Published : 31 Jul 2010, 08:20 PM
ফরিদপুরে মধূখালী চিনির কলের কাছাকাছি দামুদিয়া গ্রামের আবুল বাসার সাহেবকে প্রতি মাসে দুই থেকে তিন কেজি চিনি কিনতে হয়। চা তৈরিতে, সকালে নাস্তায় চিড়ার সাথে, ছেলেমেয়েরা দুধভাতে মিশিয়ে খেতে, মেহমানদের সবরত দিতে এই চিনির প্রয়োজন হয়। বর্তমানে প্রতি কেজি চিনি কিনতে বাসার সাহেবের ৪৫-৫০ টাকা খরচ হয়। এই চিনি হয়তবা তাঁর বাড়ির কাছেই মধূখালী চিনির মিলেই তৈরি হয়। বাসার সাহেব হয়তো জানেন না যে গরীব দেশে বাস করেও প্রতি কেজি চিনি কিনতে তাকে আর্ন্ত্জাতিক বাজার মূল্য থেকে ৫-১০ টাকা বেশি দিতে হয়।
ফলে প্রতি বছর তিনি চিনি কেনায় গড়পরতা ২০০ টাকার বেশি খরচ করে থাকেন। এই হিসেবে বাংলাদেশের দুই কোটি পঞ্চাশ লক্ষ পরিবার চিনি কেনা বাবদ প্রতি বছর কমবেশি ৫০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ করে থাকে। এই বাড়তি খরচ ১৯৮০ দশকের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয়। এর পর গত ২৫ বছরে অনেকবার সরকার বদল হয়েছে এবং কয়েক ধরণের সরকার এসেছে কিন্তু এর কোন পরিবর্তন হয়নি। অন্যদিকে মাথাপিছূ চিনির চাহিদা বেড়ে গেছে। সত্তর দশকের গোড়ার দিকে আমরা মাথাপিছূ প্রতি বছর সর্বোচ্চ ২ কেজি চিনি খেতাম। এই হার নব্বই দশকে ৩ কেজিতে পৌঁছে বর্তমানে ৫ কেজির বেশি চলে এসেছে। বাংলাদেশের প্রতিটি পরিবারকে চিনি কিনতে এখন বেশি গচ্চা দিতে হচ্ছে। এতে কে লাভবান হচ্ছে?
বর্তমানে আমাদের প্রয়োজনীয় চিনির অধিকাংশ বিদেশ থেকে আমদানি হচ্ছে। প্রতি বছর নিয়মিত চিনি আমদানি শুরু হয় ১৯৮৩/৮৪ সাল থেকে। সেই থেকে আমদানি বৃদ্ধির সাথে সাথে স্থানীয় উৎপাদন কমে যাচ্ছে। দেশে উৎপাদিত চিনির পরিমান সর্বাধিক হ্রাস পেয়ে মোট চাহিদার ২৩% পৌঁছে ২০০০/০১ সালে। পরের বছর দেশে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে ৭৩% পৌঁছালেও সাম্প্রতিককালে এক-পঞ্চমাংশের কাছাকাছি রযেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী চলতি দশকের মধ্যবর্তী সময় থেকে বংলাদেশে বছরে প্রায় ৬ থেকে ৭ লক্ষ টন আমদানি এবং ১ থেকে দেড় লক্ষ টনের উপর উৎপন্ন হচ্ছে।
গত বছরের শেষের দিকে আন্তর্জাতিক বাজারে চিনি যখন প্রতি পাউন্ড ০.৩৬ ইউএস ডলারে (ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিব্যুন, ২৭ আক্টোবর ২০০৯) বা প্রতি কেজি প্রায় ৫৫ টাকার কমে বিক্রি হচ্ছে বাংলাদেশের বাজারে তখন কেজি প্রতি ৬৫ থেকে ৬৮ টাকায় চিনি ক্রয় করতে হয়েছে। কারণ হিসেবে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প সংস্থার (বিএসএফআইসি) চেয়ারম্যান বলেছিলেন আখ উৎপাদিত এলাকা ২ লক্ষ একর কমে গেছে এবং ৫০ থেকে ৭৫ বছরের পুরানো কলে চিনি উৎপাদন হার কম (দি ইনডিপেনডেন্ট, ২ ডিসেম্বর ২০০৯)। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর দেয়া তথ্য অনুযায়ী আখ উৎপাদিত এলাকার হ্রাস ও বৃদ্ধি দুটোই হচ্ছে।
গত পঁচিশ বছরের মধ্যে সবার্র্ধিক এলাকায় আখ উৎপাদিত হয় ১৯৯০/৯১ সালে, ৪ লক্ষ ৭২ হাজার একরে। ওই বছর প্রায় ৭৭ লক্ষ মেট্রিক টন আখ উৎপাদিত হয় এবং এর শতকরা ৯৪ ভাগ মাড়াইয়ের জন্য পাওয়া গেলেও শতকরা ৪১ ভাগ মাড়াই করে ২৪৬ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন করা হয়েছিল। এর আগে ১৯৮৬/৮৭ সালে ৪ লক্ষ ৭ হাজার একরে আখ চাষ করা হয়েছিল । চলতি দশকের গোড়ার দিকে ৪ লক্ষ ১ হাজার একর জমিতে চাষ হয়ে মাঝামাঝি সময়ে ১৩ হাজার একর কমে আসে। গত ২০০৫/০৬ অর্থবছরে ৩ লক্ষ ৭৭ হাজার একরে চাষ হয়ে তা কমে গিয়ে ২০০৭/০৮ অর্থবছরে ৩ লক্ষ ২০ হাজার একরে চাষ হয়েছে। ফলে আখের উৎপাদন এলাকা যেমন ২ লক্ষ একর কমেনি তেমনি উৎপাদন তারতম্যের কোন প্রতিফলন চিনির মূল্যে দেখা যায়নি। কারণ ১৯৮৫/৮৬ সাল থেকে বাংলাদেশে যে পরিমাণ চিনির প্রয়োজন হয় তার বেশির ভাগ আমদানি করা হয়। ওই বছর মোট বিক্রিত চিনির ৩৮% দেশে উৎপাদিত হয়, বাকি অংশ পুরোটায় আমদানী করা হয়। অপর একটি উল্লেখ্য ব্যাপার হলো চিনিকলগুলোতে মাড়াইয়ের জন্য যে পরিমাণ আখ পাওযা যায় তার শতকরা ৫০ ভাগও মাড়াই করতে পারে না। মাড়াইয়ের সর্ব্বোচ্চ হার ছিলো ২০০৬/০৭ সালে মিলে মোট প্রাপ্ত আখের শতকরা ৪৩ ভাগ এবং ২০০০/০১ সালে সর্বনিম্ন ছিলো শতকরা ২২ ।
বিএসএফআইসি চেয়ারম্যান সাহেব বাংলাদেশে চিনির মূল্য বৃদ্ধির আর একটি কারণ বলেছিলেন আন্তর্জাতিক বাজার দরে উর্ধ্বগতি। গত বছরের শেষ দিকে বাংলাদেশে যখন চিনি প্রতি কেজি ৫৫-৬০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে ভারতে তখন ২০-২৬ রুপি বা ৩০-৩৬ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এর আগের বছর ভারতে চিনির মূল্য ছিল প্রতি কেজি ১৩ রুপি বা ১৮ টাকা (বিজনেস লাইন, দি হিন্দু গ্রুপ অফ পাবলিকেসন্স এর বিজনেস ডেইলি, ২ ডিসেম্বর, ২০০৯)। কিন্তু এই কারণে বাংলাদেশে বৃদ্ধির হার ছিল অতিরিক্ত বেশি। চেয়ারম্যান সাহেবের অপর আর একটি যুক্তি: পুরোনো কলে চিনি উৎপাদন হার কম। প্রতি ১০০ কেজি আখ থেকে ৭-৮ কেজি চিনি উৎপন্ন হয়। ভারতে এই উৎপাদন হার বাংলাদেশের কলের থেকে ২-৩ কেজি বেশী ।
যতদুর জানা যায় ভারতের অনেক চিনির মিল পুরোনো। পুরোনো কলে চিনি উৎপাদনের হার কম হবে এটা যুক্তিসঙ্গত নাও হতে পারে। এর কারণ অনেক। প্রথমতঃ বাংলাদেশে চিনির কলগুলো সময়মত আখ সংগ্রহ ও মাড়াই–এর কোনটাতেই গুরুত্ব দেয় না। মিল গেটে আখ বোঝাই গাড়ী নিয়ে চাষীদের দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয় বিক্রির জন্য। অথচ পরিপক্ক আখ কাটার পর দ্রুত মাড়াই না করলে গুণগত মান ও পরিমাণ উভয়েরই অবনতি ঘটতে থাকে, বিশেষ করে দানাকৃতি ধারণে ব্যাঘাৎ হয়। আর একটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার ১৯৯৭ সালের পর থেকে চিনি উৎপাদন হার শতকরা ৮ ভাগ থেকে ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়ে ৭ ভাগেরও নিচে পৌঁছেছে। এর কারণ হয়তোবা ব্যবস্থাপনায় অবনতি ঘটেছে অথবা হঠাৎ করে চিনির কলগুলো আরো পুরনো হয়ে গেছে।
দেশে উৎপাদিত চিনির দাম কেন বেশি হবে? বিএসএফআইসি ১০০ কেজি আখ ২০০ টাকায় কিনে (প্রতি মণ আখ ৮০ টাকা হিসেবে)। মাড়াইয়ের পর কমপক্ষে ৭ কেজি চিনি উৎপাদন করতে ৭০ টাকা (কেজি প্রতি ১০ টাকা হিসেবে) খরচ হোক। মাড়াই থেকে ঝোলাগুড় ও অন্যান্য বাইপ্রোডাক্ট উৎপাদিত হয় এবং এগুলো বেশ ভালো দামে বিক্রি হয়। এই হিসেবে চিনির সর্বোচ্চ দাম কেজি প্রতি ৪০ টাকা হতে পারে। এর বেশি কেন হবে?
চিনি ব্যবসায়ীদের কাছে এখন দেশে চিনি উৎপাদনের থেকে বিদেশ থেকে আমদানি অধিক লাভজনক । বিএসএফআইসি চিনির কলে উৎপাদন খরচ অত্যধিক বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে উৎপাদিত চিনির মূল্য পুননির্ধাণের ফলে এই লাভের পরিমাণ আরও বেড়ে গেছে। সব সরকারই এই অত্যধিক উৎপাদন খরচের সাথে একমত পোষন করে আসছে। বিগত আশি দশকের মধ্যভাগে বিশ্ব বাজারে চিনির মূল্য প্রতি কেজি যখন ২০ টাকার কম তখন বিএসএফআইসি মিলে উৎপাদিত চিনির মূল্য নির্ধারণ করা হয় প্রতি কেজি ২৯ টাকা আর খোলা বাজারে বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৩০ টাকার উপরে, আন্তর্জাতিক বাজার দরের চেয়ে ১৫ থেকে ২০ টাকা বেশী। ওই সময় থেকে বাংলাদেশে অত্যধিক হারে চিনি আমদানি শুরু হয়।
উল্লেখযোগ্য ১৯৭৭/৭৮ সালে বাংলাদেশ থেকে ২৮ হাজার মেট্রিক টন চিনি রফতানি করা হয়েছিল, আমদানি নয়। বাংলাদেশে নিয়মিত চিনি আমদানী শুরু হয়েছে ১৯৮৩/৮৪ সালে। ওই বছর ৬ মেট্রিক টন এবং পরবর্তী বছর ৩ মেট্রিক টন চিনি আমদানী হয়। এর পরের বছর ১৩৫ মেট্রিক টন চিনি আমদানি হয়, স্বভাবতই বিএসএফআইসি চিনির কলে উৎপাদিত চিনির মূল্য নির্ধারণের পর। ওই সময় থেকেই শুরু হয় দেশি কলে চিনি উৎপাদন হ্রাস আর বিদেশ থেকে চিনি আমদানি বৃদ্ধি। গত দশকের প্রথম দিকে বিএসএফআইসি চিনির কলে উৎপাদিত চিনির মূল্য প্রতি কেজি ২৯ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৩৩ টাকা করা হয়। ওই সময়ও বিশ্ব বাজারে চিনির মূল্য ছিল প্রতি কেজি ২০ টাকার কম। বিএসএফআইসি এর চিনির মূল্য গত বছর পুননির্ধারণ করা হয়েছে ৪৫ টাকায়। এ বছরের শুরুতে বিশ্ব বাজারে চিনির মূল্য কমে গিয়ে প্রতি টন ৪৯০ ডলার বা প্রতি কেজি ৩৫ টাকায় নেমে এলেও বাংলাদেশে ৪০ টাকার উপরে বিক্রি হয়েছে।
উপরোক্ত পর্যালোচনাসমূহ সমালোচনার দৃষ্টিতে না দেখে এ থেকে শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা নিয়ে আমরা চিনি উৎপাদন খাতে পরিবর্তন আনতে পারি। পুরোনো মিল সংস্কার করে বা নতুন মিল স্থাপন করে সমস্যার সমাধান নাও হতে পারে। তখন দেখা যাবে যে নতুন মিলের কলকব্জা আধুনিক হওয়ায় দাম বেশী, মেরামত খরচও বেশি। উদাহরণ হিসেবে পাট মিলের বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে। পুরোনো পাট মিল বেসরকারী খাতে দেয়ার পর লাভজনক হয়েছে। চিনি মিলের ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন করা যেতে পারে। সমবায়ভিত্তিক পলিচালনার বিষয় পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে। ভারতের মহারাষ্ট্রে প্রায় ১৬৫ টি চিনির মিল আছে এবং অনেকগুলো সমবায়ভিত্তিক পরিচালিত। এ বছর এপ্রিলে মহারাষ্ট্রে প্রতি টন আখ পরিবহন খরচ সহ ২,৫২৫ রুপিতে (বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রতি মণ আখ প্রায় ১৪০ টাকায়) কিনে মিলে চিনি তৈরী করে প্রতি কুইন্টাল ২,৬০০ রুপি (বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রতি কেজি ৪০ টাকায় বিক্রি করেছে)।
মিল এলাকার কৃষদের সাধারণ প্রযুক্তি প্রয়োগ করে দেশীয় চিনি উৎপাদনে সহযোগিতা করা যেতে পারে। যেমন ৫ হর্সপাওয়ার ডিজেল ইঞ্জিনে প্রতি ঘন্টায় ৩০০ কেজি আখ মাড়াই করে, সাধারণ চুলায় জ্বাল দিয়ে, তাঁতে বোনা কাপড়ে ছেকে দানাদার করা হয়। জ্বাল দেয়ার সময় রস ফুটন্ত হওযার আগে গাছের (যেমন জবা গাছ) ছাল ভেজানো পানি বা রসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে রস থেকে ময়লা পদার্থ আলাদা করে ফেলা হয়। জমানো দানা হাত দিয়ে সেন্ট্রিফিউজ (ঘুর্ণায়মান ব্রাশ) দিয়ে আলাদা করে রৌদ্র্যে শুকানো হয।
ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্র্রিকা ও ভারতে ক্ষুদ্রাকার প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষকেরা আখ মাড়াই করে রস তৈরি ও রস প্রক্রিয়াজাত করে চিনি উৎপাদন করে থাকে। এর জন্য স্বল্প মূল্যে আধুনিক যন্ত্রপাতি পাওযা যায়। আমাদের দেশে আখ চাষের উপযোগী প্রায় ২ লক্ষ হেক্টর জমি আছে। এই জমিতে বর্তমান হারেই হেক্টর প্রতি ৪০ টন আখ এবং প্রতি টনে ৭০ কেজি (শতকরা ৭ ভাগ হিসেবে) চিনি উৎপাদন করে আমরা আমাদের প্রয়োজনীয় চাহিদার কমপক্ষে শতকরা ৭০ ভাগ পূরণ করতে পারি। আর যদি আখের ফলন ও চিনি উৎপাদন হার শতকরা ১৫ ভাগ বৃদ্ধি করা যায় তাহলে পুরো চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। এত করে গ্রামীন আয় ও কর্মসংস্থান যেমন বৃদ্ধি পাবে তেমনি সাশ্রয় হবে বছরে দুই থেকে হাজার কোটি টাকা যা বিদেশ থেকে চিনি আমদানি করতে খরচ করা হয়। সেই সাথে আবুল বাসার সাহেবের পরিবারসহ দেশের কোটি কোটি পরিবার অতিরিক্ত খরচ থেকে নিষ্কৃতি পাবে।