জলমগ্ন রাতারগুল

জলাভূমির মধ্যে কোমর ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি গাছের বিশাল এক জঙ্গল। এতই ঘন জঙ্গল যে ভেতরের দিকটায় সূর্যের আলো গাছের পাতা ভেদ করে জল ছুঁতে পারে না।

মুস্তাফিজ মামুনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 August 2013, 11:22 AM
Updated : 11 August 2013, 11:29 AM

অনেকে একে বাংলাদেশের আমাজনও বলে থাকেন। বনের আসল নাম রাতারগুল। এখানে গাছের ডালে ডালে ঘুরে বেড়ায় নানান বন্য প্রাণী আর পাখি। শীতে জল শুকিয়ে যায় বলে বর্ষা এবং বর্ষাপরবর্তী সময় (জুলাই থেকে অক্টোবর) রাতারগুল ভ্রমণের উপযুক্ত সময়। 

সিলেট শহর থেকে রাতারগুলের দূরত্ব প্রায় ২৬ কিলোমিটার। জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলায় এ বনের অবস্থান। সিলেট বন বিভাগের উত্তর সিলেট রেঞ্জে-২ এর অধীন প্রায় ৩০ হাজার ৩শ’ ২৫ একর জায়গা জুড়ে এ জলাভূমি। এর মধ্যে ৫শ’ ৪ একর জায়গার মধ্যে বন, বাকি জায়গা জলাশয় আর সামান্য কিছু উঁচু জায়গা। তবে বর্ষাকালে পুরো এলাকাটিই পানিতে ডুবে থাকে। শীতে প্রায় শুকিয়ে যায় রাতারগুল। তখন বনের ভেতরে খনন করা বড় জলাশয়গুলোতে শুধু পানি থাকে।

পুরান দুটি বড় জলাশয় ছাড়াও ২০১০-১১ সালে রাতারগুল বনের ভেতরে পাখির আবাসস্থল হিসেবে ৩.৬ বর্গকিলোমিটারের একটি বড় লেক খনন করা হয়। শীতে এ জলাশয়ে বসে নানান পাখির মিলন মেলা।

রাতারগুল একটি প্রাকৃতিক বন। এরপরেও বন বিভাগ হিজল, বরুণ, করচ আর মুতা-সহ কিছু জলবান্ধবজাতের গাছ লাগিয়ে দেয় এ বনে। এছাড়াও রাতারগুলের গাছপালার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল— কদম, জালিবেত, অর্জুনসহ জলসহিষ্ণু প্রায় ২৫ প্রজাতির গাছপালা।

সিলেটের শীতলপাটি তৈরির মূল উপাদান মুতার বড় অংশ এই বন থেকেই আসে। বাংলাদেশ বন বিভাগ ১৯৭৩ সালে এ বনের ৫শ’ ৪ একর এলাকাকে বন্যপ্রাণীর জন্য অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা করে।

এখানে আছে নানান প্রজাতির পাখি। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল— মাছরাঙা, বিভিন্ন প্রজাতির বক, ঘুঘু, ফিঙে, বালিহাঁস, পানকৌড়ি ইত্যাদি।

বন্যপ্রাণীর মধ্যে আছে— বানর, উদবিড়াল, কাঠবেড়ালি, মেছোবাঘ ইত্যাদি। বিভিন্ন প্রজাতির গুঁইসাপ ও নানান ধরনের সাপের অভায়শ্রম এই বন।

রাতারগুলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য লেখায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এই বনের সুধা নিতে হলে যেতে হবে সেখানে। জঙ্গলের একেবারে শুরুর দিকটায় মুতার বন। এর বেশির ভাগই জলে ডুবে থাকে বর্ষায়। এর পরেই শুরু আসল বন।

যতই গহীনে যাওয়া যাবে ততই গাছের ঘনত্ব বাড়তে থাকবে। অনেক জায়গাতেই সূর্যের আলো পৌঁছায় না। দুই-একদিন বৃষ্টি না হলে পানি এত বেশি স্বচ্ছ হয় যে, বনের সবুজ প্রতিবিম্বকে মনে হয় বনের নিচে আরেকটি বন।

যেভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে প্রথমে যেতে হবে সিলেট শহর। সড়ক, রেল ও আকাশ পথে ঢাকা থেকে সরাসরি সিলেট আসতে পারেন। চট্টগ্রাম থেকেও সিলেটে আসা যায়। ঢাকা থেকে গ্রীনলাইন পরিবহন, সোহাগ পরিবহন, সৌদিয়া পরিবহনের এসি বাস যায় সিলেটে। ভাড়া ৮শ’ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা।

এছাড়া ঢাকার ফকিরাপুল, কমলাপুর, সায়দাবাদ প্রভৃতি জায়গা থেকে শ্যামলী পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, সৌদিয়া, মামুন পরিবহন, সিলকম পরিবহন ইত্যাদি সংস্থার নন-এসি বাসও সিলেটে যায়। ভাড়া ৩শ’ টাকা থেকে ৫শ’ টাকা।

ঢাকার কমলাপুর থেকে মঙ্গলবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে ছেড়ে যায় আন্তঃনগর ট্রেন পারাবত এক্সপ্রেস। সপ্তাহের প্রতিদিন দুপুর ২টায় ছাড়ে জয়নন্তিকা এক্সপ্রেস।

বুধবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন রাত ৯টা ৫০ মিনিটে ছাড়ে উপবন এক্সপ্রেস। শ্রেণিভেদে ভাড়া ১৫০ টাকা থেকে ১ হাজার ১৮ টাকা।

চট্টগ্রাম থেকে সোমবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৮টায় সিলেটের উদ্দেশে ছাড়ে পাহাড়িকা এক্সপ্রেস। শনিবার ছাড়া প্রতিদিন রাত ৯টায় যায় উদয়ন এক্সপ্রেস। ভাড়া ১৯০ টাকা থেকে ১ হাজার ১শ’ ৯১ টাকা।

সিলেট শহর থেকে বিভিন্ন পথে রাতারগুল যাওয়া সম্ভব। তবে পর্যটকরা দুটি পথ ব্যবহার করতে পারেন। রাতারগুলের সবচেয়ে সহজ আর সুন্দর পথটি হল— সিলেট শহরের পাশেই খাদিম চা বাগান আর খাদিমনগর জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে। খুব অল্প সময়েই এই পথ ধরে রাতারগুল পৌঁছানো সম্ভব।

সিএনজি অটোরিকশা বা জিপ নিয়ে আসতে হবে শ্রীঙ্গি ব্রিজ। সকালে গিয়ে বিকেলের মধ্যেই বন ঘুরেফিরে আসা যায়। সারাদিনের জন্য একটি  সিএনজি বা অটোরিকশার ভাড়া পড়বে ১২শ’ টাকা থেকে ১৫শ’ টাকা।

সিলেট শহরের আম্বরখানা থেকে লোকাল সিএনজিতে গেলে জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ১শ’ টাকা।

শ্রীঙ্গি ব্রিজ থেকে রাতারগুল জঙ্গলে ঢুকতে হবে জেলেদের ছোট নৌকায়। একটি নৌকায় ৪ থেকে ৬ জন ঘুরে বেড়ান সম্ভব। ভাড়া লাগবে ৪শ’ টাকা থেকে ৮শ’ টাকা।

এছাড়া রাতারগুল যাওয়ার অন্য পথটি হচ্ছে সিলেট-জাফলংয়ের গাড়িতে চড়ে নামতে হবে সারিঘাট। ভাড়া ৪০ টাকা থেকে ৫০ টাকা। সেখান থেকে সিএনজি চালিত বেবিটেক্সিতে চড়ে গোয়াইনঘাট বাজার। এখান থেকে নৌকা ভাড়া করে যেতে হবে রাতারগুল। ১০ থেকে ১২ জনের উপযোগী সারাদিনের জন্য একটি নৌকার ভাড়া পড়বে ৮শ টাকা থেকে ১২শ’ টাকা।

সারি নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে এ পথটি অনুসরণ করতে পারেন। তবে খরচ আর সময়, দুটোই বেশি লাগবে এ পথে।

রাতারগুলে যেতে যে পথই অনুসরণ করুন না কেন, বনে ঢুকতে লাগবে জেলেদের ছোট নৌকা।

থাকার জায়গা

সিলেট শহরে রাতে থাকার জন্য বিভিন্ন মানের হোটেল আছে। শাহজালাল উপশহরে পাঁচ তারকা মানের হোটেল রোজ ভিউ। নাইওরপুল এলাকায় হোটেল ফরচুন গার্ডেন। জেল সড়কে হোটেল ডালাস। ভিআইপি সড়কে হোটেল হিলটাউন। লিঙ্ক রোডে হোটেল গার্ডেন ইন।

শহরের বাইরে বিমানবন্দর সড়কে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের পর্যটন মোটেল। খাদিম নগরে জেসটেট হলিডে রিসোর্ট। শুকতারা প্রকৃতি নিবাস। নাজিমগড় রিসোর্ট ইত্যাদি।

এসব হোটেল রিসোর্টে ৮শ’ টাকা থেকে ২০ হাজার টাকায় থাকার ব্যবস্থা আছে।

সাবধানতা

রাতারগুলের সৌন্দর্য উপভোগ করার সবচেয়ে ভালো সময় বর্ষাকাল বা বর্ষার পরের মৌসুম। এটি জলাবন বলে ভ্রমণকালীন কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত। বর্ষায় বন ডুবে গেলে বেশিরভাগ সাপ আশ্রয় নেয় গাছের ডাল কিংবা শুকনা অংশে। তাই চারপাশ খেয়াল রেখে চলতে হবে। এছাড়া জোঁকেরও উপদ্রব আছে। সাঁতার না জানলে সঙ্গে লাইফ জ্যাকেট রাখা জরুরি।

বর্ষাকালে গেলে সঙ্গে ছাতা, রেইনকোট কিংবা পঞ্চো সঙ্গে নিতে হবে।

আলোকচিত্র: লেখক