শাবির পাঠ্যসূচিতে আসছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ

একাত্তরের ৭ মার্চ যে ভাষণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন, সেই ভাষণকে অ্যাকাডেমিক সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

হোসাইন ইমরান, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Sept 2020, 05:59 AM
Updated : 14 Sept 2020, 07:13 AM

রোববার বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের ভার্চুয়াল সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমদ জানিয়েছেন।  

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের ইতিহাস’ শিরোনামে একটি কোর্সের অংশ হিসেবে এ ভাষণ পড়ানো হবে।”

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুসারে এবং হাই কোর্টের নির্দেশনায় ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ এই ভাষণকে প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করতে বলা হয়েছে।

সেই আলোকে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্তির জন্য ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণসহ ‘স্বাধীন বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের ইতিহাস’ শিরোনামে একটি কোর্স ডিজাইন করার নীতিগত সিদ্ধান্ত অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে নেওয়া হয়েছে বলে জানান উপাচার্য।

কোর্সটি কত ক্রেডিটের হবে, কীভাবে পড়ানো হবে, কোন বিভাগের অধীনে পড়ানো হবে- এসব বিষয় ঠিক করে কোর্স ডিজাইন করতে একটি কমিটিও করা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক মো. ফয়সল আহম্মদকে সভাপতি করে গঠিত ছয় সদস্যের ওই কমিটিতের অন্য সদস্যরা হলেন- বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. আশফাক হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক মো. আবু দেলোয়ার হোসেন, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আশ্রাফুল করিম, পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. জায়েদা শারমিন এবং সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক লাইলা আশারাফুন।

উপাচার্য জানান, এই কমিটির কাজ শেষ হলে অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।

অধ্যাপক আশ্রাফুল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মূলমন্ত্র। এটি একটি ঐতিহাসিক দলিল। ২০১৭ সালে এ ভাষণকে ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ হিসেবে ঘোষণা করেছে ইউনেস্কো। এ ভাষণ আমাদের প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জানা উচিত।”

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) স্বাধীনতাকামী ৭ কোটি মানুষকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”

তার ওই ভাষণের ১৮ দিন পর পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালি নিধনে নামলে বঙ্গবন্ধুর ডাকে শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। নয় মাসের সেই সশস্ত্র সংগ্রামের পর আসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

গেল বছর থেকে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের পাঠ্যসূচিতে ‘আত্মজৈবনিক রচনা’ শিরোনামে ২২৬ নম্বর কোর্সের অংশ হিসেবে পড়ানো হচ্ছে।  

 

রেসকোর্সে সেদিন

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা সেদিন ছিল মিছিলের শহর। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলে দলে মানুষ পায়ে হেঁটে, বাস-লঞ্চে কিংবা ট্রেনে চেপে রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হয়েছিলেন।

ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে লাখ লাখ মানুষে সয়লাব হয়ে গিয়েছিল বিশাল ময়দান। মুহুর্মুহু গর্জনে ফেটে পড়েছিলেন উত্থিত বাঁশের লাঠি হাতে সমবেত লাখ লাখ বিক্ষুব্ধ মানুষ। বাতাসে উড়ছিল বাংলার মানচিত্র আঁকা লাল সূর্যের অসংখ্য পতাকা।

বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর হাতাকাটা কালো কোট পরে বাঙালির প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু সেদিন দৃপ্তপায়ে উঠে আসেন রেসকোর্সের মঞ্চে। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে আকাশ-কাঁপানো স্লোগান আর মুহুর্মুহু করতালির মধ্যে হাত নেড়ে অভিনন্দন জানান অপেক্ষমান জনসমুদ্রের উদ্দেশে।

তারপর শুরু হয় সেই ঐতিহাসিক ভাষণ।

তিনি বলে চলেন- “... আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।”

বঙ্গবন্ধু বলেন, “...সৈন্যরা, তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের উপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না।”

উত্তাল জনসমুদ্র যখন স্বাধীনতার ঘোষণা শুনতে উদগ্রীব, তখন এরপর বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করেন তার চূড়ান্ত  আদেশ- “তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব- এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।”

মাত্র ১৯ মিনিটের সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে তুলে দেন অবিশ্বাস্য এক উচ্চতায়। এতে সামরিক আইন প্রত্যাহার, সৈন্যবাহিনীর ব্যারাকে প্রত্যাবর্তন, শহীদদের জন্য ক্ষতিপূরণ ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের চার দফা দাবি উত্থাপন করেন তিনি।

রেসকোর্স ময়দান থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি প্রচারের সব আয়োজন ছিল ঢাকা বেতার কর্তৃপক্ষের। প্রচার শুরুও হয়েছিল। কিন্তু সামরিক কর্তৃপক্ষ প্রচার বন্ধ করে দিলে বেতারের সব বাঙালি কর্মচারী বেতার ভবন ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। বন্ধ হয়ে যায় সব ধরনের সম্প্রচার কার্যক্রম।

ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে নানা গুজব। গভীর রাতে অবশ্য সামরিক কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুর পূর্ণ ভাষণ সম্প্রচারের অনুমতি দিতে বাধ্য হয়।