গীতাঞ্জলী শ্রী হিন্দি ভাষায় প্রথম ভারতীয় কথাসাহিত্যিক যিনি ২০২২ সালে তার ‘টুম্ব অব স্যান্ড’ উপন্যাসের জন্য বুকার পুরস্কার পেয়েছিলেন। এ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছে বুকার প্রাইজ কমিটি। সূত্র: দ্য বুকার প্রাইজেস ডটকম
Published : 16 Nov 2022, 04:09 PM
আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় থাকতে পেরে কেমন লাগছে?
বিস্ময়ের থেকে কম নয়। প্রতিটা ছোট মুহূর্তের সঙ্গে ব্যাপারটা আরও বিস্ময়কর। ধীরে ধীরে ব্যাপারটা আমার জন্য আরও ভালোভাবে ধরা দেবে যে কী চমৎকার স্বীকৃতিই না এটি! আমার কাজের জন্য এটি বিরাট অর্জন। যদিও বুকার ইংরেজি অনুবাদে গুরুত্ব দেয়, তবুও এটি অন্যান্য ভাষার অনুবাদে এবং মূলেও আমার সমস্ত কাজগুলো সামনে এনেছে।
একথা শুধু আমার সম্পর্কেই নয়, বরং যে কোনো ব্যক্তির ব্যাপারেও। আমি একটি ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করি এবং এ স্বীকৃতি বিশেষত হিন্দি সাহিত্য এবং ভারতীয় সাহিত্যকে একটা বৃহত্তর পরিধিতে নিয়ে আসবে। দৃষ্টি ফেরাবে যে সমৃদ্ধ সাহিত্যের একটি বিশাল জগৎ রয়েছে যেগুলো আবিষ্কার করা প্রয়োজন। আমি এর প্রতিনিধি হতে পেরে সন্তুষ্ট ও কৃতজ্ঞতা অনুভব করছি।
কী আপনাকে ‘টুম্ব অব স্যান্ড’ লিখতে প্রথম অনুপ্রাণিত করেছিল?
কবি এ কে রামানুজন তার ডায়েরিতে যা লিখেছেন তাই আমি সুর করে বলি, ‘তুমি তোমার কবিতাকে বাছাই ও খোঁজার দরকার নেই। তুমি নিজেকে এমন জায়গায় রাখো যেখানে সেগুলোই তোমার সঙ্গে ঘটবে’।
যদি আপনি লেখক হন তবে গল্পগুলোই আপনার ইন্দ্রিয়কে সবসময় প্রভাবিত করবে এবং আপনাকে বুঝতে হবে সবকিছুই হলো গল্প এবং সবকিছুই গল্প বলে। এটা আপনার শ্বাস নেওয়ার মতোই স্বাভাবিক ব্যাপার, অথবা এটিই আপনার শ্বাস!
তারপর আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে। গল্পটি দেখবে আপনি একা এবং তাকে গ্রহণ করতে সক্ষম। তখন সে আপনার উপর ভর করে ওঠে, কিছু জিনিস আপনাকে রুদ্ধ করে ফেলে এবং গল্পটি ধীরে ধীরে নিজেকে আপনার কাছে প্রকাশ করে।
‘টুম্ব অব স্যান্ড’-এর ক্ষেত্রে, বিছানায় শুয়ে থাকা একজন বয়স্ক নারীর চিত্র, যিনি আর বাঁচার কথা ভাবছেন না এবং নিজেকে আরও প্রাচীরের গভীরে ঠেলে দিচ্ছেন, যেন নিজেই নিজেকে কবর দিতে চান, এ ব্যাপারটিই আমাকে আঁকড়ে ধরে। এটিই আমার কৌতূহল জাগিয়েছে- সত্যিই কি সে জীবন ও জগৎ নিয়ে ক্লান্ত? তাই কি সে এগুলো থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছে নাকি ধীরে ধীরে নিজেকে জীবনের ভিন্ন ও নতুন কোনো পর্যায়ের জন্য তৈরি করছে? যখন সে এ প্রাচীরের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যেতে চায় বলে মনে হয় তখন সে কি এর শেষটা দেখতে চায় নাকি অন্যপাশ বেয়ে বেরিয়ে আসতে চায়?
আপনার প্রথমদিককার পড়ার স্মৃতি কী ছিলো?
পঞ্চতন্ত্রের গপ্পো এবং শৈশবে চাঁদমামার মতো ছোটদের ম্যাগাজিনগুলো।
কোন লেখকেরা আপনার লেখালেখিতে বেশি প্রভাব রেখেছে?
আমি জানি না ‘প্রভাব’ শব্দটিকে এখানে কীভাবে ব্যবহার করবো, একজন লেখক সত্তা এমনভাবে প্রভাবিত হয় কিংবা এ প্রভাবটি এমন নয় যে তা সচেতনভাবে পরিমাপ বা সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে। আমি বরং এটা বলবো যে বহু লেখকই আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। তারা অন্য একটা দুনিয়া আমার সামনে খুলে দিয়েছে এবং লেখার ক্র্যাফট কাজে লাগানোর বহু উপায় আমাকে বলে দিয়েছে। তাই আমি সেসব লেখকদের ব্যাপারে বলতে পারবো যারা আমাকে সমৃদ্ধ করতে এবং গল্প বলার বিভিন্ন ধরন আমার সামনে আনতে সাহায্য করেছে।
কৃষ্ণ সোবতী আমাকে পৃথিবীর গন্ধের গুরুত্ব, ভাষার তাল এবং বস্তগত বর্ণনার সেই জিনিসগুলো দেখিয়েছেন যেগুলোর বর্ণনা জীবনকে স্পন্দিত করে তোলে। নির্মল ভার্মা তার লেখায় অতি সংলাপ বাদ দিয়েছিলেন এবং লেখার পরিবেশটাকেই গুরুত্ব দিতেন, যার ফলে লেখায় শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো অন্যরকম ছন্দ সৃষ্টি হয়।
ইনতেজার হুসেইন আমার কল্পনা সমৃদ্ধ করেছেন তার ‘প্রাচ্য’-এর মতো একটা গল্পের মধ্যে আরেকটা গল্প বলার ঢঙে, সমসাময়িক ও প্রতিদিনকার বিষয়গুলোর সঙ্গে মহাকাব্য, লোককথা ও পুরাণকে মিশ্রিত করার মাধ্যমে। কেবি বৈদ তার ফর্ম ও ভাষার মাধ্যমে তৈরি করা এক ঝুঁকিপূর্ণ খেলার মাধ্যমে আমাকে রোমাঞ্চিত করেছেন। শ্রীলাল শুক্লা হাসি-তামাশার সঙ্গে ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলো রাজনীতির রঙে রঞ্জিত করেছেন। বিনোদ কুমার তার লেখায় জাগতিক ব্যাপারগুলো গুরুত্ব দিয়েছেন, ফলে বিভিন্ন জিনিস ও মানুষের ভুলে যাওয়া বা এগুলো আমলে নেওয়ার ব্যাপারগুলোতে দৃষ্টি আর্কষণ করেছিলেন। কম সংখ্যায় আমার সমসাময়িক হিন্দি সাহিত্যে সেরাদের মধ্যে তারা হলেন কয়েকজন।
হিন্দির বাইরেও আরেকটি জগৎ রয়েছে যেগুলো আমার কল্পনা এবং সাহিত্য চেতনা সমৃদ্ধ করেছে। চটজলদি আমি কোয়েৎজি, দস্তয়েভস্কি, হ্যাল্ডর ল্যাক্সনেস, হেমিংওয়ে, গার্সিয়া মার্কেজ, কুন্দেরা, বোর্হেস, ওসামু দাজাই, এলিস মুনরো, তানিজাকি, উনামুনো, ঝাও ঝিংঝিয়াং এবং আরও অনেকের কথা বলতে পারি।
আপনার ব্যাপারে কম জানা সত্যটি আমাদের বলুন।
আমি সারাক্ষণই বলিউডের পুরনো গানগুলো গুণগুণ করি।
বইয়ের ব্যাপারে মজার তথ্যটিও আমাদের বলুন।
যেভাবে কেউ কোনো গল্পের কিছু অংশকে বর্ণনা করে- পাখি, প্রজাপতি, এমনকি দরজা, প্রাচীর ও রাস্তা এবং একজন চরিত্র যে কিনা ক্ষমার সঙ্গে বর্ণনায় যুক্ত হয় এবং যে কিনা গল্পের অংশই নয়, কিন্তু সে যেহেতু এ কাজ করেছে তাই তাকে ঘটনাস্থলে যুক্ত হতেই হবে! এ ব্যাপারটি সমস্ত জিনিসের ঐক্য ও বিশ্বের সমৃদ্ধ বহুত্ববাদের প্রতীক হয়ে উঠেছে। আর অবশ্যই, এটি সীমান্তের ভ্রান্তি দেখিয়ে যাচ্ছে।
একটা বইয়ের নাম বলুন যেটি আপনার জীবন পাল্টে দিয়েছে?
মহাভারত। কিছুর জন্য নয়, তবে সবকিছু ধারণ করে বলা যায়। সম্ভাব্য সব গল্প, সেগুলো বলার সমস্ত উপায়, সেগুলোর সবকিছুই সেখানে রয়েছে। এ বইটি সাহসী, জ্ঞানী, পাগলপ্রায়, মানবিক এবং আলোকসম্পূর্ণ। অনিশ্চয়তায় যুগের পর যুগ ধরে অনুপ্রাণিত করে আসছে।
আপনাকে দেওয়া লেখালেখি নিয়ে সেরা উপদেশটি কী ছিল?
নিজের মতো হও, কাউকে তোমার কাঁধে হাত রেখে বলতে দিও না কেমন ও কীভাবে লেখা উচিত।
কোন বইটি আপনি শেষ করতে পারেননি?
উমবের্তো একোর ‘গোলাপের নাম’, সম্ভবত যখন বইটি আমি বাছাই করেছিলাম ওটা ভুল সময় ছিল। আমি মধ্যযুগীয় আশ্রমের গোলকধাঁধায় হারিয়ে গিয়েছিলাম এবং আমি মনে করি আমি তাতে বহু পুরুষে ভরা মজলিস খুঁজে পেয়েছিলাম।