‘লকডাউনের’ সুযোগ নষ্ট করে এখন করোনাভাইরাসের ‘হটস্পট’ দিল্লি

কোভিড-১৯ রোগী ৮০ হাজার হয়ে গেছে দিল্লিতে; মারা গেছেন আড়াই হাজারেরও বেশি। মহামারী ঠেকানোর চেষ্টায় যেন কুলিয়ে উঠতে পারছে না ভারতের রাজধানী।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 July 2020, 04:08 AM
Updated : 1 July 2020, 04:08 AM

ভারতেরই বিভিন্ন শহর যখন করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে অনেকটা সফলতা দেখাচ্ছে, তখন রাজধানীর হিমশিম খাওয়ার কারণ অনুসন্ধান করেছে বিবিসি।

তাতে বেরিয়ে এসেছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গোটা দেশে প্রায় তিন মাস যে ‘লকডাউন’ দিয়েছিলেন, তার সেই সুযোগ কীভাবে হেলায় হারিয়েছে দিল্লির কর্তৃপক্ষ।

বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দুর্বল কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং, অতিরিক্ত আমলাতান্ত্রিক জটিলতার পাশাপাশি বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবায় মনোযোগ না দেওয়া আর রাজনৈতিক বিভেদ রোগীর সংখ্যাই বাড়িয়ে তুলছে এ শহরে, যেখানে থেকে কেন্দ্রীয় সরকার গোটা দেশ পরিচালনা করে।

ভারতের ছোট শহরগুলো বরং রাজধানীর চেয়ে ভালোভাবে সামাল দিতে পারছে এই মহামারী।

কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং পদ্ধতিতে জোর দিয়েছিল কর্নাটক প্রদেশের রাজধানী বেঙ্গালুরু; সংক্রমণ বিস্তার ঠেকাতে বেঙ্গালুরুর এই ব্যবস্থাপনা কাজেও দিয়েছে।

চেন্নাইতে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লেও মৃত্যুর হার সামান্যই। ভারতের বাণিজ্যিক কেন্দ্র মুম্বাইও ছোঁয়াচে এই ভাইরাসে বিপর্যস্ত।

তবে দিল্লিতে নতুন রোগীর সংখ্যা এখন ঊর্ধ্বমুখী। এ শহরের সবচেয়ে ভালো ও বড় সরকারি হাসপাতালগুলো রোগী সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে।

অথচ কিছু দিন আগে স্বাস্থ্যসহ সেবা খাতে নাগরিক সুবিধা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতিতে ভর করেই দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসেন আম আদমি পার্টির অরবিন্দ কেজরিওয়াল।

এরপরেও দিল্লি বেহাল কেন?

অপর্যাপ্ত নমুনা পরীক্ষা ও কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং

জুনের গোড়া থেকেই রোগীর সংখ্যা বাড়ছিল দিল্লিতে; এই এক মাসেই শনাক্ত হয় ৫০ হাজার জন।

ওই সময় সদ্য অনুমোদন পাওয়া অ্যান্টিজেন টেস্ট কিট দিয়েই অধিকাংশ পরীক্ষা করা হয়েছিল। আধা ঘণ্টার মধ্যেই ফলাফল দিতে পারা এই কিট ব্যবহারের কারণেই ওই মাসে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ব্যাপক হারে বেড়ে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

তবে নমুনা পরীক্ষাকেই সমাধান বলে মনে করছেন না কে শ্রীনাথ রেড্ডি।

পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন অফ ইন্ডিয়ার সভাপতি ও ভারতের জাতীয় কোভিড-১৯ টাস্কফোর্সের সদস্য রেড্ডি বিবিসিকে বলেন, “অবশ্যই টেস্ট করাতে হবে। তবে অবস্থা বুঝে তা করতে হবে; উপসর্গ ও অন্যান্য দিক স্পষ্ট বুঝে নিয়েই পরীক্ষা করতে হবে।”

“আর এজন্য রোগের শুরুতেই তা শনাক্ত করা ও ব্যাপকভাবে কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং করতে হবে; যার কোনোটাই করা হয়নি,” বলেন তিনি।

কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং নিয়ে ইনডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকেল রিসার্চের (আইসিএমআর) এক গবেষণা বলছে, জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে ভারতে গড়ে প্রতিটি শনাক্ত রোগীর বেলায় তার সংস্পর্শে আসা ২০ জনেরও পরীক্ষা করা হয়।

তবে ভারতে সবখানে এই অনুপাতে কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং করা হয়নি।

কর্নাটকে যেখানে গড়ে রোগীর সংস্পর্শে আসা ৯৩ জনকে পরীক্ষা করা হয়েছে, দিল্লিতে এই সংখ্যা ছিল মোটে ৯ জন।

গত মাসে দিল্লির স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, রোগীর একেবারে ঘনিষ্ঠজনরাই থাকছে ট্রেসিং পদ্ধতির আওতায়।

যদিও টুইটারে অনেকেই অভিযোগ করেছেন, কোভিড-১৯ রোগীর পরিবারের সদস্যদের পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে না।

রোগীর প্রতিবেশীদের অবরুদ্ধ না করার কথাও টুইটে জানিয়েছেন অনেকে।

“আমি এমন অনেক ঘটনাই জানি যেখানে পরিবারে একজন কোভিড-১৯ শনাক্ত হলেও বাকিদের সাথে যোগাযোগ করা হয়নি,” বলেন স্বাস্থ্য বিভাগের উপর নজর রাখা অল ইন্ডিয়া ড্রাগ অ্যাকশন নেটওয়ার্কের মালিনি অ্যায়সোলা।

বিবিসিকে তিনি বলেন, “অনেক ক্ষেত্রেই কয়েকদিন অতিবাহিত হলেও পরিবারের সদস্যদের পরীক্ষা করা হত না, যদি না জোরালো অনুরোধ ও সরকারের তরফ থেকে নির্দেশনা আসত।”

তবে সম্প্রতি ২ কোটি ৯০ লাখ দিল্লিবাসীর ঘরে ঘরে গিয়ে পরীক্ষা করার এক ঘোষণা এসেছে সরকার থেকে। যে কোনো জায়গায় ত্বরিত নমুনা সংগ্রহ করে পুরো শহরে ২৬ হাজার টেস্ট করার পাশাপাশি ড্রোন ও পুলিশ দিয়ে শারীরিক দূরত্ব মেনে চলা তদারকিও করা হবে এই কার্যক্রমের আওতায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেরি হয়ে গেছে। এমন অনেক উদ্যোগ আরও আগেই নেওয়ার দরকার ছিল; লকডাউনের মধ্যেই। যদি ওই সময় এমন কার্যক্রম ব্যাপক হারে পরিচালনা করা হত, তাহলে মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে লকডাউন শিথিল হওয়ার কালে সরকার আরও সহজে সবকিছু সামাল দিতে পারত।

মানুষকে বোঝাতে ব্যর্থতা

দিল্লির স্যার গঙ্গা রাম হসপিটালের ভাসকুলার সার্জন আমবারিশ সাত্ত্বিক বলেন, “এই মহামারী নিয়ে কুসংস্কার পেয়ে বসেছে সবাইকে। এখন এটা জনস্বাস্থ্য সঙ্কট না হয়ে আইন-শৃঙ্খলার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

টেস্ট সম্পর্কিত নানা নিয়ম, কোভিড-১৯ পজিটিভ হলে করণীয় নিয়ে যথেষ্ট প্রচারণা না করা এবং দুর্বল ব্যবস্থাপনার সরকারি কোয়ারেন্টিনের কারণে অনেকেই পরীক্ষা করাতে অনিচ্ছুক থাকছেন।

সাত্ত্বিক বলেন, “যদি পুলিশ ফোন দেয়, যদি স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ফোন দিয়ে বলে, আপনাকে কোয়ারেন্টিনে নিয়ে যাওয়া হবে, তাহলে কে আর টেস্ট করতে আগ্রহী হবে? বরং মানুষ সময় নেবে এসব ক্ষেত্রে। এটা ছিল একেবারে শাস্তির মতো।”

ভারতের বেসরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও, কম সংখ্যক কর্মী ও অপরিসীম চাপ নিয়ে সরকারি পরীক্ষাগার ও হাসপাতালগুলোর উপরেই সব দায়-দায়িত্ব ছিল।

আর এর ফল হয়েছে,  সরকারি হাসপাতালের লম্বা লাইনে দাঁড়ানোর চেয়ে উপসর্গ দেখা গেলে ঘরেই থাকতে চেয়েছেন অনেকে।

এরমধ্যে দিল্লির হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত বেড না থাকা ও কোভিড-১৯ রোগীদের ভর্তি না নেওয়ার কথা ছড়িয়ে পড়লে, মানুষের মধ্যে অস্থিরতা ও ভয় আরও বেড়ে যায়।

গত শনিবার কেজরিওয়াল বলেন, করোনাভাইরাসের দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়াই দিল্লির স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর চাপ হয়ে দেখা দিয়েছে।

ভয় ও কুসংস্কার পেছন থেকে এই মহামারীকে বেগ দিয়েছে, বলেন অধ্যাপক রেড্ডি।

বেসরকারি খাতে পরীক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা বাড়াতে এবং খরচ নিয়ন্ত্রণে সরকারকে আরো আগে উদ্যোগী হতে হত বলে মনে করছেন তিনি। কিন্তু খরচ, পরীক্ষা ও হাসপাতালের শয্যা নিয়ে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর সঙ্গে কথা চালাচালিতেই কয়েক সপ্তাহ পার করে দিয়েছে ভারত সরকার।

এসব কারণে রোগী তার সামনে খুব বেশি সুযোগ-সুবিধা দেখতে পান না; ফলে পরীক্ষা করা নিয়ে তার মধ্যে এক ধরনের অনীহা গড়ে ওঠে বলে মনে করছেন সাত্ত্বিক।

অন্যদিকে অধ্যাপক রেড্ডি বলেন, ভারতে সরকার নমুনা পরীক্ষা ও চিকিৎসা সেবা নিয়ে এতই ব্যতিব্যস্ত ছিল যে, জনস্বাস্থ্যের সাধারণ বিষয়গুলো তাদের নজর এড়িয়ে যায়।

“তাদের একটি সহানুভূতিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করা উচিৎ ছিল। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকর্মী ও কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীদের দিয়ে কাদের জ্বর ও কাশিরে উপসর্গ রয়েছে খুঁজে বার করতে হত। এরা যেসব বাড়িতে পরিদর্শনে যেত সেখানে রোগী থাকলে তাকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিত।”

এতে করে একটি সুস্পষ্ট ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি নিশ্চয়তাও তৈরি হত, যা ছাড়া এই মহামারীর সঙ্গে কুলিয়ে ওঠা যাবে না, বলেন তিনি।

“মানুষের মধ্যে এই বিশ্বাস থাকতে হবে, তারা যেমন সেবা চায় তেমনটিই পাবে; তাদের যত্নের সাথেই চিকিৎসা দেওয়া হবে।”

যদিও বাস্তবতা এর থেকে একেবারে ভিন্ন।

ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ঝুলন্ত সিদ্ধান্ত

রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব কীভাবে দিল্লির মহামারীতে প্রভাব রেখেছে, তাও ‍উঠে এসেছে বিবিসির প্রতিবেদনে।

রাজ্য হিসেবে দিল্লিতে ক্ষমতাসীন কেজরিওয়ালের কর্তৃত্ব শক্ত হলেও তার ক্ষমতাশালী প্রতিপক্ষও রয়েছে। আবার দিল্লিতে থাকা কেন্দ্রীয় সরকারে রয়েছে বিজেপি, যার সঙ্গে আম আদমি পার্টির সম্পর্ক ভালো নয়।

এতে করে একের পর এক নির্দেশনায় জটিলতা দেখা দিচ্ছে; একবার ঘোষণা আসছে, তারপর তা বাতিল করা হচ্ছে। কখনও কখনও ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ঘোষণা পরিবর্তন হচ্ছে।

এসব সহজেই আভাস দেয় মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়াল ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মধ্যে তাল মিলছে না।

অধ্যাপক রেড্ডি বলেন, “একেকবার একেক সিদ্ধান্ত নিয়ে দুলতে পারব না আমরা; প্রতিদিনের এই নাটকের অবসান হোক, এরমধ্যে প্রতিবাদও হয়েছে এর বিরুদ্ধে।”

তার ভাষ্যে, “রাজধানী হওয়ার কারণেই দিল্লিতে নজরদারি সবচেয়ে ভালো হওয়ার কথা ছিল; অথচ  এক বারবার সিদ্ধান্ত বদলকারী কর্তৃপক্ষের কারণে দিল্লি ব্যর্থ হয়ে রইল।”

অনেকেই বলছেন, দিল্লির আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এই ব্যবস্থাপনা আরও অস্বচ্ছ হয়েছে; এখানে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও অনেক সময় গাছাড়া ভাবে প্রকাশ করতে দেখা গেছে।

এখানে চলছে সংখ্যার খেলা, বলা হয়েছে বিবিসির অপর্ণা আলুরির প্রতিবেদন।

মুম্বাই শহরে দিল্লির চেয়ে ‘অ্যাকটিভ কেস’ ৫০০টি বেশি রয়েছে। শনাক্ত রোগীর নিশ্চিত সংখ্যায় একটু এগিয়ে ছিল রাজধানী এবং আশা করা যাচ্ছে, শহরটি শিগগিরই তালিকায় উপর থেকে নিচে নেমে আসবে।

তবে হাতে নেওয়া উদ্যোগে বিফল হওয়ার কোনো সুযোগ নেই দিল্লির।

“মহামারীতে দেরি বলে কিছু নেই। সংক্রমণ রোধে একটা পোক্ত কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। এটা করতেই হবে,” বললেন কোভিড-১৯ টাস্কফোর্সের সদস্য রেড্ডি।