খরচের বাজারে সঞ্চয় ভাঙছেন, কম খাচ্ছেন ভারতের অবসরপ্রাপ্তরা

দিল্লি হাই কোর্টের আইনজীবী ৬৬ বছরের টি এল ওয়ালী আর কিছু দিন পর অবসরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন। কিন্তু জীবনযাত্রার খরচ বাড়ায় তিনি এখনই নিজের সঞ্চয়ে হাত দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 May 2022, 07:14 PM
Updated : 25 May 2022, 07:14 PM

ওয়ালী ভাবছেন, চিকিৎসা, ভ্রমণ আর সংসার চালানোর খরচ যোগাতে হয়তো আরও কয়েক বছর বেশি কাজ করে যেতে হবে তাকে।

মহামারীর কারণে বিপদের ক্ষেত্র তৈরি হয়েই ছিল। এর মধ্যে ইউক্রেইনে যুদ্ধের প্রভাবে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। খাদ্য, জ্বালানিসহ নিত্যপণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ায় অন্য অনেক দেশের মত ভারতের মানুষকেও কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হচ্ছে, বিশেষ করে বয়স্কদের

রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ভারতীয়দের জীবনযাত্রার কঠিন লড়াইয়ের চিত্র।

একটি পোস্টাল ব্যাংকের সামনে দাঁড়িয়ে ওয়ালী রয়টার্সকে বলেন, “আমি এখন আর অবসর জীবন নিয়ে ভাবতেও পারছি না।”

ব্যাংক থেকে জমা টাকা তুলতেই ব্যাংকে গিয়েছেন তিনি। খরচ কমাতে রেস্তোরাঁয় খাওয়া, স্বজনদের বাড়িতে যাওয়া বন্ধ করেছেন তিনি। এমনকি ফল কেনাও কমাতে হয়েছে।

তার হিসাবে, কোভিড-১৯ মহামারীর পরে তার আয় মহামারীর আগের তুলনায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। তার গ্রাহকরা মহামারীর পর আর আগের মতো ফি দিতে পারছেন না। সঞ্চয় থেকে পাওয়া সুদ দিয়ে আগে তিনি যে পরিমাণ কেনাকাটা করতে পারতেন, জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন বাজার থেকে সেই পরিমাণ জিনিসপত্র নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারছেন না।

নিজের বয়সী অনেকের চেয়ে তুলনামূলকভাবে ‘ভালো জীবন’ কাটিয়ে এসেছেন ওয়ালী। এখন তার মত লাখ লাখ বয়স্ক ভারতীয়কে খরচ কমাতে কঠিন সব সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।

ভারতে ৬০ বছরের বেশি বয়সী পেনশনভোগীর সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। কিন্তু সেই পেনশনের পরিমাণ এতটাই কম যে খুব অল্প সংখ্যক অবসরপ্রাপ্ত কর্মী পেনশনের টাকায় নিজেদের চিকিৎসার খরচ চালিয়ে নিতে পারেন। ওই বিপুল জনগোষ্ঠীর প্রায় ১০ শতাংশেরই নিজেদের বাড়ি নেই।

রয়টার্স জানিয়েছে, ভারতে মূল্যস্ফীতি এপ্রিলে ৭ দশমিক ৭৯ শতাংশে পৌঁছেছে, যা আট বছরের সর্বোচ্চ। গম, ভোজ্য তেল, সবজি, ফল, মাংস ও চায়ের মত খাদ্য পণ্যের দাম এক বছরে ১০ থেকে ২৫ শতাংশ বেড়েছে। রান্নার গ্যাস ও পেট্রলের দাম বেড়েছে ৪০ শতাংশের বেশি।

দাতব্য সংস্থা হেলপএজ ইনডিয়ার পরিচালক অনুপমা দত্ত বলেন, বয়স্কদের জন্য ‘সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি’ দিয়েছে মূল্যস্ফীতি। ৬০ বছরের বেশি বয়সী ১৩ কোটি ৮০ হাজার মানুষের মধ্যে ৯ কোটিই বেঁচে থাকার জন্য আগের চেয়ে বেশি খাটছেন এখন।

ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সতর্ক করে বলেছে, মূল্যস্ফীতির এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।

সঞ্চয় ভাঙছেন বয়স্করা

অবসর জীবন স্বচ্ছলভাবে কাটাতে ভারতের পেনশনভোগীদের অনেকেই তাদের দীর্ঘদিনের সঞ্চয়ের ওপর নির্ভর করেন।

সরকারিভাবে কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও পেনশনভোগীদের সমিতিগুলো জানিয়েছে, তাদের সদস্যরা এখন নিজেদের সঞ্চয় অ্যাকাউন্ট থেকে আগের চেয়ে বেশি অর্থ তুলছেন।

রয়টার্স জানিয়েছে, মার্চে শেষ হওয়া অর্থবছরে ভারতের সার্বিক সঞ্চয় হার জিডিপির ৩০ শতাংশের নিচে নেমে গেছে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। মহামারীর আগে এই হার ৩২ শতাংশ ছিল। আগামী বছরেও এই ধারা বদলাবে না বলেই অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা।

ভারতে গত তিন বছরে দীর্ঘমেয়াদী সঞ্চয়ী আমানতে গড় সুদ হার সাড়ে ৮ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশে নেমে গেছে, যা মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে কম।

পেনশনভোগীদের কিছু অংশ ব্যাংকে জমানো টাকা থেকে পর্যাপ্ত আয় না পাওয়ায় আরও ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ- যেমন ইক্যুইটি ও মিউচুয়াল ফান্ডের দিকে ঝুঁকছেন। কিন্তু দুই বছর ভালো ফল দেওয়ার পর সেদেশের পুঁজিবাজারও এখন পড়তির দিকে।

ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপিও স্বীকার করছে, মূল্যস্ফীতির ধাক্কা সবচেয়ে বেশি ভোগাচ্ছে বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে।

বিজেপির অর্থনীতি বিষয়ক মুখপাত্র গোপাল কৃষ্ণা আগারওয়াল বলেন, বয়স্কদের সুরক্ষার জন্য তাদের সরকার সাধ্যমত সবকিছুই করছে, যার মধ্যে খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবা সহায়তাও অন্তর্ভুক্ত।

সরকারের ত্রাণ কর্মসূচির আওতায় এরইমধ্যে ৮০ কোটি পরিবারকে বিনামূল্যে খাদ্যশস্য সরবরাহ করা হয়েছে। জ্বালানি তেল, ডিজেল ও রান্নার তেলের দাম সহনীয় রাখতে সরকার এই সপ্তাহে করের হার পরিবর্তন ও ভর্তুকির ঘোষণা দিয়েছে।

রয়টার্স লিখেছে, ওই ঘোষণা জনগণের জন্য কতটা স্বস্তি বয়ে আনবে, তা স্পষ্ট নয়। রাজ্য পর্যায়ে পেনশনভোগীরা মাসে মাত্র ২০০ রুপি করে পান। কয়েকটি রাজ্যে অবশ্য এক থেকে দুই হাজার রুপি করেও দেওয়া হয়।

কলকাতার বাসিন্দা ৭০ বছর বয়সী গীতা সেন বলেন, মাসিক এক হাজার রুপির পেনশন দিয়ে এখন তার দুবেলা খাবার জোটানোও কঠিন হয়ে পড়েছে। এক কক্ষের একটি বস্তি ঘরে তিনি ভাড়া থাকেন। প্রায়ই তাকে প্রতিবেশীদের কাছ থেকে খাবার চেয়ে নিতে হয়।

সেবা হচ্ছে সঙ্কুচিত

ভারতে বয়স্কদের জন্য উন্নত দেশের মত সেবাকেন্দ্র বা বৃদ্ধনিবাস বেশি নেই। অবসরপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগই নির্ভর করেন তাদের পরিবারের ওপর। তাতে সন্তানদের ওপর চাপ বেড়েছে, যারা মহামারীর পর নিজেদের পরিবারের জীবনযাত্রার খরচ চালাতে হিমশিম অবস্থায় আছে।

টাটা ট্রাস্টের একটি গবেষণা অনুযায়ী, ভারতে মাত্র এক হাজার ১০০ বৃদ্ধাশ্রম রয়েছে, যারা কোভিড-১৯ মহামারীর আগে প্রায় এক লাখ বয়স্ককে সেবা দিয়ে আসছিল।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যক্তি পর্যায়ের দানের ওপর নির্ভরশীল এই বৃদ্ধাশ্রমগুলোও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে দারুণ সংকটে রয়েছে। খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানির খরচ বাড়ায় বৃদ্ধাশ্রমগুলোকে সবজি, ফল, ওষুধ ও অন্যান্য সেবায় খরচ কমাতে হচ্ছে।

দিল্লিভিত্তিক দাতব্য সংস্থা এসএইচইওডব্লিউএসের পরিচালক শুভ্রা ভগত জানান, তারা তিনটি বৃদ্ধাশ্রমে ৪০০ জনের দেখাশোনা করেন। সম্প্রতি তাদের মাসিক খরচ প্রায় ২০ শতাংশ বেড়ে গেছে।

তিনি বলেন, “আমাদের বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে আমরা এখন আর ফল কেনার কথা ভাবি না। ফুড সাপ্লিমেন্টের খরচ কাটছাঁট করতে হয়েছে যার কারণে অসুস্থদের সেরে উঠতে সময় লাগছে।”

শুভ্রা ভগত জানান, তারা যেসব বৃদ্ধাশ্রম পরিচালনা করেন, সেখানে এক মাসে দিল্লির রাস্তা থেকে ৩০ থেকে ৪০ জন বয়স্ক মানুষকে তুলে এনে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে, যাদের ফেলে গেছে তাদের স্বজনেরা। এই হার গত বছরের চেয়ে তিনগুণ বেশি বলে জানান শুভ্রা।

এসএইচইওডব্লিউএসের একটি বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দা বাসন্তী চাঁদ (৬১) জানান, নিজের সঞ্চয়ের সবটুকু খরচ করে চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করার পরেও তার পরিবার তাকে ফেলে গেছে। চার মেয়ের যৌতুক পরিশোধ করতে নিজের ছোট বাড়িটিও তিনি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন।

তবু সন্তানদের দোষ দিচ্ছেন না তিনি। অশ্রুসিক্ত চোখে বাসন্তী বলেন, “আমি তাদেরকে খারাপ ভাবতে পারি না। শেষ পর্যন্ত তারা আমার সন্তান ... তাদের নিজেদেরই এখন অনেক সমস্যা।”