রমজানে সঠিক পুষ্টি

রোজার মাসে নিয়মিত জীবনযাপনে আসে পরিবর্তন। ভাজাপোড়া খাওয়া বাড়ে। পাল্টে যায় ঘুমের সময়। এই একমাস তাই শারীরিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য প্রয়োজন সঠিক পুষ্টি। এই বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন পুষ্টিবিদ আসফিয়া আজিম।

.বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 July 2013, 08:00 PM
Updated : 16 July 2013, 08:00 PM

রোজার মাসে সারাদিনের সংযম আর সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত প্রচুর তেলে ভাজা, মসলাদার সুস্বাদু খাবারের সমারোহ। আর মাসটা শেষ হলেই ঈদ। প্রচুর মিষ্টি, সেমাই, পায়েসের ছড়াছড়ি। মন ভরে খাওয়া আর কদিন পরেই ওজন মেশিনের দিকে তাকিয়ে মুষড়ে পড়া।

অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় সারামাসের সংযমের ফলাফল ওজন বৃদ্ধি। চুল ও ত্বকে বাড়ে মলিনতা আর শরীরজুড়ে নেমে আসে অবসাদ। ক্লান্তি, ওজন বাড়া, মলিন চেহারার আসল কারণ কি তাহলে রোজা রাখা? তা কিন্তু নয়। বরং আমাদের বেহিসেবি খাওয়া আর অনিয়ন্ত্রিত জীবনধারাই এর কারণ।

মনে রাখতে হবে, আমাদের শরীরের মেটাবলিক সিস্টেম বা বিপাকীয় ব্যবস্থা বিকেলের পর থেকে ধীর হয়ে আসে। দিনের বেলায় খাবার যত তাড়াতাড়ি হজম হয়, সন্ধ্যার পর হজমের এই গতি কমে যায় অনেক। এ কারণে পুষ্টিবিশেষজ্ঞরা সন্ধ্যার পর হালকা ও সহজপাচ্য খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

তবে রোজার মাসে সেটা সম্ভব হয় না। ক্ষুধাকে পরিতৃপ্ত করতে দেখা যায়, আমরা ইফতারিতে হরেক রকম খাবার খেয়ে ফেলি। আর সন্ধ্যার পর হজমের গতি কমে আসে বলে প্রয়োজনীয় ক্যালরির অতিরিক্তটুকু জমা হয়ে যায় চর্বি হিসেবে। অন্যদিকে অতিরিক্ত তেলে ভাজা ও চর্বিজাতীয় খাবার খাওয়ার ফলে শরীরে অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের ঘাটতি দেখা দেয়। উপরন্তু রোজা থাকার ফলে শরীরে পানি বা তরলের কমতি ঘটে। পানির অভাবে বা কমতির জন্য শরীরের বর্জ্য ঠিকভাবে বের হতে পারে না। ফলে চুল বা ত্বক হারিয়ে ফেলে স্বাভাবিক সজীবতা।

রোজার রোজনামচা

ইফতারির আয়োজন থেকেই শুরু করা যাক। শরবতে চুমুক দিয়েই শুরু হয় রসনা বিলাস। সারাদিনের তৃষ্ণার্ত শরীর পরিতৃপ্ত হয় শরবত পানের মধ্য দিয়ে। তাই এই পানিয় ঘরে বানানো তাজা ফলের বা সবজি হওয়া চাই। এখন যেহেতু মৌসুমি ফলের মাস তাই প্রায় প্রতিদিনই ঘরে তৈরি শরবত খাওয়ার এটাই উপযুক্ত সময়। আম, কমলা, তরমুজ, বাঙ্গি, ফুটি, পেঁপে, লেবু-- যে কোনো একটি ফলের রস দিয়েই শুরু করা যায় ইফতার। তবে শরবতে অতিরিক্ত চিনি ব্যবহার না করে মুখ মিষ্টি করার মতো চিনি ব্যবহারই ভালো। দেশীয় ফলে যেহেতু ‘সুক্রোজ’-এর মাত্রা অনেক বেশি তাই আলাদাভাবে চিনি যুক্ত করার ফলাফল ওজনাধিক্য।

রোজাতে শরীরে অতিরিক্ত পানির চাহিদা তৈরি হয়। তাই শরবতের পরই শশা, খেজুর এগুলো খাওয়া যেতে পারে। তবে খেজুর দু-তিনটির বেশি খাওয়া ঠিক না। কারণ এতেও সুক্রোজের পরিমাণ অনেক। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য খেজুরের বরাদ্দ কেবল দুটো।

অঙ্কুর ওঠা কাঁচাছোলা ভিটামিন সি-র খুব ভালো উৎস। প্রতিদিনের ইফতারির মেন্যুতে কাঁচাছোলাটা তাই নিশ্চিত করুন।

সারাদিনের অনাহারের পর ভাজাপোড়া, তেল-মসলা শরীরের জন্য একদমই ভালো না। তা খেতে যতই মুখরোচক হোক না কেন। ইফতারিতে তাই দই-চিঁড়া, দুধ-কলা-ভাত বা দই-চিঁড়া-ফলের কাস্টার্ড শরীরের জন্য খুবই ভালো। আর্দ্র আবহাওয়ায় এই ধরনের সহজপাচ্য খাবারগুলো শরীরকে ঠান্ডা করে আর ত্বকের সজীবতা ধরে রাখে।

ইফতারিতে যদি একটু পেঁয়াজু, বেগুনি বা ছোলা না খেলে যদি অসম্পূর্ণ মনে হয়, তবে দই-চিঁড়া বা ফলাহারের পর সামান্য ভাজাপোড়া চলতে পারে। তবে এগুলো যত কম খাওয়া যায় ঈদের সময় সৌন্দর্য ততই বাড়বে।

ইফতারের পর থেকে রাতের খাবারের সময় পর্যন্ত পানি বা তরলের সরবরাহ নিশ্চিত করতে স্যুপ, জুস, ফল, দই, লাচ্ছি, সালাদ এগুলো বারবার খাওয়া যেতে পারে।

রোজার কটা দিন রাতের খাবার খাওয়ার ক্ষেত্রে একটু বিশেষ নজর দিন। ইফতারির ভুঁড়িভোজের পর স্বাভাবিকভাবেই রাতের খাবার খেতে খেতে বেশ রাত হয়ে যায়। আর রাত যত বাড়তে থাকে আমাদের পরিপাকক্রিয়ার ক্ষমতা ততই কমে আসতে থাকে। এ কারণে রোজার সময়টাতে রেডিমিট বা মাংসের তৈরি রান্না একটু এড়িয়ে চলাই ভালো। রাতের খাবার তালিকায় গ্রিলড-চিকেন বা পেপারড-চিকেন অথবা মাছ সঙ্গে ভাত বা রুটি, সবজি, ডাল এগুলো রাখা যেতে পারে।

সেহরি ভোররাতের খাওয়া, আর সারাদিনের রসদ জোগানো হয় এই খাবার থেকেই। তাই এ সময় চিকিৎসকের পরামর্শ মেনেই পছন্দ ও রুচিমতো খাবার খাওয়া যেতে পারে। তবে সেহরিতে এক গ্লাস দুধ খেতে পারলে তা সারাদিনের প্রোটিনের একটা বড় অংশই পূরণ করে দেয়।

এভাবে রোজার সারাটা মাস যদি সংযমের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করা যায় তবে  চাঁদরাতে চাঁদের পাশাপাশি আপনিও ঝকমক করে উঠবেন নিশ্চিতভাবে। তবে এই দীপ্তি সারা বছর বজায় থাকবে যদি ঈদ উৎসব ছাড়াও পরবর্তী সময়গুলোতে একটু মেপে রসনা সংবরণ করে চলা যায়।

ছবি : সাকিব-উল-ইসলাম