নৌকার হাট বাজার

বরিশালে যাওয়ার উদ্দেশ্যই ছিল সাতলা বিলের লাল শাপলা দেখব আর ছবি তুলবো। বিধি বাম- খবর পেলাম কলিতেই পড়ে আছে শাপলা। কি আর করা, কুরিয়ানা বা ভীমরুলি পেয়ারা বাগানে যাব? নাকি ঝালকাঠি গিয়ে ধানসিঁড়ি নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করবো- এমন সিদ্ধান্ত নেওবার আগেই দেখা হয় আলোকচিত্রী শফিকুল আলম কিরণের সঙ্গে। তার কাছ থেকেই জানা গেল আটঘরের ভাসমান নৌকার বাজারের গল্প। তাই সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হল না, নৌকার হাট দেখতেই রওনা হলাম।

ফারুখ আহমেদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 August 2017, 10:05 AM
Updated : 4 August 2017, 10:05 AM

ঢাকার কাইক্কার টেকেও নৌকা বিকিকিনি হয়। তবে সেটা ছোট পরিসরে। আর সেটা ভাসমান নয়। আটঘরের নৌকার বাজার ভাসমান। মানে ভাসতে ভাসতে কিনবেন নৌকা। আর সেই নৌকায় চড়ে চলে যাবেন ঘরে। সেখানকার মানুষেরা অন্তত তাই করে।

ভীমরুলির পেয়ারার বাজার থেকে একটু পেছনে ফিরে মাহমুদকাঠি হয়ে ডানের সরু খালের ভেতর দিয়ে আটঘর যেতে হচ্ছিল। এখানকার পানিতে কচুরিপানা আর ময়লা অনেক বেশি। বারবার ইঞ্জিনের পাখায় ময়লা আটকে ট্রলার বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। তবে মেঘলা দিন আর দুপাশের সৌন্দর্য মিলে এই বিড়ম্বনা গায়েই লাগলো না। আধা ঘণ্টার পথ তিন ঘণ্টায় পেরিয়ে একসময় কুরিয়ানা পৌঁছে যাই। এখানেই প্রথম দেখা হয় নৌকা বোঝাই ট্রলারের। এসব নৌকা আটঘরের নৌকার বাজারে যাচ্ছে।

হাটের দিকে যাচ্ছে নৌকা বোঝাই ট্রলার।

আমরা সম্ভবত দুপুর দেড়টার দিকে কুরিয়ানার পেয়ারার বাজার পেছনে ফেলে আটঘর ভাসমান নৌকার বাজারে পৌঁছি। বহুদূর থেকে দেখতে পাই নৌকায় সয়লাব সন্ধ্যা নদীর শাখা কুরিয়ানার জল। 

নদীর তীরে মানুষের ভীড়। পাড় জুড়ে যেন মেলা বসেছে। আটঘরের রাস্তা আর নদীর কিনারা নৌকার বাজারে একাকার। এটি নৌকার সাপ্তাহিক বাজার, প্রতি শুক্রবার এখানে নৌকার হাট বসে। তবে সে কেবল বর্ষা ঋতুতে।

এখানে নৌকার সঙ্গে মাছ ধরার চাই ও বড়াও বিক্রি হয়। বর্ষাকাল বাদে অন্যসময় বিক্রি হয় বিভিন্ন সামগ্রী।

নৌকার হাটে মাছ ধরার চাই-ও বিক্রি হয়।

নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীপথ সরু হয়ে আসলেও অথবা শুকনা মৌসুমে নদীর অবস্থা যেমন-তেমন থাকলেও বর্ষা মৌসুমে দেশের সব খাল-বিল-নদী-নালা হয়ে ওঠে যৌবনবতী। তখন নদী-নালাকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে গ্রাম্য বাজার বা হাট। স্বরূপকাঠির আটঘরে বসে তেমন একটি হাট।

এ দেশে নৌকা, নদী ও মানুষের জীবন অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। এখানে মানুষ নদী ও নৌকার পারস্পরিক সম্পর্কের কথা বলে শেষ করা যাবে না। নৌকার ব্যবহার সারা বছর ধরে চললেও বর্ষাকালে তা অনেকটাই বেড়ে যায়।

নৌকা চালাতে তো বৈঠা লাগবেই। তাই বৈঠাও বিক্রি হয়।

বিশেষ করে কোষা ও ডিঙ্গি নৌকার চাহিদা এ সময় বাড়ে। আটঘরের নৌকার হাটে সে ধরনের নৌকাই বিক্রি হতে দেখলাম। নৌকার বেপারীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল এই বাজারে আসা নৌকার দাম সর্বোচ্চ ৮ হাজার টাকা আর সর্বনিম্ন ২ হাজার ৫শ’ টাকা।

নৌকা কিনলে বৈঠা ফ্রি, বিষয়টা এমন না। বৈঠা আলাদা কিনতে হয়। আটঘরের নৌকার বাজারে একটা বৈঠার মূল্য ৩শ’ টাকা।

বিক্রির জন্য ভাসমান নৌকার সারি।

কয়েকজন নৌকা বিক্রেতার সঙ্গে এরমধ্যে কথা হয়। কথা বলি হাটের ইজারাদারের সঙ্গে। বাজারের সেই রমরমা অবস্থা আগের মতো না হলেও কেনাবেচা ভালোই হয়।

“আগে নৌকার মান ভালো ছিল এখন কমেছে এই যা”- বলেন তপন নামের এক নৌকা বিক্রেতা বা নৌকার কারিগর।

দেবব্রত কর্মকার নামের এক বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, আগে নৌকা তৈরি হত সুন্দরী কাঠে, এখন নৌকা তৈরিতে বেশিরভাগ কারিগর মেহগনি কাঠ ব্যবহার করেন, ব্যতিক্রমও আছে। কেউ কেউ গাব, চম্বল, বাদাম, বা আমড়া গাছ দিয়েও নৌকা তৈরি করেন।

নৌকা কিনে মর্দ ভ্যানে চলিল।

কাঠের ভিন্নতা যাই থাক, নৌকার বাজার একশ বছরের ঐতিহ্য নিয়ে এখনও আটঘর বাজার মাতিয়ে চলেছে বর্ষা ঋতুর প্রতি শুক্রবারে।

সকাল থেকে হাট বসলেও দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাটের রমরমা অবস্থা বাড়ে। সন্ধ্যা হলেই হাটের আয়ু শেষ হয়ে যায়।

আমরাও সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই সময়ে অস্থায়ী দোকানে এসে গুলগুলা পেঁয়াজু, আলুর চাপ খাই। দোকান মালিক সন্ধ্যারানীর সঙ্গে কথা বলি। তারপর এক সময় হাটকে বিদায় জানাই।

অস্থায়ী ভাজাপোড়া খাবারের দোকান। ভাজতে ব্যস্ত সন্ধ্যারানী।

প্রয়োজনীয় তথ্য

আটঘরের ভাসমান নৌকার বাজার দেখতে হলে যেতে হবে বরিশালের স্বরূপকাঠির আটঘর।

ঢাকা থেকে শুক্রবার বাদে প্রতিদিন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় প্যাডেল চালিত স্টিমার ছেড়ে যায় বরিশালের উদ্দেশ্যে।

স্টিমারে চেপে বসতে পারেন অথবা রাত সাড়ে আটটা থেকে নয়টার মধ্যে চলাচল করা ঢাকা-বরিশাল রুটের বিশাল সব লঞ্চেও যাত্রা করতে পারেন।

নৌকার হাটে লেখক।

সুরভী, কীর্ত্তনখোলা, সুন্দরবন নামের সে সব লঞ্চে এক বৃহস্পতিবার চড়ে বসলেই হল বরিশাল পৌঁছে যাবেন।

তারপর নথুলস্নাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে অটো রিকশা মহেন্দ্র বা বাসে চেপে স্বরূপকাঠি।

বাস ভাড়া মাথা প্রতি ৫০ টাকা। আর মহেন্দ্র রিজার্ভ ৫শ’ থেকে ৭শ’ টাকা।

স্বরূপকাঠি থেকেই রিজার্ভ ট্রলারে আটঘর চলে যেতে পারবেন। ভাড়া ৮শ’ থেকে ১২শ’ টাকা।

বরিশাল লঞ্চ ভাড়া ডেক ২শ’ টাকা। কেবিন ডাবল ১৮শ’ টাকা নন এসি। স্টিমারের ডেকের ভাড়া ৩শ’ আর কেবিন ভাড়া ডাবল ১২শ’ নন এসি। এসির ভাড়া বেশি।

ডেক বাদে কেবিনে যেতে চাইলে আগে থেকে টিকিট বুকিং দেওয়া দরকার। কারণ, চাইলেই বরিশাল লঞ্চের টিকিট পাওয়া সম্ভব না।

আরেকটা কথা, বরিশালে নেমে অবশ্যই ফেরার টিকিট কেটে নেবেন। অবশ্য ডেকের যাত্রী হলে সেই সমস্যা নেই!