জন্ম নিয়ন্ত্রণ: দায়িত্ব কি শুধু নারীর?

সন্তান জন্মদান প্রক্রিয়ায় নারী-পুরুষ দুজনের অংশগ্রহণ থাকলেও জন্ম নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বটি যে নারীদের উপরই চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, ভারতের প্রেক্ষাপটে তা উঠে এসেছে বিবিসির এক প্রতিবেদনে। বাংলাদেশের চিত্রও ভিন্ন নয়।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 July 2022, 07:02 PM
Updated : 16 July 2022, 07:02 PM

যখন রজনী শর্মা তার স্বামীকে জানালেন তিনি স্টেরিলাইজেশনের মাধ্যমে গর্ভনিরোধের কথা ভাবছেন, তখন স্বামী তাকে মানাই করে বসেন।

ভারতের উত্তর ভাগের লখনৌর রজনী শর্মা বলেন, “তিনি (স্বামী) বললেন, এটা তোমার শরীরে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।”

জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য এই দম্পতি আগে কনডম ব্যবহার করতেন। কিন্তু এতে শতভাগ নিশ্চয়তা নেই। কনডম ব্যবহারের পরও দুই বার অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন রজনী।

২৭ বছর বয়সে এখন তিন সন্তানের মা রজনী। আর সন্তান চান না। তাই স্থায়ী পদ্ধতির দিকে যেতে চান তারা।

কিন্তু দুজনের মধ্যে কে এই স্টেরিলাইজেশন পদ্ধতি নেবেন- স্বামী না কি স্ত্রী?

নিজেই স্বামীকে এই পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যেতে দিতে চাননি রজনী শর্মা। বললেন, “আমিই তাকে না করেছিলাম। তিনি এই পরিবারের উপার্জনকারী। স্টেরিলাইজেশন তাকে দুর্বল করে দেবে। তিনি এরপর তাহলে আর ভারী কাজ করতে পারবেন না।”

ফলে রজনীর ‍উপরই চাপছে গর্ভনিরোধের কাজটি।

ফেডারেশন অফ অবস্টেট্রিক অ্যান্ড গাইনিকোলজিকাল সোসাইটি অফ ইন্ডিয়ার সভাপতি এস শান্তা কুমারি বলেন, স্টেরিলাইজেশন বা ভাসেক্টমির মতো পদ্ধতি পুরুষকে বন্ধ্যা করবে এরকম গল্প ও ভুল ধারণার কারণেই তারা জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে অংশ নেয় না এবং পুরো দায়িত্ব তখন নারী কাঁধে চলে আসে।

“ভারতের সরকারি ও বেসরকারি জন্মনিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পুরোপুরি নারীকে কেন্দ্র করেই। আমার তো মনে হয়, এটা নারী ও পুরুষ উভয়েরই দায়িত্ব। তারা দুজনেই এই সিদ্ধান্তের অংশীদার। যদিও দায়িত্বটা সবসময় নারীকেই নিতে হচ্ছে।”

স্বাস্থ্য ও সামাজিক অবস্থা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ একটি জরিপ ২০১৯-২১ সালে পরিচালনা করে ভারত সরকার।

সেই জরিপে দেখা গেছে, ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী ৯৯ শতাংশ বিবাহিত পুরুষ ও নারী জন্ম নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিগুলো নিয়ে অবগত; যার মধ্যে রয়েছে নারী ও পুরুষের স্টেরিলাইজেশন, কনডম, পিল।

২০১৫-১৬ সাল থেকে ২০১৯-২১ সালের মধ্যে এর ব্যবহার ৪৭ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে ৫৬ দশমিক ৬ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে।  

কিন্তু প্রতি ১০ জন পুরুষের মধ্যে একজনেরও কম অর্থাৎ ৯ দশমিক ৫ শতাংশ কেবল কনডম ব্যবহার করে থাকে। স্টেরিলাইজেশন করানোর ক্ষেত্রে মূলত নারীকেই দেখা যায়।

এমনকি গত পাঁচ বছরে এতে নারীর অংশ নেওয়ার পরিমাণও বেড়েছে; ৩৬ শতাংশ থেকে এখন ৩৭ দশমিক ৯ শতাংশ নারী এই পদ্ধতি প্রয়োগ করছেন নিজের উপরে।

অন্যদিকে পুরুষের স্টেরিলাইজেশন তুলনামূলকভাবে নিরাপদ ও সহজ হওয়ার পরও মোটে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ এর প্রয়োগ করছেন নিজের ‍উপর।

জরিপে অংশ নেওয়া উত্তর প্রদেশ, বিহার ও তেলেঙ্গানা রাজ্যে ৫০ শতাংশ পুরুষ বলেছেন, গর্ভনিরোধ ‘নারীদের ব্যাপার’, পুরুষের এসব নিয়ে ‘মাথা ঘামানোর কিছু নেই’।

অন্ধ্র প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গের প্রতি তিন জনের একজন পুরুষ এবং কর্নাটকের ৪৫ শতাংশ পুরুষের ধারণাও একই রকম।

ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে (এনএফএইচএস-ফাইভ) থেকেও এমন চিত্রই পাওয়া যায়।

উত্তর প্রদেশ, বিহার, মধ্য প্রদেশ, ছত্তিশগড় এবং রাজস্থানে পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে নারীর সঙ্গে অসম আচরণ নিয়ে ২০১৭-২০১৯ সালের এক গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন অভিনব পান্ডে।

তার মতে, পরিবর্তন দেখতে চাইলে দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো খুব জরুরি।

“সবকটি রাজ্যেই আমরা দেখেছি পুরুষদের পরিবার পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ একেবারেই নগন্য। এর মূল কারণ অজ্ঞতা।”

তার ভাষ্যে, “স্টেরিলাইজেশন নিয়ে বহু ভুল ধারণা ছড়িয়ে রয়েছে। পুরুষ মনে করে এতে তাদের পুরুষত্ব কমে যাবে, ভারী কাজ করার সামর্থ্য থাকবে না। তাই কনডম তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য। যদিও অনেক পুরুষ বলছে কনডম বেশ অস্বস্তিকর এবং তারা এতে উপভোগ করতেও পারেন না।” 

সরকারি কর্মীরা গ্রামে এবং শহরে দরিদ্রদের মধ্যে বিনামূল্যেই কনডম বিলি করে থাকে। এটি পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমেরই অংশ। তাছাড়া এতে যৌন সংসর্গের কারণে হওয়া রোগের বিস্তারও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়।

যদিও জিবি প্যান্ট ইনস্টিটিউট অফ স্টাডিজ ইন রুরাল ডেভেলপমেন্টের আকাঙ্ক্ষা যাদব তেমনটা মনে করছেন না।

গ্রামের স্বাস্থ্যকর্মী ও কাউন্সিল সদস্যদের নিরাপদ গর্ভপাতের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন তিনি।

আকাঙ্ক্ষা বলেন, “অনেক ক্ষেত্রে ত্রুটিপূর্ণ কনডমের কারণে নারী গর্ভধারণ করে ফেলে। আবার যদি কনডম ঠিক মতো পরা না হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রেও এমন ঘটে তাকে। অথবা যখন স্বামীরা রাতে মদ্যপান করে ঘরে ফেরার পর কনডম পরতে চায় না, তেমন ক্ষেত্রেও নারীরা গর্ভধারণ করে। আর তারপর এটা নারীরই মাথাব্যথা হয়ে দেখা দেয়।”

ডা.. কুমারি বলেন, শুরুতে তিনি স্থায়ী বন্ধ্যাকরণের পরামর্শ না দিয়ে বরং অস্থায়ী বন্ধ্যাকরণ করতে বলেন। 

“যখন একজন দম্পতির দুই সন্তান হয়ে যায়, তখন আমি তাদের অস্থায়ী কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী স্টেরিলাইজেশন করাতে বলি। এবং কয়েক বছর পরে তারা পুনরায় সিদ্ধান্ত নিতে পারেন সন্তান নেবেন না কি স্থায়ী গর্ভনিরোধ করাবেন।”

নারীর জন্য দীর্ঘমেয়াদী গর্ভনিরোধ ইন্ট্রাইউটেরাইন ডিভাইস অথবা পিল পদ্ধতি। পুরুষের বেলায় এর প্রয়োগ একই রকম হয় না।

“বিশ্বের সব খানেই গবেষণা চলছে, পুরুষের জন্য দীর্ঘমেয়াদী অস্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বার করার কিন্তু এই মুহূর্তে বলার মতো কিছু নেই হাতে।”

অভিনব পান্ডে বলেন, এমন আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমকে পুরুষের কাছে পৌঁছানোর উপায় খুঁজে বার করতে হবে।

“তবে আচমকা সবকিছু বদলে যাবে এমন আশা করা যাবে না; কারণ পরিবর্তনটা খুব ধীর গতির হবে।”

তিনি বলেন, “পুরুষেরা উন্মুক্ত আসরে যৌনতা নিয়ে কথা বলতে চাইবে না। গ্রামের দিকে সরকারের স্বাস্থ্যকর্মীদের যারা ঘরে ঘরে কনডম বিলি করে বেড়ায় তারা বেশির ভাগই নারী; এদের সঙ্গে পুরুষদের আলাপের সুযোগ কমই হয়।

“ফলে আমরা পরামর্শ দিয়েছি, সরকার যেন পুরুষ কর্মীও নিয়োগ দেয়। তাতে গ্রামে পুরুষদেরও পরিবার পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ বাড়বে।”

২০১৬ সালে একটি সাময়িক প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল ভারতের ১৪৮টি জেলায়। এতে শাশুড়ি ও পুত্রবধূদের ডাকা হয়েছিল পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলতে।

তবে এমন আলোচনায় ২০১৯ সালে রাজস্থানে স্বামীদের ডাকা শুরু হয় বলে জানালেন পান্ডে। এর পরের বছর উত্তর প্রদেশেও তাই করা হয়।  

“এটি পুরুষদের অংশগ্রহণকে স্বাভাবিক করতে অনেকটাই কাজে দেয়। আমরা দেখতে পেলাম অনেক পুরুষ চিকিৎসকের সঙ্গে আলাপের সময় স্ত্রীর সঙ্গে থাকছেন। যদিও তারা জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিজে গ্রহণে তখনও অনীহা পোষণ করছেন।”

পরিবর্তন আনতে সরকার, চিকিৎসক এবং গণমাধ্যমকে হাতে হাত রেখে কাজ করতে হবে বলে মনে করছেন শান্তা কুমারি।

তিনি বলেন, “পরিস্থিতি না বদলালে পুরুষ তাদের দায়িত্ব এড়িয়েই যেতে চাইবে এবং গর্ভ নিরোধের সমস্ত দায় নারী কাঁধেই এভাবে বর্তাতে থাকবে।”