Published : 02 Dec 2010, 11:32 PM
প্রতি বছর আমরা বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে ৩ ডিসেম্বর আর্ন্তজাতিক প্রতিবন্ধী দিবস পালন করে থাকি। কিন্তু প্রতিবন্ধীদের মানবাধিকারের কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে তা মূল্যয়নের সময় এসেছে। অথচ অন্য সব সাধারণ নাগরিকের মত তাদেরও রয়েছে সমান সুযোগের অধিকার।
প্রতিবন্ধী শব্দটি যেন এক বৈষম্যের প্রতিধ্বনি। শব্দের অর্ন্তগত অর্থ সেই শব্দের নাম নির্দেশ করে থাকে। সেজন্য অন্য শব্দ ব্যবহৃত হলেও হয়ত নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সেই শব্দকেও নেতিবাচক করে তুলবে। নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বৈষম্যের উৎপত্তি এবং বৈষম্য থেকে জনবিচ্ছিন্নকরণ। প্রতিবন্ধী নাগরিকগণ যেন সমাজে অন্য সব নাগরিকের মত সমান অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে বসবাস করতে পারেন সে বিষয়ে সচেতনতা তৈরী ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য প্রতিবছর আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস পালিত হয়। এবারের এই দিবসের প্রতিপাদ্য " সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় প্রতিবন্ধিতা অন্তভূর্ক্তকরণ ও অঙ্গীকার বাস্তবায়ন- (Keeping the promise: Mainstreaming Disability in the Millennium Development Goals (MDGs) towards 2015 and beoynd)"
জাতিসংঘ সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার (১৯৪৮) পরও কেন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষায় আলাদা আইন প্রণয়নের প্রয়োজন পড়লো? কারণ, ঐ ঘোষণা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ন্যায্য অধিকার রক্ষায় যথেষ্ট ছিল না। এজন্য জাতিসংঘ কর্তৃক ১৯৮১ সালে ৩ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস পালনের সুচনা হয়। পরবর্তীতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য বিশ্ব কর্মসূচী (World Program of Action Concerning Disable Persons 1982) এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সমঅধিকারের জন্য আদর্শ আইন (Standards Rules on Equalization of Opportunities for persons with disability)। এসকল আইন তৈরির উদ্দেশ্য ছিল প্রতিবন্ধী ব্যক্তিগণের সমাজে মূলধারার উন্নয়ন কর্মকান্ডে সম্পৃক্তকরণ, ও তাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, স্বাস্থ্যগত ও মানবাধিকার সংরক্ষণ। এসকল আইনের সফল পরিপূর্ণ কাঠামো হচ্ছে আইনী কাঠামোগত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গের অধিকার বিষয়ক জাতি সংঘ সনদ (Convention On The Rights Of Persons With Disabilities- CRPD) যা ২০০৬ সালে গৃহীত হয়। বাংলাদেশ ৯ মে ২০০৭ সালে এই আইনে স্বাক্ষর করে এবং একই বছর ৩০ নভেম্বর তা অনুমোদন করে। এখানে উল্লেখ্য, বাংলাদেশ এর অনেক আগেই ২০০১ সালের প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন পাশ করে যা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষায় একটি মাইলফলক। বর্তমানে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় জাতীয় প্রতিবন্ধী ফোরামের সহযোগিতায় সিআরপিডির আদলে "বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষা আইন ২০১০" এর খসড়া চূড়ান্ত করেছে যা এখন অনুমোদনের অপেক্ষায়।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বলতে তাদেরকে বুঝানো হয় যাদের দীর্ঘ মেয়াদী শারিরীক, মানসিক, বুদ্ধিগত ও ইন্দ্রিয়গত সমস্যার কারণে অন্যসব নাগরিকের ন্যায় সমাজে সকল কর্মকান্ডে অংশগ্রহণে বাধাগ্রস্থ হন। আজকে যিনি প্রতিবন্ধী নন তিনি যে কোন ধরনের দূর্ঘটনায় প্রতিবন্ধীতায় আক্রান্ত হতে পারেন। বিষয়টিকে যদি আমরা এভাবে দেখি তাহলে প্রতিবন্ধীদের অন্য সব নাগরিকের মত সমান মর্যাদা ও সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে অসুবিধা হবার কথা নয়। কিন্তু মূল সমস্যা দৃষ্টিভঙ্গির। প্রতিবন্ধী নাগরিকগণ অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকুরী ও রাজনৈতিক অধিকারসহ মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। সরকারী স্কুল ও চাকুরীতে তাদের কোটা সংরক্ষিত থাকলেও তা মানা হচ্ছে না।
উন্নয়নশীল দেশের সুবিধা বঞ্চিত নাগরিকেদের জন্য দারিদ্র বিমোচন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, টেকসই উন্নয়ন ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) নির্ধারণ করা হয় ২০০১ সালে। কিন্তু, ঐ কর্মসূচীতে প্রতিবন্ধী নাগরিকের জন্য সুনির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য ও কর্মসূচী ছিল না। অথচ বিশ্বে ৬৫ কোটি জনগণ প্রতিবন্ধিতায় আক্রান্ত। বাংলাদেশে প্রতিবন্ধিতার কোন জাতীয় পরিসংখ্যান না থাকলেও জাতিসংঘ হিসাব অনুযায়ী শতকরা ১০ ভাগ জনগন যে কোন ধরনের প্রতিবন্ধিতার শিকার। এ বিপুল জনগোষ্ঠীকে উন্নয়ন কর্মকান্ডের মূলধারার বাইরে রেখে জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়। এজন্য গত বছর আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল "সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় প্রতিবন্ধিতা অন্তর্ভূক্তকরণ ও ক্ষমতায়ন।" এবারের বিষয়ে এর প্রতিশ্রুতি রক্ষার উপর জোর দেওয়া হয়েছে।
এমডিজিতে প্রতিবন্ধী বিষয় অন্তর্ভূক্তকরে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন এ বিষয়ে জাতীয় পরিসংখ্যান। কারণ, এমডিজিতে যে সকল নির্দেশক ও লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে সেগুলি অনেক ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী নাগরিকের অধিকারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এজন্য ২০১১ সালে অনুষ্ঠিতব্য আদম শুমারীতে এবিষয়ে যেন বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হয় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনের এমডিজি বিষয়ক মহা-সচিব রিপোর্টে (জুলাই ২০১০) যতক্ষণ পর্যন্ত এধরনের পরিসংখ্যান না পাওয়া যায় ততক্ষণ সাধারণ নির্দেশনাকেই মান্য হিসাবে বিবেচনা করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা, খাদ্য সংকট, জ্বালানী সংকট, অপুষ্টি, ক্ষুধা ও দারিদ্রে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে প্রতিবন্ধী জনগণ। তার উপর প্রাকৃতিক দূর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিও তাদের জন্য বেশী যা মরার উপর খাড়ার ঘায়ের মত। মায়ানমারে ২০০৮ সালে ঘূর্ণিঝড় নার্গিসে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সরানো হয়নি এ বিষয়টি জাতিসংঘ রিপোর্ট থেকে জানা যায়।
আমাদের সমাজে নারীরা এমনিতেই বৈষম্যের শিকার। প্রতিবন্ধী নারীগণ সেক্ষেত্রে দ্বিগুন বৈষম্যে আক্রান্ত। এছাড়াও শারীরিক, মানসিক, যৌন নির্যাতন ও অবহেলার ঝুঁকিও তাদের বেশী। প্রতিবন্ধী শিশু, মহিলা ও বৃদ্ধদের সেক্ষেত্রে বিশেষ সুরক্ষা প্রয়োজন। শিক্ষানীতি ও স্বাস্থ্যনীতিতে ইতিমধ্যে প্রতিবন্ধিতা বিষয়টি আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৯৯ সালে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন গঠিত হয় এবং বর্তমানে এ সংস্থাটি প্রতিবন্ধী জনগণের জন্য বিভিন্ন সেবামূলক কর্মসূচী চালু করেছে।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের সদস্যগণ সরকারী এবং বেসরকারী পর্যায়ে এসব জনকল্যাণমূলক কর্মসূচী সম্পর্কে জানা থাকা প্রয়োজন যাতে তারা এধনের সেবা পেতে পারেন। প্রতিবন্ধী নাগরিকের সমাজে অন্যসব নাগরিকের মত সমান অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার একটি মানবাধিকার যা সংবিধান স্বীকৃত। তাদের প্রতি সকল বৈষম্য দূরীকরণে সিআরপিডির বাস্তবায়ন জরুরী। এব্যাপারে সমাজ, রাষ্ট্র ও জনগণের সহযোগিতার হাত সম্প্রসারণ প্রয়োজন। উন্নয়নের মূলস্রোতে এ বিশাল জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করা গেলে তারা জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবেন।