Published : 23 Sep 2013, 08:29 PM
প্রার্থী পছন্দ না হলে মার্কা দেখে ভোট দেওয়ার কথাটা দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন দলের সভায়– তৃণমূল নেতাদের উদ্দেশে। এটাকে অনেকে ভুল করে বলছেন, তিনি জনগণের উদ্দেশে নাকি ওই উক্তি করেছেন। তবে জনগণ নৌকা মার্কা দেখে ভোট দিলে তিনি তো আর অখুশি হবেন না।
সত্তরের নির্বাচনের কথা না হয় না-ই তোলা হল; ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জনগণ কিন্তু মার্কা দেখেই ভোট দেয়। তাতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের এমন অনেকেই জিতে যান, লোকে যাদের অভিহিত করে 'কলাগাছ' বলে। সংসদের তিন-চতুর্থাংশ আসনে জিতে গেলে যা হয়!
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী ভালো করেই জানেন, ওই ঘটনার প্রায় পাঁচ বছর পর পরিস্থিতি আর তেমনটি নেই। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত হয়ে পড়েছে বলা হলে অবশ্য সরলীকরণ হয়ে যাবে। তবে সন্দেহ নেই, পরিস্থিতি এখন ভিন্ন।
আমাদের দেশে একটা সরকার যত ভালো কাজই করুক, তার পক্ষে পুনঃনির্বাচিত হয়ে আসাটা কঠিন। একবার আড্ডায় এক ভদ্রলোক গর্ব করে বলছিলেন, 'আমরা কাউকে দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে দিই না!' সঙ্গে সঙ্গে তাকে ধরে বসেছিলেন আরেকজন। তার যুক্তি– ভালো কাজ করলে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় নেবেন না কেন? ভালো কাজের পুরস্কার দেবেন না, এ কেমন কথা?
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার কতটা ভালো কাজ করেছে, তার উপযুক্ত বিচার জনগণ যেন করে আগামী নির্বাচনে। মন্দ কাজের জন্য তাদের যেন তিরস্কৃতও করে। এরই মধ্যে এমন একটি কলামে দাবি করে লিখেছিলাম, বিরোধী দলের পারফরম্যান্সও যেন বিচার করা হয়।
বেশিদিন আগের কথা নয়– তারাও তো দুর্ভাগা এ দেশটি পরিচালনা করে গেছেন। সে অভিজ্ঞতা ভুলে যাওয়া কি ঠিক হবে? রাজনৈতিক দলগুলোর নীতি-কৌশলে কী ধরনের পরিবর্তন আসছে, আদৌ কোনো পরিবর্তন আসছে কিনা, ভুল বা ব্যর্থতা থেকে তারা কোনো শিক্ষা নিচ্ছেন কিনা– বিচার করে দেখা দরকার এসবও।
এর ভিত্তিতে ভোটদানে বিরত থাকা বা 'না' ভোট দেওয়ার সুযোগ থাকলে সেটিও গ্রহণ করতে পারেন ভোটাররা। ক্ষমতাপ্রত্যাশী দুই দলের ওপরই ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে এক সেলিব্রেটি সেদিন ঘরোয়া বৈঠকে বলছিলেন, ভোটকেন্দ্রে গিয়ে এবার তিনি ব্যালট পেপার ছিঁড়ে বাক্সে ভরে দিয়ে আসবেন।
কী সাংঘাতিক কথা! এমন কাজ তিনি করবেন বলে ঠিক বিশ্বাস হয় না। তবে কথাটি যে বললেন, তাতে চিন্তিত হতে হয়। আমরা কিছু বিচ্ছিন্ন লোক চিন্তিত হলেই-বা কী! ক্ষমতাপ্রত্যাশীরা তো আর হচ্ছেন না।
বর্তমানে বিরোধীরা দেখি ধরেই নিয়েছেন, ক্ষমতায় ফিরে আসছেন তারা। আর ক্ষমতাসীনরা বলছেন, এত উন্নয়নকাজের কারণে জনগণ তাদের হতাশ করবে না। বলছেন বটে; মনে হয় না বিশ্বাস করছেন। বিশ্বাস হারিয়ে ফেললেও ক্ষতি নেই– পাঁচটা বছর দাঁতে দাঁত চেপে অপেক্ষা করলে আবার তো তাদেরই পালা!
এসব এখনও কিছুটা হাইপোথেটিক্যাল শোনাবে– যেহেতু কী ধরনের নির্বাচন হতে যাচ্ছে, তা নিশ্চিত নয়। বিরোধী নেত্রী সম্প্রতি এক জনসভায় বললেন, ভোটই তো হবে না! তিনি বোঝাতে চেয়েছেন একতরফা নির্বাচন হতে না দেওয়ার কথা। এদিকে প্রধানমন্ত্রী বলে চলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী যে নির্বাচন আয়োজন করতে যাচ্ছেন, তা ঠেকানোর সাধ্য কারও নেই।
ক্ষমতাসীনদের মধ্য থেকে এমনটিও বলা হচ্ছে, বিএনপিসহ বিরোধীরা শেষ পর্যন্ত এ নির্বাচনে যাবে। কেউ কেউ আবার বলছেন, মানুষকে অবাক করে দিয়ে বিরোধী নেত্রী তেমন সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলেও ক্ষতি নেই– নির্বাচনে জয়ী হবেন তিনি। সরকার নাকি এতটাই অজনপ্রিয় হয়ে পড়েছে!
সামনে যারা সংঘাত ছাড়া কিছু দেখতে পাচ্ছেন না, তারা অবশ্য মনে করেন– বিএনপি রাজপথে কিছু করে দেখাতে পারলে একতরফা নির্বাচন আয়োজনের বদলে ঠিকই তাদের দাবি মেনে নেবে সরকার। একা তেমন কিছু করতে না পারলেও বিএনপির সঙ্গে যদি থাকে জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলাম, তাহলে তারা কিন্তু কম শক্তিশালী আন্দোলন রচনায় সমর্থ হবেন না।
এ দেশে আন্দোলনের একটা চেহারা দেখতেই আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি অবশ্য; সেটি হল অরাজকতা। শান্তিপূর্ণ বা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন বলে কিছু নেই আর। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামেও এর চর্চা ছিল। স্বাধীন দেশে গণতান্ত্রিক শাসনামলেও ক্রমে উধাও হয়েছে এটি।
রাজনৈতিক দল তো বটেই, পেশাজীবী সংগঠন বা গ্রুপগুলোও দাবি আদায়ে অরাজকতায় জড়িয়ে পড়েছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধহীনতার সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের একটি বড় অংশকেও কীভাবে গ্রাস করে ফেলেছে, তার নজিরও দেখছি আমরা।
যাহোক, সরকারের মেয়াদ পূর্তি সামনে রেখে বিশেষত প্রধানমন্ত্রী এক ধরনের নির্বাচনী প্রচারণাই শুরু করে দিয়েছেন এর মধ্যে। রাষ্ট্রীয় অর্থব্যয়ে এটি তিনি করছেন কিনা, সে প্রশ্ন তোলার নৈতিক অধিকার অবশ্য বিএনপির নেই। ক্ষমতায় থাকাকালে তারাও একই কাজ করেছিলেন। তবে প্রশ্নটা তোলা উচিত এবং তার সদুত্তরও পেতে হবে।
এর চেয়ে গুরুতর প্রশ্ন অবশ্য রয়েছে যে, সংসদ বহাল রেখেই সরকার নির্বাচন করতে চায় কিনা। নাকি এটা দরকষাকষির জন্যই বলা হয়েছে? অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে বিরোধী দল বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে মেনে নিলেই নাকি তারা সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন আয়োজনে উদ্যোগী হবেন।
বিএনপি অবশ্য বলছে, দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চায় নির্বাচনের সময়। কীসের ভিত্তিতে তারা '৯০ শতাংশ' মানুষের মনোভাব বুঝে ফেললেন, সেটি কিন্তু বলছেন না। আওয়ামী লীগ ও তার সঙ্গীসাথীদের সমর্থকের একটা বড় অংশও কি তাহলে বিরোধী দলের দাবি সমর্থন করছে? তা না হলে তো ৯০ শতাংশ হয় না।
আমাদের প্রথম সারির রাজনীতিকরাও এভাবে কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। কে তাদের চ্যালেঞ্জ করবে? সরকারপক্ষের লোকজনও এমনভাবে বলছেন, সারা দেশের মানুষই যেন বিগত সেনাসমর্থিত সরকারের কর্মকাণ্ড তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাটির ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছে। সত্য যে এ দুইয়ের মাঝখানেও অবস্থান করতে পারে– কোনো পক্ষের বক্তব্য শুনেই তা মনে হচ্ছে না।
এ পরিস্থিতিতে প্রার্থী পছন্দ না হলে মার্কা দেখে ভোট দেওয়া বা এর পক্ষে কাজ করার যে আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী– সুশীল সমাজে সক্রিয় এক ব্যক্তি তার সমালোচনা করেছেন একটি সেমিনারে। তিনি বলেছেন, নেতানেত্রীরা মার্কায় ভোট চাইলেও জনগণ এখন আর অত বোকা নয়। প্রার্থী যোগ্য কিনা, সেটিও নাকি দেখতে চাইবেন তারা।
সর্বসাধারণের ওপর এতটা ভরসা রাখা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। জনগণের একটা বিরাট অংশ আগামী নির্বাচনেও মার্কা দেখেই ভোট দেবে। 'দলকানা' না বলে তাদের বলা যেতে পারে অনুগত ভোটার। দুই পক্ষে বিভক্ত হয়ে তারা নিষ্ঠার সঙ্গে পছন্দের মার্কায় ভোট দিয়ে যাচ্ছেন পাঁচ-সাত বছর পরপর।
মধ্যবর্তী বা 'সুইং' ভোটাররাই কেবল একবার এদিকে, অন্যবার ওদিকে ঝুঁকে পড়ছেন। সমস্যা হল, তারাও মার্কাটা দেখছেন বেশি করে। তা না হলে ড. কামাল হোসেনের মতো প্রার্থী কেন শোচনীয়ভাবে হেরে যাবেন খোদ রাজধানী থেকে? কোনো বড় দলের সমর্থন ছাড়া দাঁড়ালে ড. মুহাম্মদ ইউনূসেরও একই পরিণতি হতে পারে।
প্রভাবশালী পীর-ফকিররাও স্বতন্ত্রভাবে প্রার্থী হয়ে সুবিধা করতে পারেননি এ দেশে। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী কিছুই না বুঝে মার্কার কথা বলেছেন মনে করলে কিন্তু খুব হালকাভাবে নেওয়া হবে তাকে। সেটি সমীচীন হবে না।
এ দেশে গণতন্ত্র দানা বাঁধবে কীভাবে– প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলেই যেখানে ন্যূনতম গণতন্ত্রচর্চা নেই। গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষাও সেভাবে দানা বাঁধছে বলে মনে হয় না। এ সংক্রান্ত অভিযোগ করতে যারা সেমিনারের আয়োজন করেন– খোঁজ নিলে দেখা যাবে সেসব বেসরকারি সংস্থায়ও গণতন্ত্রের লেশমাত্র নেই। আমাদের নোবেলজয়ী প্রতিষ্ঠানটিতেও নাকি এ অবস্থা।
এমনিই তো আর হাসিনা-খালেদা-এরশাদ দলীয় নেতাকর্মী ও ভোটারদের ওপর নিজ নিজ পছন্দের প্রার্থী চাপিয়ে দিতে পারছেন না! সন্দেহ নেই, এমন কিছু বিষয়ে তাদের মধ্যে একটা মতৈক্য বা সমঝোতা রয়েছে। দলে গণতন্ত্রচর্চা বা অন্তত প্রার্থী মনোনয়নে তৃণমূলের অংশগ্রহণ নিশ্চিতে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) আগ্রহও কি পরিলক্ষিত হচ্ছে?
এত গালমন্দ করা হচ্ছে যে তত্ত্বাবধায়ক শাসনামলটিকে– তখনই কিন্তু এসব নিয়ে কিছু উচ্চবাচ্য করেছিল ইসি। শুধু নিরপেক্ষ নয়, 'অর্থবহ' নির্বাচন আয়োজনের কথাও তারা বলছিলেন। শেষ সময়ের ডামাডোলে তেমন নির্বাচন অবশ্য করতে পারেননি তারা। বিএনপি তো এখনও প্রশ্ন তোলে এমনকি ওই নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে! নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে (পরাজিত হলেও) তারা নাকি অতটা খারাপ করতেন না।
এখন কথা হল, প্রধানমন্ত্রী কি তেমন একটি নির্বাচন মোকাবেলার কথাও ভাবছেন মনে মনে? আন্দোলনের মাধ্যমে হোক আর যেভাবেই– বিএনপি ও তার সঙ্গীসাথীরা যদি নিজেদের পছন্দমতো একটা নির্দলীয় সরকারের ব্যবস্থা করেই ফেলে, তাহলে তো এক রকম বিরুদ্ধ পরিবেশেই নির্বাচন লড়তে হবে আওয়ামী লীগকে। নাকি তা বর্জন করবে দলটি?
খালেদা জিয়াকেও নাকি কেউ কেউ পরামর্শ দিয়েছিলেন ২০০৮-এর ডিসেম্বরে আয়োজিত নির্বাচনে অংশ না নিতে। সন্দেহ নেই, পছন্দের নির্বাচনকালীন সরকার রক্ষায় ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি ও তার দল আবার সেনাসমর্থিত সরকার দ্বারা বেশি আক্রান্ত হয়েছিলেন।
এগুলো অবশ্য আগাম চিন্তা বলেই বিবেচিত হবে আপাতত। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া দুজনেই এখন নিজ নিজ দলে তাদের কর্তৃত্ব আরও মজবুত করতে চাইবেন। প্রথম ও দ্বিতীয় উভয় জনই জানেন, দলে নীতি-আদর্শের প্রশ্নে তেমন ভিন্নমত না থাকলেও সুবিধা, পদ ও প্রার্থিতা নিয়ে মারাত্মক কোন্দল রয়েছে।
রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার 'বিরাট সম্ভাবনা' দেখে বিএনপিতেও জায়গায় জায়গায় কম সংঘাত পরিলক্ষিত হচ্ছে না। কেন্দ্রীয় নেতাদের সামনে ক্ষমতা প্রদর্শন করা হচ্ছে রীতিমতো! এ অবস্থায় দলের বড় নেতাদের নাকি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কোন্দল কমিয়ে আনার।
অতঃপর নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়ে ফয়সালা হয়ে গেলে শেখ হাসিনার অনুসরণে খালেদা জিয়াকেও বলতে হতে পারে, আমি যাকে দেব– নির্বাচনে তার পক্ষেই কাজ করতে হবে। বঞ্চিতদের আশ্বস্ত করে বলতে পারেন, সরকার গঠন করতে পারলে 'রাষ্ট্রক্ষমতায় তাদের অংশগ্রহণও' নিশ্চিত করা হবে।
ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতিতে এমনটাই তো হয়ে আসছে। কিছু যন্ত্রণাবিদ্ধ বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি বাদে 'জনগণ' এটা অনুমোদনও করছে নির্বাচনের মাধ্যমে। যোগ্য প্রার্থীর দিকে না তাকিয়ে সাধারণভাবে মার্কাতেই ভোট দিচ্ছেন তারা। কমবেশি সুইং ভোটাররাও।
আমরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন একটি ছাত্র সংসদ নির্বাচনের পর বিজয়ী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে বের হওয়া ছাত্রী মিছিলে যারা নজিরবিহীন হামলা চালিয়েছিল– পরবর্তী নির্বাচনে তারা কিন্তু জয়ী হয় ছাত্রী হলে।
ঢালাওভাবে বলা যাবে না, নিছক ভয় পেয়ে বা শক্তির পূজারী হয়ে মেয়েরা হীন আত্মসমর্পণ করেছিলেন হামলাকারীদের কাছে। এও কি বলা যাবে, পরবর্তী ছাত্র সংসদ নির্বাচনে তারা সঠিকভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছিলেন?