Published : 27 Oct 2010, 10:08 PM
বাংলাদেশের বিডিনিউজ ও প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে যখন রূপগঞ্জের সেনাক্যাম্পের আগুনের ছবি ও খবর প্রকাশিত হয়েছিলো তখন কোলকাতার তারা টিভির রোহিত বসু আমার ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস লিখেন-সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম এবং রূপগঞ্জ। রোহিত বসুকে আমি তারা টিভিতে দুটি অনুষ্ঠান করতে কলিকাতায় গিয়ে চিনেছিলাম। রোহিত বসুরা পূর্ব বাংলার মানুষ। অর্থাৎ পূর্ব বাংলা তার আদি নিবাস। সাতচল্লিশ তাকে দেশছাড়া করে ভারতের অধিবাসী বানিয়েছে। তার লেখা শুধুমাত্র এই তিনটি শব্দই যথেষ্ট, আমাদের রূপগঞ্জের সাথে পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামকে এক কাতারে নিয়ে যেতে।
বাপ-দাদার ভিটেয় থাকতে পারেননি বলেই তিনি হয়তো অনুভব করেছেন, এই ভূখন্ডের মানুষ বাপ-দাদার ভিটে মাটির প্রতি কতোটা গভীর টান নিয়ে বেচে থাকে। অথচ আমাদের পাশের দেশের সিঙ্গুর আর নন্দীগ্রামের কাহিনীটা আমাদের শাসকদের কারও কারও বা আমাদের সেনাবাহিনীর কিছু লোকের কেন পড়া হলোনা- সেটিই আমি বুঝতে পারিনি। গল্পটা অনেক বড় তবে এর সারমর্মটা খুব ছোট। পশ্চিমবঙ্গের এই অঞ্চলে ভারতখ্যাত টাটা তাদের অতি আলোচিত ন্যানো গাড়ীর কারখানা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলো। এজন্য তাদের প্রয়োজন ছিলো প্রচুর জমি। পশ্চিমবঙ্গ সরকারও সেটি চেয়েছিলো। কিন্তু মানুষ তা চায়নি। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান; কোন প্রলোভনই তাদেরকে বাপ-দাদার ভিটে ছাড়তে উৎসাহিত করেনি। বরং তারা রুখে দাড়িয়েছে। ক্ষমতাসীন সিপিএম এজন্য উগ্র বাম ও তৃণমূলকে দায়ী করেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, রক্তপাতের মধ্য দিয়ে টাটা সেখান থেকে বিদায় নিয়েছে এবং সম্ভবত সিঙ্গুর আর নন্দীগ্রামই পশ্চিমবঙ্গের বাম জোটকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নেবার মতো অবস্থায় দাড় করিয়েছে।
বাংলাদেশেও জমি জমা নিয়ে ছোট খাটো ঘটনা কম ঘটেনি। জোট আমলে সাভারে লুৎফুজ্জামান বাবরের আত্মীয়রা ভূমিদস্যুতা করতে গেলে ঐ এলাকার মানুষ রুখে দাড়ায় ও প্রতিহত করে। কেরানীগঞ্জে জমি নিয়ে বিরোধ অহরহ হচ্ছে। ঢাকার চারপাশে এমন কোন এলাকা নেই যেখানে জমি নিয়ে ঝামেলা নেই। দিনাজপুরে কয়লা খনির মূল সংকট ভূমি নিয়ে। ত্রিশালের মানুষ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর চায় না- কারণ তাদের বাপ-দাদার ভিটা মাটি ছাড়তে হবে। দেশের যে কোন জায়গাতেই ভূমি খুবই সংবেদনশীল একটি বিষয়। বাংলাদেশের মানুষ এই গ্রহের যেকোন প্রান্তে আবাস স্থাপন করছে বলেই তার বাপ-দাদার ভিটার প্রতি মায়া ছাড়তে পেরেছে, এমনতো নয়। ঈদের সময় লক্ষ লক্ষ লোক যে অমানবিক কষ্ট করে ঘরে ফেরে সেটিতো বাপ-দাদার ভিটার মাটি স্পর্শ করার জন্য।
রূপগঞ্জের খবর পড়ে ও টিভিতে ঐ এলাকার মানুষের কথা শুনে আমার কাছে মনে হয়েছে, ভূমির প্রতি মানুষের যে সহজাত ও আজন্ম দরদ, মাটির সাথে মিশে থাকার তার যে আকুলতা, ভূমিহীন হবার যে শঙ্কা; সেটি কেউ বিবেচনায় না এনেই রূপগঞ্জে সেনাবাহিনীর আবাসিক এলাকা স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। উপরন্তু, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে, তারা সাধারণ মানুষের অধিকার হরণের মধ্য দিয়ে শক্তি প্রয়োগ করেছে এবং ক্ষমতার-উর্দির দাপট দেখিয়েছে।
কিছুদিন আগে আমি টঙ্গী-কালিগঞ্জ সড়ক থেকে ভুলতা-মদনপুর পর্যন্ত বিস্তৃত ঢাকা বাইপাস দিয়ে গিয়েছিলাম। রাস্তার বা পাশে তাকিয়ে আমার কান্না পেয়েছে। এমন কান্না অবশ্য আমার প্রায়ই পায়। সেদিন বছিলা দিয়ে বুড়িগঙ্গা সেতু পার হয়েও তেমন কান্নাই পেয়েছিলো। কারণ আমি নিজ চোখে দেখছিলাম মাত্র কয়েক বছরের মাথায় সবুজ গ্রাম ও বিস্তীর্ণ প্রান্তর; সবকিছু ইট-পাথরের গাথুনিতে রূপান্তরিত হয়ে যাবে। ঢাকা বাইপাশে বর্ষার পানিতে মাইলের পর মাইল জুড়ে কেবল আবাসিক এলাকার সাইনবোর্ড। এককালে আশুলিয়া-মিরপুর বাধের বাম পাশে বিশাল জলাশয় ছিলো। সেখানে পুরো পথের মাঝে এখন শুধু এক টুকরো জলাশয় ছাড়া পুরোটা বালুভূমি।
রূপগঞ্জের ঐ এলাকাটারও সেই পরিণতি হবে। পূর্বাচল ও বেসরকারী হাউজিং গিলে খাবে সবুজ। কেরানীগঞ্জে বুড়িগঙ্গার পাড়ে, ঢাকা-মাওয়া সড়কে বা দেশের অন্যসব সড়কের ধারে সেই একই দৃশ্য। ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ বা ঢাকা-আরিচা সড়কগুলোর পাশে গ্রাম নেই- জমি নেই-সবুজ নেই। পাম্প, সিএনজি, কারখানা এসব ছাড়া সাধারণ মানুষ নেই কোথাও। এসব এলাকার মানুষ জমির দাম বেশি পেয়ে রাস্তার পাশের জমি বেচে ভেতরে যায় এবং কম দামে জমি কেনে বা জমি বেচার টাকায় জীবন ধারণ করে ভূমিহীনে পরিণত হয়। অর্থবান-ক্ষমতাবান মানুষরা তাদের জমি কেনে বা কেনার নামে দখল করে।
কদাচিৎ মানুষ তার প্রতিবাদ করে- প্রতিবাদ করতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে তেমনই প্রতিবাদ হয়েছে। রূপগঞ্জের ঘটনাটিকেও তেমনই এক প্রতিবাদ হিসেবে দেখতে হবে। এর মাঝে উস্কানি বা রাজনীতি থাকতে পারে। কিন্তু শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রেক্ষিত বা উস্কানিতে এতোবড় কিংবা এমন বিশাল ঘটনা ঘটেছে এমনটি মনে করা মুর্খতা ছাড়া আর কিছু নয়। আমাদেরকে অনুভব করতে হবে, ভূমি দস্যুরা নানা নামে নানা পদ্ধতিতে অবিরাম ভূমি দস্যুতা করছে। দুর্ভাগ্যক্রমে রূপগঞ্জে সেনাবাহিনী এই একই ধরনের কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েছিলো বলে অভিযোগ ওঠেছে। শরীরে শক্তির পোশাক থাকলেই সেই পোশাক জনগণকে দেখাতেই হবে, এমনটি ঠিক নয়। সেনাবাহিনীর নামে ৪০ লাখ টাকার জমি ১৬ লাখ টাকায়, কাউকে জমি রেজিষ্ট্রি করতে না দেয়ায় বা সেনাবাহিনীর জন্য জমি কিনতে ৪টি সেনা ক্যাম্প স্থাপন করায় রূপগঞ্জের মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। ২৫ অক্টোবরে পত্রিকার খবরে দেখলাম, এটি এমনকি সেই এলাকার সংসদ সদস্য নিজেও উপলব্ধি করেন এবং সেনাবাহিনীর আবাসিক প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে লিখিত পত্রও লেখেন। আমি সেই কারণে সংসদ সদস্য গাজী গোলাম দস্তগীরকে ধন্যবাদ দিই। যদিও তিনি কেবল চিঠি লিখে বসে না থেকে ঘটনার সময় এলাকায় থেকে সাধারণ মানুষের সাথে সময় দিলে হয়তো সেদিনের চিত্রটা ভিন্ন হতে পারতো। অন্যদিকে আমি ভীষণভাবে অবাক হয়েছি যে, আওয়ামী লীগের একজন নেতা একে নিছক একটি রাজনৈতিক কারণ বলে বিরোধী দলের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে দিয়েছেন। আমি ঠিক জানিনা, যিনি এই কাজটি করেছেন তিনি সত্যি সত্যি রাজনীতি বোঝেন কিনা।
তবে প্রশ্নটি উঠছে সেনাবাহিনী নিয়ে। সেনাবাহিনীর সৈনিকেরা দেশের জন্য কাজ করে এবং সেজন্য পুরো দেশের মানুষ তাদেরকে দেশের সম্পদ বলেই বিবেচনা করে। কিন্তু যখনই সেনাবাহিনী তার নিজের স্বার্থে বা ক্ষমতা দখলে সহায়ক হয়-যেমনটা সেনাবাহিনী জিয়াকে ক্ষমতায় আনা ও রাখার জন্য সহায়ক হয়েছে; যেমনটা সেনাবাহিনীর একটি অংশ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকে সহায়তা করেছে; যেমনটা সেনাবাহিনীর একটি অংশ এরশাদকে ক্ষমতাসীন করা ও তাকে ক্ষমতায় রাখার জন্য কাজ করেছে; কিংবা যখনই সেনাবাহিনী সাম্প্রতিক জরুরী অবস্থা চলাকালে রাজনীতিতে নাক গলাতে শুরু করেছিলো; তখনই সেনাবাহিনী বিতর্কিত হয়েছে। সেনাবাহিনীর নীতি নির্ধারকরা আশা করি এটি অনুভব করেন যে, তেমন সময়ে দেশের মানুষ তাদের পাশে না থেকে প্রতিপক্ষ হয়ে যায়।
এবারও প্রায় একইভাবে সেনাবাহিনী তাদের ব্যক্তি স্বার্থে বেসরকারী একটি আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সেনাবাহিনীকে যেভাবে ব্যবহার করেছে সেটি তারা করতে পারে কিনা সেটি সেনাবাহিনীর নিজস্ব আইনের আলোকেও তদন্ত করে দেখতে হবে। প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনীর দেশ রক্ষার কাজ করার কথা। কেবলমাত্র দেশের স্বার্থেই কোথাও সেনা ক্যাম্প স্থাপিত হবার কথা। এজন্য সরকারের অনুমতি গ্রহণ করার কথা। আমি জানিনা, রূপগঞ্জে সেনা ক্যাম্প স্থাপনে সরকারের অনুমতি দেয়া হয়েছিলো কিনা বা আবাসিক প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সেনা ক্যাম্প স্থাপনের অনুমতি দেয়া হয়েছিলো কেন? কেন সেনাবাহিনীর পোশাক পরা লোকেরা সাবরেজিস্ট্রি অফিসে বসে থেকে জমি রেজিস্ট্রি ঠেকিয়েছে সেটিও আমার মাথায় যুক্তি হিসেবে প্রবেশ করেনা। সেনাবাহিনী বলেই আইন অনুসারে এমনভাবে জমি নিবন্ধন করার কাজে বাধা দেবার, জবরদস্তি জমি কেনার, কম দামে জমি বেচতে বাধ্য করার বা জমি কেনার জন্য ক্যাম্প স্থাপন করার বিধান রয়েছে কিনা সেটি দেশের মানুষের জানার অধিকার আছে। যদি এইসব কাজ আইনানুসারেও হয়ে থাকে তবে সেই আইনটি সঠিক নয়-তেমন আইন বদলানো দরকার। সেনাবাহিনীকে সাবরেজিস্ট্রি অফিস পাহারা দেবার জন্য নিয়োগ করা; একটি স্বাধীন দেশের সেনাবাহিনীর কাজ হতে পারেনা। আসুন রূপগঞ্জের মানুষের মতো আমরাও এর প্রতিবাদ করি।
আমাদের সেনাবাহিনীর অসাধারণ কৃতিত্ব আছে বিশ্বজুড়ে সুনাম অর্জন করার। সিয়েরালিওনে তারা সড়ক নির্মাণ করে বাংলাকে সেই দেশের রাষ্ট্র ভাষা করার দাবী তুলে অসাধারণ দেশেপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বিশ্বজুড়ে শান্তিরক্ষী বাহিনীতে তাদের ভূমিকা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। কিন্তু পাকিস্তান আমল থেকেই বিশেষত পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিজে দেশের জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নেবার যে প্রথা চালু করেছিলো সেটিতো এখনকার গণতান্ত্রিক পরিবেশে স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর রেওয়াজ হতে পারেনা। আমি ভাবতেই পারিনা যে, সেনাবাহিনীর পোশাক পরা বাংলাদেশের কোন সৈনিক রূপগঞ্জ সাবরেজিস্ট্রি অফিসে বসে সাধারণ মানুষকে তার নিজের জমি, তার স্বাধীনতা অনুসারে রেজিস্ট্রি করতে দিচ্ছেনা। যাদের পরামর্শে সেনাবাহিনী এমন কাজ করেছে তাদের গোত্র পরিচয় দেশবাসীর জানা উচিত।
সেনাবাহিনীর অতি উৎসাহী কিছু লোক বরাবরই এমন কিছু কাজ করে যা করার কোন প্রয়োজন নেই। আমি স্মরণ করতে পারি, এরশাদ-জিয়ার সামরিক শাসনের পর রাস্তায় কেউ লম্বা চুল নিয়ে বেরোলে বা কোন মহিলার বোরকা না থাকলে তখনকার সেনাবাহিনী ছেলেদের মাথা ন্যাড়া করে দিতো আর মেয়েদের পেটে আলকাতরা দিয়ে দিতো। এজন্য তারা আইন কানুন বা ব্যক্তি স্বাধীনতার কোন বিষয় বিবেচনা করতো না। জরুরী অবস্থা চলাকালে বাংলাদেশ বিমানে কর্মরত একজন সামরিক কর্মকর্তাকে বলা হয়েছিলো, আপনি যে আমাকে টাকা পরিশোধ করতে বলছেন, সেই বিষয়টিতো হাইকোর্টে বিচারাধীন আছে। তিনি আমার সামনেই মন্তব্য করেছিলেন-হাইকোর্টতো আমি-ই। আমাদের সেনাবাহিনী আমাদের জাতীয় বাহিনী এবং আমাদেরই সন্তান। ফলে তাদের আচার আচরণ হবে এই জাতির সুসন্তানের মতো। তারা ঔপনিবেশিক বাহিনী বা দখলদার বাহিনীর মতো আচরণ করলে সেটি অন্তত গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে গ্রহণযোগ্য হবেনা। সামরিক শাসনকালেও এমন আচরণ করে পরে পার পাওয়া যায়নি, পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিল হবার পর সেটি আবার প্রমাণিত হয়েছে।
আশা করি আমরা সকলেই নিজের অবস্থানকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করবো, আমার যা করা উচিত আমি তাই করবো।