Published : 03 Oct 2010, 08:37 PM
শিশু জন্ম নেয় বাঁচবার জন্য এবং তার অন্ন-বস্ত্র বাসস্থান-চিকিৎসা-শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের অধিকার পূর্নাঙ্গভাবে মেটাতে হবে। এ দায়িত্ব হলো রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারের। শিশুকে নিরাপত্তা দিতে হবে এবং আনন্দময় জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে তাকে বড় করে তুলতে হবে। অভিভাবকহীন পরিত্যাক্ত যেসব শিশু পথের ধারে ঘুমিয়ে থাকে, ডাস্টবিনের খাবার কুড়িয়ে খায়, বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পোড়ে এবং শীতে কাঁপে, সেইসব শিশুদেরও মানবাধিকার আছে। শিশু অধিকার ভোগ করতে না দেয়াটা মানবাধিকার লঙ্ঘন।
শিশু হচ্ছে সবচেয়ে অসহায়। সে যখন কথা বলতে পারে না, কিছু চাইতেও জানে না, এমনকি নিজের কষ্ট ও বেদনার কথাও প্রকাশ করতে পারে না, তখন তার প্রতি সহানুভূতি দেখানো পরিবারের বড়দের দায়িত্ব। শিশুর প্রথম শিক্ষা হয় মায়ের কাছে. তারপর পরিবারের কাছে। একজন সুমাতা পারেন সুসন্তান গড়ে তুলতে, একটি আদর্শ পরিবার পারে একটি মূল্যবোধসম্পন্ন শুদ্ধতম মানুষ তৈরি করতে। একটি সংস্কৃতিবান সমাজ এবং সুশাসনমন্ডিত রাষ্ট্র পারে একজন সুনাগরিক সৃষ্টি করতে। যে সমাজ ও রাষ্ট্র উন্নত এবং কল্যাণকামী সেই সমাজের শিশুরা যথেষ্ট দায়িত্বশীল ও দেশপ্রেমিক হিসেবে কৈশোর থেকে গড়ে ওঠে। তারুণ্যের শক্তি-মেধা-বুদ্ধিমত্তা-শ্রম দ্বারা দেশের উন্নয়নের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিতে কুণ্ঠা বোধ করে না।
উন্নত, ধনী এবং কল্যাণকামী দেশের শিশুরা বড় সৌভাগ্যবান। মায়ের গর্ভে আসার মূহুর্ত থেকেই চিকিৎসাসহ স্নেহ-যত্ন পায়, তার কোন তুলনা নেই। সঙ্গে সঙ্গে পরিবারে, সমাজ ও রাষ্ট্রের সেরা সম্পদ হিসেবে তাদের সকল অধিকার সুরক্ষিত থাকে। তাদের প্রতি নির্যাতন, অনাদর, অযত্ন হলে রাষ্ট্র ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে মা-বাবা বা অভিভাবকের বিরুদ্ধে। মা-বাবার মধ্যে দাম্পত্য দ্বন্দ্ব দেখা দিলেও শিশুটি তার সকল অধিকার নিয়ে বড় হয়ে উঠতে পারে। শিশুর প্রতি বৈষম্য ও শোষণ করাও সেখানে নিষিদ্ধ। তার মেধা ও প্রতিভা বিকাশের সুযোগ করে দেয় সমাজ এবং সরকার।
আমাদের দেশের মতনই এশিয়া-আফ্রিকার শিশুরা বড় বেশি দূর্ভাগ্য নিয়ে জন্ম নেয়। জন্ম মূহুর্তেই অধিকাংশ শিশু মৃত্যুবরণ করে, জন্মের পর নানা রোগে আক্রান্ত হয়েও মৃত্যুবরণ করে। যারা বেঁচে থাকে তাদের মধ্যে শতকরা নব্বই ভাগ শিশু অপুষ্টি-অযত্ন -অবহেলার মধ্য দিয়ে বড় হয়ে ওঠে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে দারিদ্র এবং মায়ের অপুষ্টি। এমনকি শিশুটি জন্মের পর তার খাদ্য-বস্ত্র-চিকিৎসার অর্থ জোটানো দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত পরিবারের পক্ষে সম্ভব হয় না। দেখা গেছে অপুষ্টির কারণে অনেক শিশুই স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে না। শিশু খাদ্যসহ দ্রব্যমূল্য এতো বেশি যে শিশুটি পরিমিত খাদ্য পায় না। দুধ-ডিম-ফল-ভাত-মাছ-ডাল-সব্জিসহ প্রয়োজনীয় ক্যালরি অধিকাংশ শিশুর ভাগ্যে জোটে না। অথচ এ খাদ্য গ্রহণে তার ন্যায্য অধিকার রয়েছে। তেমনি চিকিৎসা গ্রহণে ডাক্তার দেখানো, ঔষধ-পথ্য ক্রয় করাও সাধ্যে কুলোয় না।
জরুরি চিকিৎসা সেবাও শিশুটি পায় না যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। বস্ত্রের অধিকারও তার মর্যাদাহীন। শৈশব কাটে তার প্রায় উলঙ্গ অবস্থায়। কৈশোরে এসে প্যান্ট একটা পরার ব্যবস্থা হয়। একটা পাতলা গেঞ্জি হয়তো কারও কারও ভাগ্যে জোটে। শীতকালের প্রচন্ড ঠান্ডায় প্রয়োজনীয় বস্ত্র জোটে না। বাসস্থানের পরিবেশও মানবেতর। পানির অভাব, মশার যন্ত্রনা, দুর্গন্ধের মধ্যে বসবাসের কারণে রোগাক্রান্ত হয়ে থাকে। শিক্ষা গ্রহণে বিনাবেতন ও বই পুস্তকের ব্যবস্থা সরকার করলেও আনুষঙ্গিক পোষাক, খাতা – পেনসিল – পরিক্ষার ফি, যাতায়ত খরচ জোটানোর সামর্থ অধিকাংশরই থাকে না। ফলে শিশুটি স্কুলে যেতে পারে না অথবা অল্প কিছু শিক্ষালাভ করেই স্কুল যাওয়া বন্ধ করে দেয়। পূর্ণাঙ্গ শিক্ষার্জন ছাড়াই সারা জীবন বেকার অথবা মজুর হিসেবে দিন যাপন করতে হয়। উপযুক্ত জ্ঞান- প্রশিক্ষণের অভাবে শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে সবসময় সে পিছিয়ে থাকতে বাধ্য হয়।
আমাদের দেশে শিশুশ্রম আইনত নিষিদ্ধ থাকলেও শৈশব- কৈশোর থেকেই শিশুরা নানা ধরণের পেশায় জড়িত হয়ে পড়ে। এসব পেশা তার জন্য শারিরীক ও স্বাস্থ্যগত দিক দিয়ে মারাত্মক ক্ষতিকর হলেও তাকে সেই কাজ করতে হয়। কারণ হচ্ছে শিশুশ্রম অনেক সস্তা। অনেক ক্ষেত্রে শুধুমাত্র পেটের খাবার ও পরনের কাপড় দেয়া হলেও চলে যায়। দিন রাত গৃহস্থালী কাজসহ কারিগরি নানা কাজ এইসব ছোট্ট শিশুদের বাধ্য করানো অত্যন্ত অন্যায়। অনেকে এইসব শিশুদের দিয়ে মাদক বিক্রয়, যৌনবৃত্তি, ভিক্ষাবৃত্তি, ছিনতাই, চুরি ইত্যাদি নানা ধরনের অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত হতে বাধ্য করে যা অত্যন্ত ঘৃণ্যতম এবং অমানবিক। পিতৃ-মাতৃহীন শিশুদের দত্তক নেবার ব্যবস্থাও আমাদের সমাজে এখনও গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে নি।
আমাদের দেশের বৃহত্তর অবস্থানে শিশুদের চিত্রটি বড় মলিন। সামাজিক কুসংস্কার – বিধি নিষেধ- নির্যাতন, – বঞ্চনা – শোষণ ইত্যাদি নানা ধরনের বেড়াজালে সে আবদ্ধ থাকে। এর মধ্যে পুত্র শিশুদের গ্রহণযোগ্যতা ভালো, কন্যাশিশুদের ভাগ্যাহত জীবন বড় বেশি দূর্বিষহ। শৈশব থেকেই তাকে নিরাপত্তা দিতে হয় ধর্ষন অপহরণ পতিতাবৃত্তি ও পাচারের আতঙ্কে। কন্যা হবার কারণে ধর্ম ও গার্হস্থ শিক্ষা গ্রহণে বাধ্য করা হয় এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণে নিরুৎসাহী দেখানো হয়। বাল্য বিবাহ, অল্পবয়সে অধিক সন্তান প্রসব এবং সংসারের যাবতীয় কাজের কারণে সে একজন রুগ্নপ্রায় নারী হিসেবে বড় হয়ে ওঠে। তার মেধা ও প্রতিভাকে অবরুদ্ধ রাখা হয়, তার স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয়, তার মতামতকে অগ্রাহ্য করা হয় পুরুষশাসিত পরিবার ও সমাজ ব্যবস্থার কারণে।
শিশুর অধিকার রক্ষার স্বার্থে দেশে আইন আছে সত্য কিন্তু তার যথাযথ প্রয়োগ নেই। জাতিসঙ্ঘ ঘোষিত শিশু সনদও আছে কিন্তু দেশে দেশে তা বাস্তবায়নের কোনও উদ্যোগ নেই। তার শিক্ষার অধিকার, চিকিৎসার অধিকার, সম্পত্তিতে অধিকার, মায়ের কাছে থাকার অধিকার, ইত্যাদি মৌলিক অধিকার থেকে সে বঞ্চিত থেকে যায়। স্বাভাবিক সুস্থ শিশুরা যখন অবহেলার শিকার হয় তখন প্রতিবন্ধি শিশুদের অবস্থা আরও শোচনীয়। তাদের নূন্যতম পর্যায়ে সুস্থ করে তোলার কোন চিন্তা ভাবনাই নেই।
আমাদের মনে রাখতে হবে, শিশু হচ্ছে মানবসভ্যতার প্রথম অবদান। এই শিশুই একদিন বড় হয়ে তার শ্রমশক্তি ও প্রতিভার অবদানে সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, শ্রেষ্টত্বের স্বাক্ষর রাখতে পারে। সুতরাং এই শিশুকে উপযুক্ত ভাবে লালন-পালন করা সকলের দায়িত্ব, তার জীবনকে আনন্দময় – মঙ্গলময় – শান্তিময় রাখা সকলের দায়িত্ব। তার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাময় করে তুলতে হবে যেন সে স্বাধীনভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে পারে, নিজের উৎকর্ষ সাধন করতে পারে।
শিশু হচ্ছে নতুনের জয়গান, শিশু হচ্ছে ফুলের মত পবিত্র শুদ্ধময়। তার আনন্দ – খুশি – শান্তি নিশ্চিত রাখতে হবে। তার শিশুকালকে রঙিন স্বপ্নময় করে দিতে হবে। সকল মলিনতা, জীর্ণতা, প্রতিহিংসা – পঙ্কিলতা থেকে তাকে মুক্ত করে অবশ্যই তার জন্মকে সার্থক করে তুলতে হবে। তার জীবনকে আলোয় আলোয় উজ্জল করে তুলতে হবে।
কবি বলেছেন, 'এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি।' এটা তো চিরন্তন সত্য।
মধ্যযুগের আরও এক কবি বলেছেন, 'আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।' কবির এই স্বপ্ন, এই আকাক্সক্ষা বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব আমাদের বড়দের, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের।