Published : 26 Feb 2018, 05:55 PM
কিছুদিন আগে হঠাৎ একটি খবরে আমরা চমকে উঠেছিলাম। এমনিতেই চমকে দেওয়ার সমাজ আমাদের। পিলে চমকানোর মতো খবরেও ভড়কে যাই না আমরা। সে পিলেকেও চমকে দিয়ে জানা গেল, সোহেল রানার জামিন হয়েছে! কৈশোরে মন কেড়ে নেওয়া মাসুদ রানা বা ছায়াছবির নায়ক সোহেল রানার চেয়েও চমকপ্রদ ঘটনার জন্ম দেওয়া এই সোহেল রানার জামিন হতে পারে সেটা ভাবাও দুঃস্বপ্ন। তবু সেটাই হয়েছিল। যদিও সে জামিন আবার বাতিল হয়ে গিয়েছে।
বড় অদ্ভূত দেশ আমাদের। একজন মানুষ মারার জন্য শাস্তি হলেও হাজার মানুষ মারার শাস্তি হয় না। সেটা মুক্তিযুদ্ধের বেলায়ও দেখেছি। লাখো মানুষের হত্যা ও লুষ্ঠনের মতো অপরাধও চল্লিশ বছর ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে। যখন তার বিচার শুরু হল তখন পাল্টে যাওয়া সময় আর পরিস্থিতি পুরো ব্যাপারটাকেই ধোঁয়াশা আর অস্থির করে ফেলল। এত বড় ঘটনার যদি এই হাল হয়, সে সমাজে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার বিচার প্রলম্বিত হবার মানে কি বলে দিতে হবে?
ওই দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া মানুষরা কেউই সমাজের বিখ্যাত বা পরিচিত শ্রেণির ছিলেন না। তারা অতিসাধারণ ও নগণ্য। কবির ভাষায়, মূলত 'সেলাই দিদিমনি' গোছের মানুষ। এদের জন্মই আজন্ম পাপ। আমাদের সমাজজীবন, রাষ্ট্র এদের কাছে ঋণী হবার পরও কেবল নিতেই জানে, দিতে রাজি নয়। কত বড় বড় কথা, কত গবেষণা, কত লেখালেখি– কিন্তু প্রান্তিক মানুষরা যে তিমিরে সে তিমিরেই।
এরা তখনই শিরোনাম যখন তাদের কপালে কোনো দুর্ভোগ বা বিপর্যয় নেমে আসে। তখন দুনিয়াজুড়ে শিরোনাম হয়ে ওঠা মানুষগুলো দেশের মানুষের বিবেক আর সরকার বা পাওয়ারের নজর কেড়ে নেয়। মানবাধিকার নামের এক অদ্ভূত পরিহাস হেসে ওঠে খিল খিল করে। মনে হতে থাকে, এই এখনই বুঝি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। চারদিকে এত হৈ চৈ, ধুন্ধুমার প্রচার, রাতজাগা মিডিয়াকর্মীর ধারা-বর্ণনার ভেতর দিয়ে নতুনভাবে কেঁপে ওঠে বাংলাদেশ।
একদিকে নিজেদের ভেতর রাগ, ক্রোধ, বিচারের দাবি– অন্যদিকে বিদেশিদের সামলানো– সব মিলিয়ে আরেক নাটক। এই নাটকের ফাঁকে কখন যে সোহেল রানা উধাও কেউ জানে না। গরীবের রক্ত মাটিতে দাগ ফেলার আগেই ভেগে যায় তারা। জনরোষে ফিরে এলে তার সে আগমনও ভিআইপি গোছের। বাসে নয়, ট্রেনে নয়, এমনকি মটর গাড়িতেও নয়– সোহেল রানা আসে আকাশযানে, হেলিকপ্টারে উড়ে!
দুনিয়ায় বাংলাদেশের পরিচিতি নানা ধরনের। এককালে বন্যা, ঝড়, প্রাকৃতিক দূর্যোগের দেশ হিসেবে আমরা ছিলাম শীর্ষে। শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে সে দূর্নাম কমিয়ে আনার পর আমাদের রেকর্ড বাঁক নিল দূর্নীতি, দুঃশাসনে। সে কী প্রতিযোগিতা! এক নম্বরের নিচে নামতেই চাইনি আমরা।
সে দুর্নামও ঘোচাল জনগণ। তাদের কঠিন পরিশ্রম, মেধা আর নিষ্ঠায় বাংলাদেশ উপরে উঠতে শুরু করল। বিদেশিদের দৃষ্টিভঙ্গী কথার মারপ্যাঁচ দিয়ে বদলানো যায় না। আজকের দুনিয়ায় আমরা যাদের সার্থক ও প্রতিষ্ঠিত জাতি হিসেবে দেখছি তাদের জীবনে কথার চেয়ে কাজের গুরুত্ব অনেক বেশি। এদের রাজনীতি কথায় বিশ্বাস করে না। তারা চায় প্রমাণ। বিশেষত অর্থনৈতিক স্বার্থ বা লেনদেনের বেলায় কাজে না এলে এরা পাতে নেবে না।
এ কাজটি আমাদের রাজনীতি করতে পারেনি, পারবেও না। করে দেখিয়েছে সে মানুষরা যাদের জীবন মানেই সংগ্রাম আর শ্রমের উদাহরণ। এদের কারণে উজ্জ্বল হয়ে ওঠা বিশ্ব ইমেজটিও কিন্তু ঠিক জায়গায় রাখতে পারা গেল না।
আমি যখন অষ্ট্রেলিয়ায় আসি, বাংলাদেশ চেনানো ছিল রীতিমতো কঠিন। সাধারণ মানুষ মাত্রই ভাবতেন, বাংলাদেশ মানে ইন্ডিয়া। কারও কারও মতে– বাংলাদেশ, ওহ ইন্ডিয়ার পাশে তো? রাগে গা জ্বললেও বোঝাতে পারতাম না। সে বাস্তবতা আজ অতীত। কার কল্যাণে?
সেলাই দিদিমনি নামে পরিচিত আমাদের গার্মেন্টস কর্মীরা আর ক্রিকেটাররাই সেই ভ্রান্তি ঘুচিয়ে দিয়েছেন। ক্রিকেট তো সিজনাল। বছরে এক কী দুবার। পোশাক তো মৌলিক চাহিদা। তার প্রয়োজন প্রতিদিন প্রতি মূহূর্তে। আধুনিক নামে পরিচিত স্বচ্ছল দেশের মানুষ এক কাপড়ে সন্তুষ্ট থাকার নয়। তার ঘর উপচে-পড়া পোশাক।
প্রতিদিন নতুন পোশাকের দেশে সহজ মূল্যে তৈরি পোশাক তুলে দিয়ে পরিচয়ের নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে আমাদের পরিশ্রমী পোশাক-শিল্পীরা। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এদের রক্ত আর শ্রমে গড়ে উঠেছে আরেক বাংলাদেশ। আজকাল সিডনি বা এদেশের যে কোনো শহরে 'মেইড ইন বাংলাদেশ' একটি জনপ্রিয় ব্র্যান্ড। সেই ব্র্যান্ড বা পরিচয়সূত্রকেও রক্তে ভাসিয়ে দিতে দ্বিধা করেনি রক্তখেকো সোহেল রানার দল।
সে এক বীভৎস হত্যাকাণ্ড! দরিদ্র পোশাক শিল্পীদের এভাবে হত্যা করার রেকর্ড দুনিয়ায় বিরল। হাজার হাজার নিরীহ সাধারণ কর্মীকে পতন নিশ্চিত রানা প্লাজা নামের এক খাঁচায় ঢুকিয়ে তালা মেরে তামশা দেখার ঘটনা যে ট্র্যাজিডিতে পরিণত হবে টের পায়নি কেউ। যখন পেল তখন ঘটনা অনেকদূর গড়িয়ে গেছে। এতদূর যে স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও খেই হারিয়ে ফেললেন।
অষ্ট্রেলিয়ান মিডিয়া লুফে নিল সেই সিরিও কমেডি। মানুষ নাড়া দিয়ে ভবন ফেলে দিতে পারে, এই অভিনব তত্ত্বে মজা পাওয়া বিদেশি মিডিয়া একদিকে যেমন বিনোদনের খোরাক পেল, অন্যদিকে রক্তস্নাত এই পোশাক শিল্পকে এড়িয়ে চলার প্রস্তাবও রাখল তারা। কী বিপদ! কষ্টে-শ্রমে গড়ে ওঠা আমাদের এই বাণিজ্য-সম্ভাবনা নষ্ট হবার র্দুভাবনায় অর্থনীতি যখন আতঙ্কে, রাজনীতি তখনও হিতাহিত হারিয়ে বেপরোয়া।
প্রবাসে আমরা তার প্রমাণ পেলাম বিএনপি ও জামায়াতিদের কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণে। রানা প্লাজার যাবতীয় দায়-দায়িত্ব আওয়ামী লীগের কাঁধে চাপিয়ে তারা বিদেশিদের বোঝাতে চাইল, এটা সরকারের ব্যর্থতা বা দায়িত্বহীনতা, তাই এই সরকারের আমলে সমস্ত বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখার আন্দোলনের নামে দেশবিরোধী অপপ্রচারে নামল তারা।
অন্যদিকে সরকারি দলেও দেখলাম অযথা পানি ঘোলা করার অপপ্রয়াস। তারা মিডিয়া জুড়ে এমন সব কাণ্ড-কারখানা করলেন যাতে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হতে শুরু করল। যার সর্বশেষ সংস্করণ ছিল দীর্ঘ দিন পর উদ্ধার হওয়া সে নারী শ্রমিক। তাকে মিডিয়ার সামনে হাজির করা, বিদেশ পাঠানো এসব কর্মকাণ্ডে আসল কাজ ক্রমেই পিছূ সরতে শুরু করল।
আজ যখন এ লেখা লিখছি বিভিন্ন ধরনের অনুদান আর প্রতিশ্রুতির ভিড়ে বিচারপর্ব প্রায় চাপাই পড়ে আছে। কেউ জানে না আসলে কী হবে। আর কোনোদিন যে এমন কোনো ট্র্যাজিডি ঘটবে না তেমন নিশ্চয়তার চিহ্ন নেই, নেই কোনো উদ্যোগ।
দেশের পাশাপাশি বিদেশে আমাদের পোশাক শিল্পের ভাবমূর্তি ও তাকে নিয়ে যে ষড়যন্ত্র সে বিষয়ে ও আমরা নিশ্চুপ। কোটি কোটি টাকা খরচ করে আমাদের দূতাবাসগুলোকে চালু রাখা হয়। এগুলোর কাজকর্ম প্রায়ই গতানুগতিক। মাসে মাসে বা বছরে কিছু নির্দিষ্ট অনুষ্ঠান আয়োজনের বাইরে এরা নিয়মমাফিক কাজ করে যায়, যা করলে যা না করলেও তা। দু একটি দেশ বা কয়েকজন দূতের কথা আলাদা। বাকিদের এ বিষয়ে দায়িত্ব দেওয়া উচিত হলেও সরকার গা করেনি। অথচ এদের মাধ্যমে অপপ্রচার বন্ধের পাশাপাশি আমাদের তৈরি শিল্পের গায়ে লাগা আঁচড়ের দাগ কিছুটা হলেও দূর করা যেত। কিছুই পরিকল্পনামাফিক হয় না, কোনোদিন হয়ওনি– শুধু কথা, প্রতিশ্রুতি আর প্রচার।
রানা প্লাজা দূর্ঘটনার এক বছর হল। হায়রে সময়, যে ঘটনা টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া কাঁপিয়ে দিয়েছিল, মানুষের চোখ ভিজিয়ে বুক হিম করে তুলেছিল, যে অপমান আমাদের মাথা হেঁট করে দিয়েছিল– অতবড় ঘটনাও আমরা সেভাবে মনে রাখিনি। রাখলেও আজ আর তা নিয়ে সে মাতম বা আক্রোশ নেই। রাজনীতি চতুর। তারা জানে সময় দিলে তপ্ত লৌহখণ্ডও শীতল হয়ে যায়। ওই যে বলছিলাম, রানাকে মানুষ ফায়ারিং স্কোয়াডে দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল যাকে পেলে জ্যান্ত পুঁতে ফেলতেও দ্বিধা করত না– আজ আমরা তার আগাম জামিনের খবরেও পাশ ফিরে শুই।
শুধু সে মানুষগুলোর হাহাকার আর তাদের স্বজনদের আহাজারি থামেনি, থামেনি লাশ হয়ে ফেরা মানুষের আত্মীয়দের কান্নার রোল। উদ্ধারপর্বে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও আলিঙ্গনবিচ্যুত না হওয়া সে যুগল দুনিয়াকে জানিয়ে দিয়ে গেছে, মানুষ মরে ভালোবাসা মরে না। নুপুর-পরা সে আলতা-মাখানো পায়ের কথা ভুলিনি আমরা। ব্যর্থতার বুকে পদচিহ্ণ এঁকে দেওয়া সে পা আমাদের বলে গিয়েছিল এটাই তোমাদের পুরস্কার।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প নিয়ে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র, দেশি-বিদেশি প্রতিবেশিদের বদনজর কোনো কথার কথা নয়। এছাড়াও আছে সস্তায় টাকা কামানোর জঘন্য খায়েশ। যে শিল্প আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান উৎস, যা নিয়ে আমরা মাথা উঁচু করে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে পারি, তার প্রতি এত অবহেলা আর রানার মতো মানুষদের দৌরাত্ম্য সত্যি আশ্চর্যের!
অধরচন্দ্র বিদ্যালয়ে নিশ্চয়ই ক্লাশ বসে। নতুন নতুন বাচ্চারা স্কুলে যায়। প্রভাতে সারিবদ্ধ হয়ে গায় "আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি"। তারা কি জানে এই স্কুলের মাঠেই রাখা হয়েছিল সারি সারি মানুষের লাশ। রাষ্ট্রের সবচেয়ে নিরীহ নাগরিক ছিলেন তারা। শ্রম ও শক্তি দিয়ে জীবনযাপনের অপরাধে দণ্ডিত এই মানুষগুলো আমাদের যদি মাফ করে না দেয় আমরা কোনোদিনও এগুতে পারব না। সে জন্যেই এর উচিত বিচার হতে হবে। এই দীর্ঘশ্বাস ও অভিশাপ দেশে-বিদেশে আমাদের ক্রমাগত ছোট ও নিঃশেষ করে দেওয়ার আগেই যেন তা হয়।
রানা প্লাজা দুর্ঘটনার বিচার ও দোষীদের শাস্তি প্রবাসীদের মনেও শান্তি বয়ে আনবে। এমনকি যারা আমাদের দেশের কেউ নয়, অথচ আমাদের ভালোবাসে তাদের আস্থার জন্যও এ কাজ জরুরি। বাংলাদেশ শেষাব্দি কোনো অন্যায় বা রক্তপাতকে ছাড় দেয় না, এটাই ইতিহাস। এ বেলায়ও তার অন্যথা হবে বলে মনে হয় না।
সিডনি
২৪ এপ্রিল, ২০১৪
অজয় দাশগুপ্ত: লেখক।