পুরুষের জন্য নিরাপদ ও কার্যকর বড়ি শেষ পর্যন্ত নারীদের এককভাবে জন্মনিরোধ প্রক্রিয়া অবলম্বনের দায় থেকে মুক্তি দিতে পারে। এতে প্রতি বছর লাখ লাখ অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণ রোধ করা সম্ভব।
Published : 20 Feb 2023, 08:59 AM
পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার কারণ দেখিয়ে পুরুষের জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি বরাবর এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে বহু বছর ধরে। তাতে জন্মনিয়ন্ত্রণের পুরো দায় গিয়ে পড়ে নারীর ওপর। কিন্তু পুরুষের জন্য জন্ম নিরোধকে কেন হরেক ছুতো?
১৯৬৮ সাল। মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে এক তরুণ নিজের ব্রিবতকর অভিজ্ঞতা খুলে বলে। সিজোফ্রেনিয়ার চিকিৎসায় থিওরিডেজিন ওষুধে সেবন করতে হত ওই তরুণকে। এক সময় তিনি অবাক হয়ে খেয়াল করেন, তার যৌন জীবন শুকিয়ে যাচ্ছে।
তিন দশক পর ওই ঘটনা নতুন উদ্ভাবনের প্রেরণা হয়ে ওঠে। ওই ওষুধের মত কোনো একটি ওষুধ কি তবে পুরুষের জন্য জন্মনিরোধক বড়ির মত কাজ করবে?
শেষ পর্যন্ত গবেষকরা আরেকটি ওষুধের খোঁজ পেলেন, যা বীর্যপাত কমাতে সক্ষম। ফেনোজিবেনজামিন হল সেই ওষুধ, যা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করা হয়।
কিন্তু সুস্থ পুরুষের সেবনের জন্য এসব কোনো ওষুধই উপযুক্ত নয়।
গবেষকরা মূলত উৎসুক ছিলেন শরীরে এসব ওষুধের কার্যকারিতার প্রক্রিয়া জানতে। তাহলে ওই প্রক্রিয়া কাজে লাগিয়ে নতুন বড়ি বানানো যাবে।
অনেক বছর ধরেই গবেষণা চললো, যতক্ষণ না এই প্রক্রিয়া একটি অপ্রত্যাশিত জটিলতার মুখে পড়ল।
পুরুষের জন্য নিরাপদ ও কার্যকর বড়ি শেষ পর্যন্ত নারীদের এককভাবে জন্মনিরোধ প্রক্রিয়া অবলম্বনের দায় থেকে মুক্তি দিতে পারে। এতে প্রতি বছর লাখ লাখ অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণ রোধ করা সম্ভব।
কিন্তু অনেক পুরুষের কাছে ওই অদৃশ্য বীর্যপাত প্রক্রিয়া কোনো আবেদন বহন করল না। তাদের একাংশের কাছে মনে হল, এতে করে পুরুষত্বহীন করা হবে তাদের।
এক পর্যায়ে ওই গবেষণায় অর্থ যোগানো বন্ধ হল, গবেষকরাও পিছু হটলেন।
অবশ্য সম্প্রতি ইঁদুরের ওপর গবেষণা চালিয়ে চমকে দেওয়ার মত তথ্য পেয়েছেন গবেষকরা।
নতুন এক পিল তারা তৈরি করেছেন যা ঘণ্টা দুয়েকের জন্য শুক্রের সাঁতার কাটার ক্ষমতা বন্ধ রাখবে, কিন্তু পুরুষের হরমোনের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না।
এই উদ্ভাবন পুরুষের পিল নিয়ে এতদিনের অচলায়তন ভাঙার সম্ভাবনা রাখলেও মানুষের ব্যবহারে এর অনুমোদন পেতে আরও অনেক সময় লেগে যাবে।
প্রকৃতপক্ষে, একটি কার্যকর বড়ি তৈরি করা কখনই দুস্কর ছিল না।
গত অর্ধ শতকে পুরুষের জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ির অসংখ্য উপায় প্রস্তাব করা হয়েছে। এরমধ্যে কিছু মানুষের উপর প্রয়োগ করে পরীক্ষার মধ্যে দিয়েও গেছে।
এরপর প্রতিটি চেষ্টাই কোনো না কোনো দেয়ালে গিয়ে আটকেছে। নিরাপদ ও কার্যকর বড়ির বেলাতেও বলা হয়েছে, এর ‘অবাঞ্ছিত পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রয়েছে’।
একের পর এক পুরুষের জন্মনিরোধক বড়ি বাতিল করে দেওয়া হয়েছে এই যুক্তিতে যে সেগুলোতে নারীদের ব্যবহারের জন্মনিরোধক বড়ির মত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো আছে।
কেন পুরুষের জন্য জন্মনিরোধক বড়ি চালু করা এত কঠিন? এই প্রতিবদ্ধকতা কি বৈজ্ঞানিক? না সাংস্কৃতিক?
শরীরে বসেছে গর্ভনিরোধক যন্ত্র, জানতই না তারা
জন্ম নিয়ন্ত্রণ: দায়িত্ব কি শুধু নারীর?
প্রশ্ন যখন নৈতিকতার
কেন পুরুষের বেলায় কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া গ্রহণযোগ্য নয় তা বুঝতে পেছনের ইতিহাস জানতে হবে।
সেই ১৯৫০ সালের দিকে, যখন নারীর জন্য প্রথম বড়ি উদ্ভাবন করা হল; সেই যুগে ক্লিনিকাল ট্রায়ালের জন্য কোনো সার্বজনীন মানদণ্ড ছিল না। অতিরিক্ত ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোনের মিশ্রণে নারীর জন্য সেসব জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি বানানো হত। সেসব বড়ি বিভিন্ন দেশে ধারাবাহিকভাবে পরীক্ষা করা হলেও, সেগুলো নিয়ে বিতর্ক ছিল।
পুয়ের্তো রিকোতে দেড় হাজার নারীর উপর একটি পিলের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ হয়েছিল। ট্রায়ালে অংশ নেওয়া অর্ধেক নারী পরে সরে যান। তিন জনের মৃত্যুও ঘটে।
এরপরও এই বড়ি ১৯৬০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে অনুমোদন পায়।
১৯৬৪ সালের জুন মাসের পর সব কিছু বদলে যায়।
নুরেমবার্গ ট্রায়াল, অর্থ্যাৎ নাৎসি বাহিনীর কয়েকজন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে চিকিৎসার আড়ালে অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ সামনে আসার পর ওয়ার্ল্ড মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন চিকিৎসা শাস্ত্রে নৈতিকতা চর্চার নতুন নীতিমালার ওপর জোর দেয়।
যে কোনো ওষুধের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে অংশগ্রহণকারীকে সুরক্ষা দিতে চিকিৎসা শাস্ত্রের নৈতিকতার ধারা প্রকাশ করে হেলসিংকি ঘোষণাপত্র।
সেখানে ট্রায়ালে অংশগ্রহণকারীর গুরুত্ব সবার উপরে রাখার শর্ত দেওয়া হয়। ওষুধের সুবিধা পরীক্ষা করতে গিয়ে ক্ষতির ঝুঁকি বিবেচনা করতে বলা হয়।
যুক্তরাজ্যে অ্যাংলিয়া রাসকিন ইউনিভার্সিটির গর্ভনিরোধ ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক সহযোগী অধ্যাপক সুসান ওয়াকার বিবিসিকে বলেন, ”ওষুধের গবেষণা ও ঝুঁকি নিয়ে এখন একটা সামাজিক পরিবর্তন এসেছে।”
আগের সেই গর্ভনিরোধ পিল বাজারে চলে এসেছিল নীতিমালা প্রকাশের আগেই। নয়তো আজকের দিনে ওই বড়ির ছাড়পত্র পেতে কঠোর নিয়মের মধ্যে দিয়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হত।
এখনকার জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি নারীর জন্য নিরাপদ বলে ভাবা হয়; অথচ এর সেবনে উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিতে পারে। বিরল হলেও, রক্ত জমাট হওয়ার মত স্বাস্থ্য জটিলতাও হতে পারে।
এছাড়া মুড সুইং, বমি বমি ভাব, মাথা ব্যথা, স্তন ঝুলে যাওয়া এবং আরও নানা রকম ‘স্বল্প ঝুঁকির’ স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে এসব বড়ি সেবনে।
পুরুষের জন্মনিরোধক বড়ি পরীক্ষার মানদণ্ড অনেক উঁচু স্তরে বেঁধে রাখার পাশাপাশি পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তার দিকগুলোতে আরও বেশি গ্রহণযোগ্যতা দাবি করা হচ্ছে আরও একটি যুক্তিতে। তার তা হল, পুরুষ গর্ভধারণ করতে পারে না, গর্ভধারণ করে তার সঙ্গী নারী।
সুসান ওয়াকার বলেন, ”নিরীক্ষা করার ক্ষেত্রে নীতি কমিটি কীভাবে ঝুঁকি ও সুবিধা নিয়ে ভেবেছে তা আমাদের বুঝতে হবে। কারণ এ ট্রায়ালে দুজন মানুষ সম্পৃক্ত থাকেন, ওষুধটি পুরুষের ওপর প্রয়োগ হয়, কিন্তু নারী সঙ্গীটি গর্ভধারণের শারীরিক ঝুঁকি বহন করেন।”
যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় প্রতি বছর গর্ভধারণ ও প্রসবজনিত জটিলতায় ৭০০ নারীর মৃত্যু হয়। স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে গুরুতর মাতৃ অসুস্থতা দেখা দেয় ৫০ হাজার। সারা বিশ্বে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায় দুই লাখ ৯৫ হাজার নারী।
ট্রান্সজেন্ডার পুরুষ ছাড়া পুরুষের গর্ভধারণ সক্ষমতা নেই। সুরক্ষা ছাড়া যৌনক্রিয়ায় অংশ নিলেও তাদের অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের ভয় থাকে না।
১৯৭০ সালের দিকে গবেষকরা স্বেচ্ছাসেবকদের টেস্টোস্টেরন ইনজেকশন দিত। প্রতি সপ্তাহে এবং কয়েক মাস ধরে চলে এই প্রক্রিয়া। এরপর তাদের বীর্য উৎপাদনে কোনো প্রভাব পড়ল কি না পরীক্ষা করা হত।
এরপর দ্বিতীয় আরেকটি হরমোন প্রয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রোজেস্টিন নামের এই কৃত্রিম হরমোনটি নারীর প্রোজেস্টেরন হরমোনের মত।
সেসব হরমোন থেরাপিতে নানা পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া দেখা দিল; যা নারীদের কাছে মোটেও অপরিচিত ছিল না।
টেসটোস্টেরন থেকে ব্রণ, তৈলাক্ত ত্বক এবং মেদ দেখা দিল অনেকের। ফলে নিরীক্ষা আবারও বন্ধ হয়ে গেল।
তবে পুরুষের জন্মনিরোধক ইনজেকশন নিয়ে নিরীক্ষা সফল হয়েছিল বলে জানাচ্ছেন ওয়াকার। তাতে শুক্রাণুর ঘনত্ব কমিয়ে আনা গিয়েছিল কার্যকরভাবে।
”কিন্তু মুড বদল ও ত্বকে পরিবর্তন আসার মত পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার কারণে ওই নিরীক্ষা স্থগিত করা হয়। আমরা যারা নারীর গর্ভনিরোধক বড়ি নিয়ে কাজ করি, তাদের কাছে এসব পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া অবাক হওয়ার মত কিছু নয়।”
গ্রহণযোগ্যতার পথে
পুরুষের জন্য হরমোন ছাড়াই জন্মনিয়ন্ত্রণ ওষুধের বেশ কয়েকটি প্রস্তাবও এসেছে। এর মধ্যে ছিল বিশেষ এক ধরনের টিকা যা বীর্যর রূপান্তরে ভূমিকা রাখা প্রোটিনকে প্রভাবিত করতে পারে। এছাড়া সাময়িক ভ্যাসেক্টমি বা পুরুষের বন্ধ্যাকরণ অথবা আরআইএসইউজি (রিভার্সিবল ইনহিবিশন অফ স্পার্ম আন্ডার গাইডেন্স) ওষুধও রয়েছে হিসেবে।
আরআইএসইউজি এখনও ক্লিনিকাল ট্রায়ালের তৃতীয় ধাপে রয়েছে; যা নিরীক্ষার চূড়ান্ত পর্যায়। এই পর্বে সফল হলে ভারতে অনুমোদন পাবে ওষুধটি।
কিন্তু হরমোন নেই– এমন জন্মনিরোধক নিয়েও পুরুষদের মধ্যে অনাগ্রহ দেখা গেছে।
ওয়াকার বলেন, ”আমি পুরুষদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছি। তারা ভবিষ্যতে প্রজনন সক্ষমতা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন থাকে। উপরন্তু পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার বিষয়টিও রয়েছে, যা হয়ত ব্যবহারের কয়েক বছর পর ধরা পড়বে।”
আরও একটি বিষয় হল গবেষণার তহবিল। যে পিলটি নিরাপদ ও কার্যকর প্রমাণিত হয়েছিল, সেটি নিয়ে একটি জরিপ করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের অলাভজনক সংস্থা পারসেমাস ফাউন্ডেশন। তাতে অংশ নেওয়া ২০ শতাংশ পুরুষ বলেন, ওই জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করতে তারা আগ্রহী নন। একই সংখ্যক পুরুষ জানিয়েছেন তাদের অনাপত্তির কথা। জরিপে অংশ নেওয়া বাকি সংখ্যক পুরুষ তাদের সিদ্ধান্তহীনতার কথা বলেছিলেন। শেষ পর্যন্ত প্রাণি ও মানুষের উপর পরীক্ষা করে দেখার আগেই ওই পিলের গবেষণা অর্থায়ন হারায়।
ওয়াকার বলেন, পুরুষের জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে গবেষণায় অর্থায়ন করতে আগ্রহী এমন দাতব্য সংস্থাও রয়েছে। কিন্তু নারীর গর্ভনিরোধক বড়ি যখন ভালো ব্যবসা করছে, তখন ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো পুরুষের পিল নিয়ে আগ্রহী হবে কি না, তা নিয়ে তিনি সন্দিহান।
তিনি বলেন, “পুরুষের জন্মনিরোধকের ক্ষেত্রে এ পৃথিবী ঝুঁকি নিতে আগ্রহী নয়। পুরুষ ঝুঁকি বিমুখ, নীতিনির্ধারকরা ঝুঁকি বিমুখ এবং সম্ভবত ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোও ঝুঁকি বিমুখ।”
অন্তত ১৫ বছর ধরে জন্মনিরোধক ও প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে চলেছেন অধ্যাপক সুসান ওয়াকার। আগে তার মনে হত, পুরুষের জন্য এমন ওষুধ শিগগিরই বাজারে মিলবে। এখন তার সেই আশা ম্লান হয়ে যাচ্ছে।
“আমি এ নিয়ে আর একদমই আশাবাদী নই। প্রত্যেক পদ্ধতিই গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে গিয়ে আটকে যাচ্ছে।”
অবশ্য কে বলতে পারে, সম্প্রতি ইঁদুরের শুক্রাণু সাময়িকভাবে নিশ্চল করে দেওয়ার যে গবেষণাটি হয়েছে, সেই পথ ধরে এত দশকের প্রতিবন্ধকতা হয়ত জয় করাও সম্ভব হবে। তবে বিশ্বের সব নারীই ততদিন চুপ করে অপেক্ষায় থাকবে, তেমন নাও হতে পারে।
[বিবিসি থেকে বাংলায় ভাষান্তরিত]