বুল্লে শাহের কবিতার ধরন কাফি যা সুফি অধিবিদ্যা ‘ওয়াহদাতুল উজুদ’ বা অস্তিত্বের ঐক্য দ্বারা প্রভাবিত।
Published : 19 Aug 2023, 01:52 PM
বুল্লে শাহ (১৬৮০–১৭৫৭) পাঞ্জাবের সুফি, দার্শনিক ও মানবতাবাদী কবি। পুরো নাম সৈয়দ আব্দুল্লাহ শাহ কাদরি। পাঞ্জাবের ভাওয়ালপুর গ্রামে ১৬৮০ সালে তার জন্ম। বর্তমানে এ স্থানটি পাকিস্তানের অন্তর্গত। তার পিতার নাম শাহ মুহাম্মদ দরবেশ, যিনি পেশায় ছিলেন শিক্ষক, কাজ করতেন স্থানীয় একটি মসজিদে, ইমাম হিসেবে।
বুল্লে শাহের পূর্বপুরুষরা বুখারা থেকে আগত। ধারণা করা হয়, তারও আগে তারা উজবেকিস্তানের অধিবাসী ছিলেন। বুল্লে শাহের বয়স যখন ৬ মাস, তখন থেকে তার পরিবার মালাকওয়ালে বসবাস করা শুরু করে। সেখানেই তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য তিনি কাসুর যান। সেখানে মাওলানা মইনুদ্দিনের কাছে তিনি শিক্ষালাভ করেন। তিনি লাহোরের সুফি দরবেশ শাহ ইনায়েত কাদরির কাছে বায়াতপ্রাপ্ত হন।
বুল্লে শাহের কবিতার ধরন কাফি যা সুফি অধিবিদ্যা ‘ওয়াহদাতুল উজুদ’ বা অস্তিত্বের ঐক্য দ্বারা প্রভাবিত। এটি পাঞ্জাবি ও সিন্ধি কবিতার জনপ্রিয় একটি ধারা, যা সুফিরা ছাড়াও শিখ গুরুরা ব্যবহার করতেন। কাফি নামে সঙ্গীতের একটি রাগও রয়েছে। বুল্লে শাহ ছাড়াও তার সমসাময়িক অনেক কবি, যেমন বাবা ফরিদ, শাহ হুসাইন, খাজা গোলাম ফরিদসহ অনেকে এই আঙ্গিকে কবিতা লিখেছেন।
এই ধরণের কবিতার মূল বৈশিষ্ট্য- আত্মার সাথে পরমাত্মার, স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির, গুরুর সাথে ভক্তের, আশেকের সাথে মাসুকের ও প্রেমিকের সাথে প্রেমীর কথোপকথন। যেগুলো পরবর্তীতে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে গান হিসেবে প্রচলিত হয়েছে। বিখ্যাত কাওয়ালি গান ‘দমাদম মাস্ত কালান্দার’-এর বর্তমান রূপটি বুল্লে শাহ প্রণীত।
মানবতাবাদী বৈশিষ্ট্যের কারণে বুল্লে শাহকে ‘পাঞ্জাবের লালন’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। মুসলমান ছাড়াও তিনি হিন্দু ও শিখদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিলেন। হিন্দু ও শিখ লেখকদের রচনাতে তার সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্যাদি পাওয়া যায়। যদিও তার জীবন সম্পর্কে অতি অল্প-ই জানা গেছে।
মোগল আমলের শেষভাগে যে সময়টায় তিনি বেঁচে ছিলেন, সেটি ছিল মুসলমান ও শিখদের সংঘাতের কাল। এসময় আগের এক ঘটনার জের ধরে মুসলমানদের হাতে এক তরুণ শিখ নিহত হয়। বুল্লে শাহ এর প্রতিবাদ করায় ধর্মান্ধ মুসলমানদের আক্রোশের শিকার হন। আজীবন তিনি ধর্মীয় গোড়ামির বিরোধিতা করে গেছেন। এ কারণে মোল্লারা তাকে ‘কাফের’ ফতোয়া দেয়।
১৭৫৭ সালে ৭৭ বছর বয়সে এই মরমী কবি মারা যান। মোল্লারা তার জানাজা পড়তে অস্বীকৃতি জানায়। বুল্লে শাহকে সমাহিত করা হয় কাসুরে, যা বর্তমানে পাকিস্তানের অংশ। ইংরেজি থেকে ট্রান্সক্রিয়েট করা বুল্লে শাহের চারটি কবিতা-
১
অনেককিছু জেনেছ তুমি
পড়েছ হাজার-হাজার বই,
কিন্তু কখনও পড়েছ কি
নিজেকে?
তোমার ভেতর যে তুমি আছে
তাকে তুমি খুঁজলে কই?
গিয়েছ তুমি মসজিদে
গিয়েছ মন্দিরেও
কিন্তু কখনও কি ভ্রমণ করেছ
তোমার আত্মা-ঘর?
নিজেকে তুমি খোঁজনি কখনও
খুঁজতে গিয়েছ পর।
পৌঁছে গেছ তুমি আকাশে
পেয়েছ মেঘের দেখা
অথচ নিজ হৃদয়ে পারলে না পৌঁছাতে
তুমি এমন-ই অভাগা!
২
ভালোবাসার তীর আমাকে বিদীর্ণ করেছে
কী করবো আমি?
না পারছি বাঁচতে— না পারছি মরতে।
এই অশান্ত হৃদয়ের আর্তি তোমরা শোন,
দিনেও শান্তি পাইনি আমি— রাতেও না।
আর এক মূহূর্তও পারছিনা থাকতে
প্রেমীকে ছাড়া!
ভালোবাসার তীর ছিন্নভিন্ন করেছে আমাকে,
কী করবো আমি?
বিচ্ছেদের আগুন জ্বলছে নিরন্তন;
কেউ আমার ভালোবাসার যত্ন নিক,
তাকে না দেখে
কীভাবে রক্ষা পাবো আমি?
ভালোবাসার তীর এফোঁড়-ওফোঁড় করেছে,
কী করবো আমি?
৩
আমার চোখ ভরে গিয়েছে অশ্রুতে
চলে গেল সে আমাকে ছেড়ে,
নিজ থেকেই গেল সে চলে।
কী দোষ ছিল আমার?
না রাতে, না দিনে
শান্তিতে ঘুমাতে পারছি আমি,
কান্নায় টলোমল দুটি চোখ।
চাকুর চেয়েও ধারালো
আর বর্শার চেয়েও তীক্ষ্ম
ভালোবাসার তীর।
ভালোবাসার চেয়ে নিষ্ঠুর কেউ নেই,
এই ব্যাধি সারাতে পারবে না
কোনো চিকিৎসক।
কোথাও শান্তি নেই
এক মুহূর্তের জন্যেও না।
বিরহের বেদনা কী যে তীব্র!
হে বুল্লে শাহ,
স্রষ্টা যদি রহমত বর্ষণ করতেন— তার,
দিনগুলো খুব দ্রুত পাল্টে যেত আমার!
সে চলে গেল, নিজেই গেল সে চলে,
আমার কী দোষ ছিল?
৪
তুমি-ই শুধু বিদ্যমান, আমি নই!
হে প্রেমী,
শুধু তুমিই অস্তিত্বশীল, আমি নই!
ধ্বংসস্তুপের মাঝে জেগে থাকা এক ঘরের ছায়ার মত
নিজের মনের মাঝে ঘুরপাক খাই— আমি আমার।
যদি কথা বলি, তুমি আমার সাথেই কথা বলো
যখন নীরব থাকি— তুমি আমার মনেই আছ।
যদি ঘুমিয়ে পড়ি, তুমিও আমার সাথেই ঘুমিয়ে যাও।
যদি হাঁটি— তুমিও হাঁটো সেই পথে।
ওহ বুল্লে, জগৎপতি এসেছে আমার ঘরে।
তার কাছেই উৎসর্গকৃত আমার জীবন
শুধু তুমিই বিদ্যমান, আমি নই!