ভালোবাসার বসন্তে মাতাল সমীরণে, কুহু কুহু শোনা যায় কোকিলের কুহুতান।
Published : 13 Feb 2016, 07:29 AM
শুকনো শীতে রংয়ের ছোঁয়া শুরু হয়ে গেল বসন্তের দিনে। প্রকৃতির এই সাজ চিরায়িতভাবেই প্রভাব ফেলত বাংলার মানুষের মনে। বসন্তের আগমনী শহুরে বাঙালির উদযাপনে হয়ে ওঠে একটি সার্বজনীন উৎসব।
বাংলাদেশিদের নিজস্ব সত্ত্বা জেগে ওঠে এই বসন্তের ঋতুতেই, ১৯৫২’র ভাষার দাবীতে যখন বাংলার মানুষ পথে নেমেছিল, গুলি খেয়েছিল, জহির রায়হানের সঙ্গে দৃঢ় প্রত্যয়ে বলেছিল, আগামী ফাগুনে আমরা দ্বিগুণ হব।
রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী মিতা হক সেই দ্বিগুণ হওয়ার প্রসঙ্গ টেনেই বলেন, “আমাদের কৈশোর-যৌবনের ফাগুনটা ছিল খুব বেশি নিজের অস্তিত্বকে জানার উৎসব, স্বদেশকে প্রকাশ করার উৎসব। তখন আমাদের জোর করে চাপিয়ে দেওয়া বিজাতীয় এক ভাষা সংস্কৃতি থেকে নিজেদের মুক্ত করতেই ঘটা করে নিজেদের উৎসব পালনের প্রথা শুরু হয়। তখনকার বসন্ত ছিল জাগরণের বসন্ত, অভ্যুত্থানের বসন্ত, প্রাণের গভীর থেকে নিজস্বতাকে অনুভব করার বসন্ত। যেটার ব্যাপকতা ও ব্যাপ্তি এখন অনেক বেশি।”
“ছায়ানট তখনও চারুকলার বকুল তলায় বসন্ত উৎসব শুরু করে উঠতে পারেনি। একেক সময় একেক জায়গায় ছোটখাটো অনুষ্ঠান হত। তবে পোশাকে, সজ্জায় বসন্ত ছড়িয়ে যেত মন থেকে মনে।” বললেন এই শিল্পী।
তিনি আরও বলেন, “এখনকার মতো বিদেশি বাহারি ফুলের সমাহার ছিল না। হলুদ ফুল যে পরতেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতাও ছিল না। যে কোনো রংয়ের তাজা ফুল কানের পাশে গুঁজে বা গলায় মালা পরে, লাল, বাসন্তি, কমলা বা হলুদের কাছাকাছি কোনো রংয়ের শাড়ি পরেই বের হয়ে যেত সবাই।”
ফারহিন খান জয়িতা হালের একজন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। সম্পর্কে মিতা হকেরই আত্মজা।
দ্বিতীয় প্রজন্মের কাছে এসে বসন্তের উৎসব কেমন হয়েছে জানতে চাইলে জয়িতা বলেন, “ছোটবেলা থেকে বসন্ত মানেই বুঝি চারুকলার বকুলতলা। এর কোনো ব্যতিক্রম কখনও ঘটেনি। যদিও ঢাকার এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এখন বেশ উৎসব হয়। তবে সকালের এই উদযাপন আমার রক্তে মিশে আছে।”
জয়িতার জীবনে ভালোবাসা এসেছে এই উৎসবের হাত ধরেই।
জয়িতার ভাষায় “বসন্তকে তাই সাক্ষী রেখে গত বছর বাগদান করেছিলাম। যার পরিণতি বর্ষায় হয়।”
গহনার ক্ষেত্রে জয়িতার মাটি থেকে শুরু করে অক্সডাইজ মেটাল সবই চলে। মোট কথা দেখতে সুন্দর হলেই হয়। বসন্তকে নিজের মধ্যে ধারণ করতে তাই বাসন্তি সাজ চাইই চাই।
বসন্ত ও ভালোবাসা দিবসের মেলবন্ধনে জয়িতার আরেকটা জিনিস অবশ্যই চাই তা হল উপহার আদান-প্রদান। হোক সেটা ফুল বই বা অন্য কিছু। তবুও ভালোবাসার মানুষদের সবচেয়ে সুন্দর ঋতুতে বলতেই হবে, তোমাকে ভালোবাসি, তোমাকে যত্ন করি।
“উপহার হচ্ছে এই অনুভূতিগুলোর একটা মাধ্যম” এরকমই বিশ্বাস জয়িতার।
ইতিহাস
বাংলাদেশে বঙ্গাব্দ ১৪০১ সাল থেকে প্রথম ‘বসন্ত উৎসব’ উদযাপন করার রীতি চালু হয়। সেই থেকে জাতীয় বসন্তউৎসব উদযাপন পরিষদ বসন্তউৎসব আয়োজন করে আসছে।
শান্তিনিকেতনে এই উৎসব আরও প্রাচীন। রবীন্দ্রনাথের সময় থেকেই নাচ-গান ও রঙ খেলার মধ্য দিয়ে বসন্তকে স্বাগত জানানো হতো। সে উৎসব আজও পালন হচ্ছে। বসন্তউৎসবকে কেন্দ্র করে বোলপুরে নানান দেশি মানুষের মিলন মেলা জমে। সপ্তাহব্যাপী মেলা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাঁকজমকভাবে পালিত হয় বসন্তউৎসব।
বৈষ্ণব বিশ্বাস অনুযায়ী, ফাল্গুনী পূর্ণিমা বা দোলপূর্ণিমার দিন বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ আবির ও গুলাল নিয়ে রাধিকা ও অন্যান্য গোপীদের সঙ্গে রং খেলায় মেতেছিলেন। সেই ঘটনা থেকেই দোল খেলার উৎপত্তি হয়।
সেই বিশ্বাসেই হিন্দু বৈষ্ণবরা এ উৎসব পালন করেন বেশ ঘটা করেই। ভারতের অন্যান্য স্থানেও বসন্তউৎসব পালিত হয় দোল, হোলি বা দোল পূর্ণিমা নামে।
প্রাচীন বিশ্বাস, বাংলার জাগরণ বা ভালোবাসা যেই রঙেই সাজুক বসন্ত আজ জুড়ে থাকবে বাংলার প্রতিটি মানুষের মনে। পোশাকে, সাজে, শুভেচ্ছা বিনিময়ে দিনভর মুখর থাকবে প্রতিটি অফিস, ক্যাম্পাস ও পথ-ঘাট। বসন্তের এই জোয়ার বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে বই মেলার ময়দানে গিয়ে মিশবে। মাতিয়ে রাখবে শহরের অন্যান্য বেড়ানোর জায়গাগুলিকেও।