মানবসৃষ্ট এক বিরূপ পরিস্থিতিতে হামিদার মা হওয়ার গল্প শুনিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদপত্র মেইল। কোলের শিশুটিকে নিয়ে মিয়ানমারের এই রোহিঙ্গা নারী বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে পেরেছেন, উঠেছেন আশ্রয় কেন্দ্রে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মুসলিম জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন-নিপীড়নের খবর বিশ্বজুড়েই এখন আলোচিত; সেখানে সেনা অভিযান নিরীহ মানুষের জীবন কতটা বিপর্যন্ত করেছে, তা উঠে আসছে হামিদার মতো অনেকের কথায়।
গত ২৫ অগাস্ট সেনা ও পুলিশ ফাঁড়িতে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার পর শুরু হয় রাখাইনে সেনা অভিযান; তাতে নির্বিচারে রোহিঙ্গাদের হত্যা ও ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছিল বলে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের ভাষ্য।
৩০ বছর বয়সী হামিদার বাড়ি মংডু জেলার কুয়াচং গ্রামে; বাংলাদেশের কক্সবাজারের সীমান্তে নাফ নদী ওপারে একটু ভেতরে এই গ্রামটি।
সেনা অভিযান শুরুর পর নিজেদের ভাগ্য নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যেই সন্তানের পৃথিবীর আলোতে আসার সঙ্কেত পাচ্ছিলেন হামিদা; কারণ ১০ মাস পেরিয়ে গেছে।
২ সেপ্টেম্বরওই গ্রামে ঢোকে সেনাবাহিনী; হামিদার ভাষায়, তারা রকেট লঞ্চার ছোড়ে, গ্রামটি জ্বালিয়ে দেয়। গ্রামবাসী পালানো শুরু করলে পেছন থেকে গুলিও ছোড়ে।
হামিদা ও তার স্বামী তাদের ছয় সন্তানকে নিয়ে পালিয়ে ঢোকেন বনে। সেখানে দুই দিন লুকিয়ে থাকেন তারা। এসময়ই ওঠে হামিদার প্রসব বেদনা। ভয় জাগে তার, কেননা সন্তানকে আনার কিছুই যে নেই তার।
হামিদা বলেন, প্রসব বেদনা ওঠার তিন ঘণ্টা পর তার শিশুটির জন্ম হয়; সুস্থভাবেই পৃথিবীতে আসে শিশুটি।
তবে সদ্যোজাত শিশুটির নাড়ি কাটার আগেই হঠাৎ গুলির শব্দ খুব কাছে থেকে শুনতে পান তারা; মানে সেনাসদস্যরা চলে আসছে। আবার পালাতে হল, ওই অবস্থাতেই।
হামিদা বলেন, “ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু কী করব? বাঁচতে হলে তো ছুটতেই হবে। তারা (সেনাসদস্য) ধরতে পারলে তো মেরে ফেলবে. মেরে ফেলবে এই শিশুটিকেও।”
আতঙ্ক আর উদ্বেগ নিয়ে ছুটতে থাকেন হামিদা। তার ভাষায়, কতদূর ছুটতে হবে, তাও জানা ছিল না। শুধু মনে হচ্ছিল, নিজের বাঁচতে হবে, শিশুটিকে বাঁচাতে হবে।
এরপর বনে নিরাপদ একটি জায়গায় আশ্রয় নেওয়ার পর স্বামী বাঁশের ফালি দিয়ে সন্তানের নাড়ি কাটেন বলে জানান হামিদা। মায়ের গর্ভ থেকে বিচ্ছিন্ন হয় শিশুটি। শিশুটির নাম রাখেন তারা ‘হোসেন সাহেব’।
খাবার নেই, পানি নেই, এই অবস্থায় বাংলাদেশের দিকে রওনা হন হামিদারা, প্রতিবেশী যে দেশটিতে ইতোমধ্যে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে।
হাঁটতে থাকেন হামিদা ও তার স্বামী, আগের ছয়টির সঙ্গে একটি বেড়ে সঙ্গে এখন সাতটি সন্তান; দুদিন হাঁটার পর পৌঁছেন নাফ নদীর তীরে।
নিজের দেশে যখন বিভীষিকাময় পরিস্থিতি; তখন বাংলাদেশি এক মাঝির সহৃদয়তার কথা বলেন হামিদা।
তিনি বলেন, তার এই অবস্থা দেখে মায়া হয় ওই মাঝির। নৌকায় করে তাদের নিয়ে আসেন এপারে, নিয়ে যান তার ঘরে। কয়েকদিন বাদে খাবার পান ওই মাঝির কল্যাণে।
ওই মাঝির বাড়িতে দুই রাত ছিলেন হামিদারা; ধকল সামলে তারা রওনা হন ঘুনধুম সীমান্তে শরণার্থী আশ্রয় কেন্দ্রে; সেখানে ৫০ হাজার রোহিঙ্গা সাময়িক আবাস গেঁড়েছে।
হামিদার স্বামী কয়েকটি বাঁশ ও পলিথিন কিনে থাকার একটা ঠাঁই করেছেন; ওই মাঝি একটি কম্বল দিয়েছিলেন তাদের, যা পেতে হয়েছে শয্যা।
রাখাইনে বঞ্চনার জীবন থেকে শরণার্থী হিসেবে অনিশ্চিত জীবনের সূচনা হল হামিদাদের।
“আমরা তো এখানে থাকতে চাই না, এভাবে থাকায় কি সুখ আছে? কিন্তু বাড়িতেই বা ফিরব কী করে? সেখানে তো গুলি খেয়ে মরতে হবে।”
হামিদার কান্নার সঙ্গে কেঁদে ওঠে দুঃসময়ে পৃথিবীতে আসা শিশু হোসেনও। “খিদে পেয়েছে তার, কিন্তু আমি তাকে কী খাওয়াব?” অসহায় কণ্ঠে বলেন হামিদা, যার নিজের দিনও এখন কাটছে কখনও খেয়ে, কখনও বা না খেয়ে।