মায়ের জন্য সঠিক পুষ্টি

গর্ভাবস্থা থেকে শুরু করে একটি সন্তান জন্ম দেওয়া ও তার লালনপালন করার জন্য একজন মাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হয়।

তৃপ্তি গমেজবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 May 2015, 09:12 AM
Updated : 10 May 2015, 09:23 AM

সন্তানের যত্ন নিতে গিয়ে অনেক সময়ই মা নিজের যত্ন নিতে ভুলে যান। ফলে নানারকম সমস্যা দেখা দেয়, স্বাস্থ্যহানী ঘটে।

মায়ের সুস্থতার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পুষ্টি বিষয়ে কথা বলেন বাংলাদেশ গার্হস্থ্যঅর্থনীতি কলেজের ‘শিশু বিকাশ ও সামাজিক সম্পর্ক’ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রুমানা বাসার।

তিনি বলেন, “একজন মা যে কেবল মাত্র গর্ভকালীন অবস্থায় নিজের যত্ন নেবেন তা নয়। স্তন্যদানেরসময় এমনকি সন্তান যখন একটু বেড়ে উঠে অর্থাৎ প্রাক-স্কুলগামী পর্যায়েও মাকে সন্তানের পাশাপাশি নিজের যত্ন নিতে হয়।”

অধিকাংশ মা এই বিষয়ে উদাসীন বলে ৩৫ বছরের পরেই তাদের হাড়ের ক্ষয়সহ নানারকমের শারীরিক অসুস্থতা দেখা দেয়।

ছবি সৌজন্যে: ওয়েডিং ডায়েরি বাংলাদেশ।

গর্ভাবস্থায় মায়ের যত্ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “গর্ভস্থ সন্তানের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির জন্য মায়ের পুষ্টির চাহিদা, স্বাভাবিকের থেকে অনেক খানি বেড়ে যায়। তাই এই সময় মায়ের সঠিক পুষ্টি সরবারহ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।”

এ সময় মায়ের খাদ্যাভ্যাসের বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেন রুমানা বাসার।

- গর্ভাবস্থায় গর্ভকালীন হরমনের ক্ষরণ বেড়ে যাওয়ায় মাকে অতিরিক্ত খাবার ও ক্যালোরি দেওয়া প্রয়োজন। গর্ভকালীন শেষ তিন মাসে ভ্রূণের বর্ধন দ্রুত হয় বলে এই সময় সব ধরণের পুষ্টি উপাদান সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয়।

- গর্ভের সন্তানের অঙ্গ ও গ্রন্থির গঠন, বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য অতিরিক্ত প্রোটিন প্রয়োজন হয়। গর্ভাবস্থার শেষ তিন মাসে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ গ্রাম অতিরিক্ত প্রোটিন গ্রহণের পরামর্শ দেন রুমানা বাসার।

- ভ্রুনের অস্থির গঠন ও দৃঢ়তার জন্য ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস দরকার। গর্ভাবস্থায় ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি’র অভাব হলে মায়ের হাড় থেকে ক্যালসিয়াম ভ্রুনের দেহে ব্যবহৃত হয়, এর ফলে মায়ের হাড় ধীরে ধীরে দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়ে যায় অর্থাৎ অস্টিওপোরোসিস দেখা দেয়। তাই মায়ের উচিত প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসজাতীয় খাবার গ্রহণ করা।

- গর্ভাবস্থায় মায়ের দেহে লৌহের চাহিদা বেড়ে যায়। লৌহের অভাবে মায়ের রক্ত স্বল্পতা দেখা দেয়।

- এইসময় মৌল বিপাক হাড় ও থাইরয়েড হরমোনের ক্ষরণ বেড়ে যায়, তাই দৈনিক ১২৫ মাইক্রোগ্রাম আয়োডিন গ্রহণ করা উচিত।

- এছাড়াও এই সময়ে ভিটামিন এ, বি, থায়ামিন, রিভোফ্লাভিনসহ অন্যান্য ভিটামিনের চাহিদা বেড়ে যায় বলে জানান রুমানা বাসার।

গর্ভবতী মায়ের যে ধরণের খাদ্য খাওয়া প্রয়োজন

- এইসময় বাড়তি ক্যলরির চাহিদা পূরণের জন্য প্রতিদিন ৫০ গ্রাম শস্যজাতীয় খাদ্য ও পাঁচ গ্রাম তেল খাওয়া প্রয়োজন। গর্ভাবস্থায় প্রথম তিন মাসে দৈনিক ১০ ক্যালরি, দ্বিতীয় তিন মাসে দৈনিক ৯০ ক্যালরি ও শেষ তিন মাসে দৈনিক ২০০ ক্যালরি গ্রহণ করা উচিত।

- গর্ভকালীন ৯ মাসে মায়ের প্রকৃত ওজন ১০ থেকে ১১ কেজি বৃদ্ধি পাওয়া স্বাভাবিক। তবে ওজন বেশি বৃদ্ধি পেলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে বলে জানান রুমানা বাসার।

- ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের জন্য এক গ্লাস দুধ বা ৫০ গ্রাম ছোট মাছ, ২০০ গ্রাম সবুজ শাকসবজি, ভিটামিন এ’র জন্য রঙিন সবজি, কলিজা, ভিটামিন ডি’র জন্য কড মাছের যকৃতের তেল, তৈলাক্ত মাছ খাওয়া উচিত। 

- প্রোটিনের চাহিদা মেটানোর জন্য ডিম, মাছ, মাংস; লৌহ ও ফলিক অ্যাসিডের জন্য কলিজা, সবুজ শাক, টমেটো; ভিটামিন সি’র জন্য আমলকী, পেয়ারা, লেবু খাওয়া জরুরি।

- গর্ভবতী মায়ের দেহে ও জরায়ুতে রসের পরিমাণ বেড়ে যায় তাই প্রচুর পরিমাণে পানি পান করা দরকার।

গর্ভাবস্থায় অনেকেই একবারে বেশি খেতে পারেন না। তাই তাদেরকে একটু পর পর খাওয়ার পরামর্শ দেন রুমানা বাসার।

স্তন্যদানকারী মায়ের যত্ন প্রসঙ্গের রুমানা বাসার বলেন, “গর্ভবতী মায়ের তুলনায় স্তন্যদানকারী মায়ের পুষ্টি চাহিদা বেশি। এই সময় মাকে প্রচুর ক্যালরি ও তরলজাতীয় খাবার খেতে দিতে হবে।”

- দুধের প্রোটিন তৈরির জন্য মায়ের অতিরিক্ত প্রোটিন গ্রহণ করা প্রয়োজন।

- মায়ের খাদ্যে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি হলে মায়ের হাড়ের ক্যালসিয়াম দুধের ক্যালসিয়াম তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। ফলে মা অসুস্থ হয়ে পরেন। তাই মায়েদের খাবারে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়ামজাতীয় খাবার রাখা উচিত।

- ৮৫০ মি.লি মায়ের দুধে ৩০০ মাইক্রোগ্রাম রেটিনল বা ভিটামিন এ থাকে। তাই প্রতিদিন অতিরিক্ত ৩০০ মি.গ্রা ভিটামিন এ খাওয়া প্রয়োজন।

- এই সময় মায়ের তরলজাতীয় খাবার বেশি খাওয়া প্রয়োজন। তাছাড়া নিয়মিত পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম নেওয়াও জরুরি।

ছবি সৌজন্যে: ওয়েডিং ডায়েরি বাংলাদেশ।

স্তন্যদানকারী মায়ের যে ধরণের পুষ্টি প্রয়োজন

- খাদ্যের ৫টি বিভাগ থেকে নির্ধারিত খাদ্য খাওয়ার পরিমাণ বাড়াতে হবে।

- দুধ ও দুধজাতীয় খাবার, যেমন- ক্ষীর, পায়েস, দই, মিষ্টি ইত্যাদি থেকে প্রোটিন, ক্যালসিয়াম ও রিবোফ্লেভিনের চাহিদা মেটানো সম্ভব।

- ক্যারোটিন, ক্যালসিয়াম ইত্যাদির জন্য সবুজ ও হলুদ রংয়ের শাকসবজি খাওয়ার পরিমাণ বাড়াতে হবে।

- শিশুকে দুধ খাওয়ানোর আগে ও পরে মাকে তরলজাতীয় খাবার খেতে হবে। এতে মায়ের শরীরের পানির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।

প্রাক-স্কুলগামী ও স্কুলগামী শিশুর মায়েদের যত্ন

রুমানা বাসার বলেন, “এইসময় শিশুরা খুব চঞ্চল হয়। মাকে প্রায় সারাক্ষণই শিশুর পেছনে ছোটাছুটি করতে হয়। তাই এই সময়ও মায়ের নিজের প্রতি বিশেষ যত্ন নেওয়া উচিত।”

এই সময় মায়েদের ক্যালরি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেন রুমানা বাসার। এর পাশাপাশি ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খেতে বলেন। কারণ দুরন্ত সন্তানের পেছনে ছুটাছুটি করার জন্য দ্রুত হাড়ক্ষয় দেখা দিতে পারে মায়ের।

কেবলমাত্র সঠিক উপায়ে সঠিক পুষ্টি গ্রহণ করার মাধ্যমে মায়ের অকাল বার্ধক্য কমিয়ে আনা সম্ভব বলে তিনি জানান।

কর্মজীবী মায়েদের ঘরে বাইরে সব কাজই সময়মতো ঠিকঠাক সামলে নিতে হয়। এর জন্য মাকে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয়। নানান কাজের ভীড়ে মা নিজের যত্ন নিতে পারেন না। এমনকি সঠিক পরিমাণ খাদ্যও গ্রহণ করতে পারেন না।

তাই কর্মজীবী মায়েদের কিছুক্ষণ পর পর খাবার খেতে হবে। অর্থাৎ অফিসে ও বাড়িতে কাজের ফাঁকে টিফিনের মতো করে বিভিন্ন ধরনের পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে।

যে সকল নারীরা একটু বেশি বয়সে মা হন তাদের ক্ষেত্রে খাবারের তালিকাটা কিছুটা ভিন্ন হয়। তাদের খাবারের তালিকায় প্রোটিনজাতীয় খাবার কিছুটা কম রাখার পরামর্শ দেন রুমানা বাসার। এছাড়াও তিনি ওই সকল মায়েদের সঠিকভাবে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ডায়েট মেনে চলতে বলেন।