একই টেবিলে। রতন তাঁদের একটি অপূর্ব মুহূর্ত ওর ক্যামেরায় ধারণ করেছে যখন দুজন কৌতূহল নিয়ে চোখ রেখেছেন সালাহউদ্দীন স্যারের হাতে ধরা খাবারের মেনুতে। ছবিটি অপূর্ব, কারণ ক্যামেরার উপস্থিতি সম্পর্কে তাদের কোনো সচেতনতা ছিল না সেই মুহূর্তে। ফলে তাদের অভিব্যক্তির মধ্যে স্বাভাবিকতা ও সারল্যের এমন এক সৌন্দর্য উদ্ভাসিত হয়েছে যে, তা যে কারও নজরে পড়বে।
সালাহউদ্দীন স্যার এই ছবিটা আগে কখনও দেখেননি। হাবিবুর রহমান যখন মারা যান তখন সালাহউদ্দীন স্যার একটা অবিচুয়ারি লিখেছিলেন তাঁকে নিয়ে। তাঁর সেই লেখার সঙ্গে এই ছবিটিও প্রকাশিত হয়েছিল। ছবিটা দেখে খুব পছন্দ করেছিলেন তিনি। লেখাটি প্রকাশের অনেক দিন পর তাঁর সঙ্গে হঠাৎ একদিন ফোনে আলাপ করতে গিয়ে তাঁর সেই পছন্দের কথা জানতে পারি। ছবিটির একটা কপি দেওয়া যায় কিনা তা জানতে চাইলেন।
''অবশ্যই দেওয়া যাবে স্যার। শিগগিরই পেয়ে যাবেন আপনি।''
তৌফিক ভাইকে তাঁর এই ইচ্ছার কথা জানাতেই তিনি বললেন, "বড় সাইজে সুন্দর করে বাঁধাই করে তাঁর বাসায় পৌঁছে দেন ছবিটা।"
১৩ অক্টোবর, ২০১৪ ছবিটার একটা বড় কপি বাঁধাই করে সহকর্মী মুজতবা হাকিম প্লেটো ও নাহার মাওলাকে নিয়ে তাঁকে উপহার দিতে গিয়েছিলাম, তাঁর বাসায়। ছবিটা পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলেন। আমাদের বিস্কুট ও কফি দিয়ে আপ্যায়ন করতে করতে অনেক কথা বললেন সেদিন। আলাপ হল তাঁর সর্বসাম্প্রতিক লেখাটি নিয়ে যা ছিল এ কে খন্দকারের বিতর্কিত বইটি নিয়ে বদরউদ্দীন উমরের প্রতিক্রিয়ার জবাব।
লেখাটি পড়ে ভালোলাগার কথা বলতেই শিশুর মতো হাসলেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক সময় মিষ্টিমধুর ব্যক্তিত্বও কখনও কখনও তিক্ত হয়ে উঠেন। জীবন সম্পর্কে নেতিবাচক অভিজ্ঞতাই হয়তো কাউকে কাউকে তেমন করে তোলে। সালাহউদ্দীন স্যার ছিলেন এ ক্ষেত্রে একেবারেই ব্যতিক্রম। বিরক্তি এবং তিক্ততার অভিব্যক্তি আমি তাঁর মধ্যে কখনও দেখিনি।
যদিও রক্তমাংসের এই মানুষটির সঙ্গে আমার পরিচয় মোটামুটি পাঁচ বছরের, কিন্তু তাঁর নামের সঙ্গে পরিচয় ছিল সেই আশির দশক থেকেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের কয়েকজন ছাত্র ছিল আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ওদের কাছ থেকেই প্রথম তাঁর কথা শুনি। তখনই বোধহয় তাঁর অসামান্য গবেষণা গ্রন্থ Social ideas and social change in Bengal 1818-1835 এর সন্ধান পাই।
এই বন্ধুদেরই একজন সম্ভবত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি থেকে বইটি তুলে আমাকে পড়তে দিয়েছিল। বইটি খুব বেশি বড় নয়, কিন্তু উনিশ শতকের বাংলার সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটটি সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ ও গভীর বিশ্লেষণে এতই সমৃদ্ধ যে, এ বিষয়ে এর সমতুল্য বই বোধহয় আর একটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এটি ছিল লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর পিএইচ-ডি থিসিস।
বিপুল তথ্যের সমাহার যেমন এই বইটির একটি বৈশিষ্ট্য, তেমনি কোনো মতাদর্শ ও ধর্মের প্রতি পক্ষপাতহীন তথ্য বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা ছিল এর অন্য এক আকর্ষণীয় দিক। ইতিহাসের উপাদানগুলো যে স্বচ্ছতা ও মননশীল হৃদয় দিয়ে তিনি বিন্যাস করেছেন তা সাধারণ পাঠক যেমন, তেমনি পাণ্ডিত্যপিপাসু পাঠকদেরও মুগ্ধ না করে পারে না।
সত্যি বলতে কী, উনিশ শতকের হিন্দু ও মুসলমানদের বাংলার আধুনিক যুগের রেনেসাঁ পর্বে নানা চিন্তা ও চেতনার যে বহুমুখী স্রোত প্রবহমান ছিল তার একটি বিন্যস্ত ও পূর্ণাঙ্গ রূপ ধরা পড়েছে এই বইয়ের আয়নায়। এটা খুবই আশ্চর্য এক কাকতাল যে, বাঙালির তথা বাঙালি মুসলমানের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্বের যে অনুসন্ধান তিনি শুরু করেছিলেন ছাত্রজীবনে, তার একটি সচেতন বিকশিত রূপ দেখার সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।
আমরা তাঁর পরবর্তী কাজগুলোর দিকে তাকালেই লক্ষ্য করব যে, বাংলার সমাজ-চিন্তা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, রামমোহন রায়, উনিশ শতকের বাংলার মুসলমান, বাঙালির আত্মপরিচয়, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা– এগুলোই ছিল তাঁর লেখার বিষয়বস্তু। সবশেষে তিনি থিতু হয়েছিলেন বাংলাদেশ ও স্বাধীনতা– এই দুই চূড়ান্ত বিষয়ে। উপরোক্ত বিষয়গুলোতে গভীর পাঠকদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য যে পাণ্ডিত্য ও প্রজ্ঞা দরকার হয় তা পূর্ণমাত্রায় তাঁর মধ্যে ছিল।
তিনি যদিও প্রধানত ইতিহাসবিদ কিন্তু ইতিহাসের প্রবণতা চিহ্নিত করতে গিয়ে প্রায়শই এর সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট সমান গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরতে পারতেন। এই সক্ষমতার কারণ এই যে, তিনি শিল্প, সঙ্গীত ও সাহিত্যের পুষ্টি দিয়ে নিজের ঐতিহাসিক সত্তাকে বহু বর্ণে বর্ণিল করে রাখতে জানতেন। যে কারণে 'আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে মানবতাবাদী ও সমন্বয়ধর্মী ধারা' সম্পর্কে লিখতে গিয়ে তাঁকে দেখি প্রাসঙ্গিকতার সূত্রে কবীর, নানক, কবি আবদুল হাকিম, লালন, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের রচনা থেকে দেদার উদ্ধৃতি হাজির করতে।
ব্যক্তিগত জীবনে গান ছিল তাঁর প্রাণ– রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত, আধুনিক গান। অন্যদিকে কবিতা ছিল তাঁর হৃদয়ের সেই অনিবার্য উপাদান যা তাঁর ঐতিহাসিক সত্তার চতুর্দিকে বায়ুমণ্ডলের মতো ঘিরে থাকত।
বাম রাজনীতির প্রতি তিনি ঝুঁকেছিলেন ছাত্রাবস্থায়। ধীরে ধীরে আকৃষ্ট হন এমএন রায়ের প্রতি। এমএন রায়ের শিষ্যই ছিলেন বলা যায়। নিজেকে রায়ের রাজনৈতিক আদর্শ অনুযায়ী র্যাডিকাল হিউম্যানিস্ট বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন। রায়ের প্রতি আমার আগ্রহ দেখে খুবই খুশি হয়েছিলেন তিনি। তা এতটাই যে, তিনি আমাকে রায় সম্পর্কে এবং রায়ের লেখা বইপত্র তাঁর ব্যক্তিগত লাইব্রেরি থেকে দিয়েছিলেন পড়ার জন্য। তিনি যখন জানলেন যে, আমি মেহিকোতে কিছুদিন ছিলাম তখন তিনি মেহিকোতে রায়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে অনেক কথা বললেন। রায় নিয়ে কেউ কিছু করছে শুনলে তিনি খুশি তো হতেনই, এমনকি সম্ভাব্য সব ধরনের সহযোগিতার জন্য আন্তরিকতার সঙ্গে হাত বাড়িয়ে দিতেন।
ভারতের হিন্দু-মুসলমান পর্বের ইতিহাস লিখতে গিয়ে অনেকেই সাম্প্রদায়িক চেতনায় প্রভাবিত হয়ে সেই ইতিহাসকে একচোখা সাইক্লোপসের মতো করে ফেলেন। সালাহউদ্দিন আহমদের অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও ধর্মনিরপেক্ষতাবোধ তাঁকে সব সময় এই বিপদের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। তিনি সাংস্কৃতিক ও জাতিগত যে-সমন্বয়বাদী ধারণার সাধনা করেছিলেন তা কেবল উদারতার জন্যই নয়, একই সঙ্গে এর সর্বজনীন আবেদনের কারণেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ আজকের এই জাতিবিদ্বেষের বিষাক্ত পরিমণ্ডলে। তাঁর পাণ্ডিত্য ও মননশীলতা তাঁকে যে উচ্চতায় নিয়ে গেছে তার সঙ্গে তুলনীয় হতে পারেন আরেক ইতিহাসবিদ আবু মহামেদ হাবিবুল্লাহ যিনি আল বেরুনির ভারততত্ত্বের অনুবাদসহ আরও অনেক অসাধারণ কাজ করে গেছেন।
সালাহউদ্দীন আহমদ তাঁর বহু লেখায় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সেই প্রবাদপ্রতিম উদ্ধৃতিটি ব্যবহার করতেন: আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। শহীদুল্লাহর এই উক্তির সারৎসার ছিল তাঁর জীবন ও কর্মের জগতে এক মৌল উপাদান। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার তাঁকে ভীষণ পীড়িত করত। ধর্মীয় উন্মাদনার এই যুগে তিনি নিজের বিশ্বাস আর আদর্শ একটুও টলে যেতে দেননি।
ধর্ম সম্পর্কে যদিও তাঁর সহানুভূতি ছিল শূন্যের কোঠায়, কিন্তু ধর্মীয় সহনশীলতায় সর্বোচ্চ মর্যাদা দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন তিনি। ভারতীয় ও বাঙালি মুসলমানদের মনের কলকব্জার খোঁজ নিতে গিয়ে সুফি মতবাদের উৎপত্তি ও বিকাশের ভূমিকা তিনি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছেন। কিন্তু ব্যক্তিজীবনে সুধীন দত্তের মতোই উদাত্ত কণ্ঠে হাসতে হাসতে বলতে পারতেন সেই নাস্তিক্যের তিলকশোভন প্রখর পংক্তিমালা:
উড়ায়ে মরুর বায়ু শূন্য বেদ-বেদান্তের পাতা
বলেছি পিশাচ হস্তে নিহত বিধাতা।
এক গুণীজনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে নিজের জীবনের সেই যুগান্তকারী ঘটনাটির উল্লেখ করেছিলেন তিনি যা ছিল তাঁর বিশ্বাস ও আদর্শের পথে প্রথম দৃঢ়, অকুতোভয় এক প্রথাদ্রোহী পদক্ষেপ: শুকরের মাংস খেয়ে ধর্ম দূষিত করা। ধর্ম দূষিত না করলে ধর্ম তাকে দুষিত করে ফেলতে পারে– এই ভয় থেকেই বোধহয় তিনি এই দুঃসাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ছাত্রজীবনে এ রকম একটি কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলা সে যুগে মোটেই সহজ ছিল না। বাঙালি মুসলমান সমাজের সেই অনুদার অবরুদ্ধ মনে এই ঘটনার ফলাফল কী হতে পারে তা নিয়ে তিনি মোটেই ভাবিত ছিলেন না বিশ্বাসের স্থিরতার কারণে।
আবার বিশ্বাসের দৃঢ়তার পাশেই সহোদরের মতো বাস করত কোমল মনের এক মানুষ। প্রিয়জনদের আবদার ও উপকারে তিনি সাড়া দিতেন সর্বোচ্চ আন্তরিকতা নিয়ে। ২০১০ সালের মে মাস থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের 'মতামত বিশ্লেষণ'-এর দায়িত্ব গ্রহণ করার পর তাঁর কাছে লেখার আবদার নিয়ে হাজির হলে, তিনি বিমুখ করেননি। সেই থেকেই তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয়ের সূত্রপাত। গত পাঁচ বছরে তিনি আমাদের চার-পাঁচটি অনুষ্ঠানে তো এসেছিলেনই, এমনকি বিভিন্ন উপলক্ষে তাঁর কাছ থেকে পেয়েছি 'মতামত' বিভাগের জন্য ১৫ টি লেখা।
সর্বশেষ তাঁকে যখন আমাদের ২৩ অক্টোবর অনুষ্ঠিতব্য আট বছরের নির্বাচিত আলোকচিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করার প্রস্তাব নিয়ে যাই, তিনি কোনো ধরনের অজুহাত ছাড়াই তাতে সম্মতি জানান। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর প্রতি তাঁর প্রীতি ও পক্ষপাত আমাদের জন্য ছিল এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা। আমাদের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ভাইয়ের ভাষা ধার করে বলা যায়, "তিনি আমাদেরই একজন ছিলেন। একজন অনুপ্রেরণাদায়ক অভিভাবক। প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিবৃত্তিক সততায় যে প্রজন্মটি আমাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন, প্রফেসর সালাহউদ্দীন সম্ভবত সেই প্রজন্মেরই শেষ প্রতিনিধি।"
রাজু আলাউদ্দিন: লেখক ও সাংবাদিক।