ফুলটি ফুটেও ফুটলো না

আমাদের মুখস্থবিদ্যা যখন ইংরেজি বাক্য অনুবাদে ব্যর্থতার সাগরে ঘুরপাক খাচ্ছে, স্যার তখন বলতেন, ‘জীবনে একটা ফুল-ই যদি ফুটাইতে না পারলি, এই জীবন লইয়া তাহলে কী করবি বল?’

রাব্বী আহমেদরাব্বী আহমেদ
Published : 20 Sept 2022, 04:10 AM
Updated : 20 Sept 2022, 04:10 AM

‘হাঁসের মতো হবি ব্যাটা জীবনে, যত ময়লার ভেতর দিয়েই যাবি, শরীরে কখনও লাগবে না।’ মালেক স্যার বলতেন, ‘আরও যখন বড় হবি, যখন এই সরল বালক আর থাকবি না, হয়ে উঠবি জটিল যুবক, এই পৃথিবী তোকে শেখাবে বেঁচে থাকার জটিল সব মন্ত্র, তখন যেন কোন পাপ তোকে স্পর্শ করতে না পারে।’

মালেক স্যার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। স্যারের সঙ্গে শেষ যে-বার দেখা, এক বিস্তীর্ণ রাস্তার পাশে, সন্ধ্যা নেমে আসা মুহূর্তে, স্যার বলেছিলেন, ‘কিরে, এখনও কি সরল বালক আছিস? নাকি শহুরে জটিলতায় হাঁসের পালক ছেড়ে হয়ে গ্যাছিস দুর্গন্ধযুক্ত কেউ?

আমরা যারা ইংরেজিতে দুর্বল ছিলাম, তাদের কাছে মালেক স্যার ছিলেন মূর্তিমান আতঙ্ক। পানভর্তি মুখে বলতেন, ‘ফুলটি ফুটেও ফুটলো না’, বল এর ট্রান্সলেশন কী হবে?’ আমাদের মুখস্থবিদ্যা যখন ইংরেজি বাক্য অনুবাদে ব্যর্থতার সাগরে ঘুরপাক খাচ্ছে, স্যার তখন বলতেন, ‘জীবনে একটা ফুল-ই যদি ফুটাইতে না পারলি, এই জীবন লইয়া তাহলে কী করবি বল?’

এই জীবনখানা লইয়া যে কী করবো, সে চিন্তা তখনও আমাদের বালকমনে আসেনি। কিন্তু স্কুলের কোন কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান ধরতাম,

‘বিদ্যালয় মোদের বিদ্যালয়/ এখানে সভ্যতার-ই ফুল ফোটানো হয়।’

সে-দিন শ্রাবণের এক ঘোর বর্ষায় ছাতা হাতে মালেক স্যার এসে বসলেন পঞ্চম শ্রেণির বি-ফর্মে। শান্ত কণ্ঠে বললেন, ‘ফুলটি ফুটেও ফুটলো না।’ একটা পিনড্রপ সাইলেন্ট নেমে এসেছিল আমাদের সেই ৫২ নং, শৌলজালিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।

আমরা যখন সভ্যতার ফুল ফোটাতে ব্যস্ত, তখন মুনিরা, আমাদের ক্লাসের কৃষকের মেয়ে, যার খোপায় রক্তজবার মতো ক্ষত ছিল, চলে যায় স্বামীর সংসারে। মালেক স্যার বলেছিলেন, ‘আহারে! সভ্যতার একটা ফুল এই অসভ্যতায় হারিয়ে গেল? আচ্ছা বল তো, বড় হয়ে তোরা হবিটা কী?’ আমাদের গ্রামার বই-এ  ‘এইম ইন লাইফ’ রচনায় তখন কেবল-ই ডাক্তার হবার কথা। ‘উদ্দেশ্যবিহীন জীবন, পাল ছেঁড়া নৌকার মতোন।’ এই ছিল তার সারাংশ। আমরা তখন বলতাম, ‘ডাক্তার হবো।’ মালেক স্যার বলতেন, ‘ডাক্তার হয়ে কী এই-সব মুনিরাদের সেবা করতে গ্রামে আসবি পাগলা? এই-সব মুনিরা, যারা তোদের-ই, তোদের-ই বন্ধু, চিকিৎসার অভাবে পড়ে থাকে গ্রামে? জীবনে অনেক বড় মানুষ হতে হবে পাগলা।’

মুনিরার মৃত্যু-সংবাদ দিয়েছিলেন মালেক স্যার-ই। সে-দিন শ্রাবণের এক ঘোর বর্ষায় ছাতা হাতে মালেক স্যার এসে বসলেন পঞ্চম শ্রেণির বি-ফর্মে। শান্ত কণ্ঠে বললেন, ‘ফুলটি ফুটেও ফুটলো না।’ একটা পিনড্রপ সাইলেন্ট নেমে এসেছিল আমাদের সেই ৫২ নং, শৌলজালিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।

মনে পড়ে এক বৃহস্পতিবার স্কুল ছুটির পর আমরা গুটিসুটি পায়ে দেখতে গিয়েছিলাম মৃত মুনিরাকে। মুনিরার বাংলা বইয়ের উপর দেখতে পেয়েছিলাম ছোপ ছোপ কালো দাগ। ওই দাগ কাজলের না কেরোসিন-কুপির আজও জানি না।

মুনিরার মা আমাদের খেতে দিয়েছিল ‘পয়সা বিস্কিট’। মৃত্যুমুখর ওই বাড়ির আঙিনায় একটা পেঁপে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে অনেকটা লোভার মতো গ্রোগাসে গিলেছিলাম নাবিস্কো কোম্পানির সেই বিস্কিট। দেখতে পেয়েছিলাম একটা প্রসূতী মুরগি কতিপয় হাঁসের ছানার মা হবার ঔদার্য নিয়ে ডেকে যাচ্ছে অবিরাম- কক কক। সেবার-ই প্রথম চোখের পানি কলমের কালিতে ভিজে একাকার হয়ে গিয়েছিল স্কুলের শাদা ড্রেস। ওই দাগ লেগে থাকা স্কুল-ড্রেস আমি আর কোনদিন পরতে পারিনি লজ্জায়, বেদনায়।

একজন কলেজ আউটের গল্প

একবার স্যার নিউটনের গতিসূত্র পড়াচ্ছেন। আমি পেছন থেকে হাসছি। স্যার বললেন ‘হাসছো ক্যানো? আমি জবাব দিলাম ‘স্যার ভাবছি নিউটন যদি নারিকেল গাছের নিচে বসে থাকতেন আর মাথায় যদি নারিকেল পড়ত তাহলে কী হত?’ স্যার কিছু বলার আগের আমার এক ক্লাসমেট উত্তর দিল, ‘দোস্ত, তাইলে ল’জ অব ইমোশন তৈরি হইতো।’

ক্লাসে হাসির রোল পরে গেলে স্যারের করুণ চোখের চাহনিতে তিনি আমাকে যা বোঝালেন তার অর্থ মোটামুটি এ রকম— আমাকে বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।

অন্য একদিনের কথা। আমাদের এসএসসি টেস্ট পরীক্ষায় ভুলবশত একটা প্রশ্ন ছাপা হয়েছে— ‘গফুর গল্প অবলম্বনে মহেশ চরিত্রটি আলোচনা কর।’ মোটামুটি একটা হাসির ঝড় বয়ে গেল পরীক্ষার হলে। পরীক্ষার গার্ড ছিলেন জহির স্যার। তিনি আবার ন্যাটিভ কায়দায় ইংরেজিতে কথা বলতেন। স্যার তার অভিনব ইংরেজিতে বললেন, ‘ইয়োর টিচার ইজ এক্সাম হল, বাট ইয়োর মাউথ ইজ লাফিং, ভেরি ভেরি শকিং।’

আমাদের কলেজ খুব কড়া ছিল। আমরা যদি কিছু করতাম তাহলে বকাঝকা শুনতে হতো প্যারেন্টসদের। আর প্যারেন্টসদের জানানোর জন্য যে ওয়ার্নিং লেটার পাঠানো হতো আমরা তাকে ডাকতাম ‘লাভ-লেটার’।

স্যারের কথা শুনে আমাদের হাসির বেগ আরও বেড়ে গেলে স্যার আমাদের হাসির কারণ জিজ্ঞেস করলেন। আমি যেহেতু একটু বেশি হাসি তাই আমি-ই দাঁড়িয়ে বললাম, ‘স্যার প্রশ্নে ভুল আছে।’ স্যার অঙ্কের টিচার। বাংলা নিয়ে মাথা ঘামান না। বললেন, ‘যা আছে তাই ল্যাখো।’ আমি মোটামুটি একটা ভরসা পেলাম। লেখা শুরু করলাম— মহেশের চোখ দু’টি ছিল মায়াবী। গায়ে মখমল পশম, যেন কাশ্মিরী কার্পেট। মহেশের চরিত্র ছিল সাংঘাতিক। রেগে গেলে ভেগে যেত। ‘গফুর’ গল্পে মহেশ একটি আদর্শ গরু চরিত্র। আপনারা যারা জানেন না তাদের জন্য- ‘মহেশ’ শরৎচন্দ্রের একটা গল্প। মহেশ একটা গরুর নাম। গফুর নামের এক দরিদ্র লোক মহেশকে লালন-পালন করতেন। ঠিকমতো খেতে দিতে পারতেন না। তখন খুব অভাব ছিল। মানুষ-ই খেতে পারতো না। না খেতে পেরে গরুটা এক সময় মারা যায়। মূল প্রশ্নটা ছিল, ‘মহেশ গল্প অবলম্বনে গফুর চরিত্রটি আলোচনা করো।’ এটা মাধ্যমিকের বাংলা পাঠ্যবইয়ের সূচিতে ছিল বহুদিন।

যাই হোক, খাতা দেওয়ার পর অবশ্য রেহাই পাইনি। বাসায় কলেজ থেকে ছোট্ট একটা ‘লাভ-লেটার’ গিয়েছিল। আমাদের কলেজটা আবার খুব কড়া ছিল। আমরা যদি কিছু করতাম তাহলে বকাঝকা শুনতে হতো প্যারেন্টসদের। আর প্যারেন্টসদের জানানোর জন্য যে ওয়ার্নিং লেটার পাঠানো হতো আমরা তাকে ডাকতাম ‘লাভ-লেটার’। তো ওই লেটারে লেখা ছিল— ‘আপনার পুত্র বা পোষ্যের বাহ্যিক জ্ঞান অত্যন্ত নিম্নমানের। সে পরীক্ষার সঙ্গে মশকরা করেছে।’ পরীক্ষার সঙ্গে কী করে মশকরা করা যায়, এটা আমার প্যারেন্টস আমাকে কখনও জিজ্ঞেস করেনি।

দুই বছর পরের কথা। আমরা তখন দ্বাদশ শ্রেণিতে। প্রায়ই জুনিয়র ব্লকে যাই প্রেপ-গার্ড হিসেবে। প্রেপ হচ্ছে পাঠপ্রস্তুতি। সন্ধ্যার পর সবাই মিলে একসঙ্গে পড়তাম। টিচাররা আসতেন পড়া বুঝিয়ে দিতে। আর সিনিয়ররা জুনিয়ররা পড়ছে কিনা এটার সুপারভিশনে যেতেন। তো ভীষণ কড়া টাইপ গার্ড দিই। একদিন হঠাত্‍ করে একটা ডাক শুনতে পেলাম, ‘অই গাবদা খাতাটা পাঠাতো।’ গাবদা ডাকটা শুনে কিছুক্ষণ হ্যাং হয়ে ছিলাম। বললাম, ‘অই তোমাদের মধ্যে গাবদা কে?’ মোটা একটা ছেলে দাঁড়াল। ও যে রিল্যাক্সিং ভঙ্গিতে দাঁড়ালো তা দেখে আমার-ই হাসি পেল। আমাদের কলেজটা ছিল খুব টাইট। এরকম ঢিলেঢালা মানুষদের জন্য সেটা একটু বেমানান। বুঝতে দেরি হলো না ক্লাসমেটদের অ্যাটাকিং টিজ থেকে ছেলেটিও রেহাই পায়নি।

একদিন গেমস টাইমে দেখলাম স্টাফ গাবদাকে ড্রিল শেখাচ্ছে। বেচারার শরীর থেকে টপাটপ ঘাম বের হচ্ছে। আমি কাছে গিয়ে বললাম, ‘স্টাফ, ওকে ছেড়ে দিন। ওর ক্লাসমেটরা তো সব হাউসে চলে গেছে।’

এরপর থেকে প্রেপ-গার্ডে গেলে প্রায়ই গাবদাকে দেখতাম। মাঝেমাঝে ডেকে কথা বলতাম। একদিন ক্যান্টিনে দেখা হলো। বললাম, ‘অই গাবদা এদিকে আয়।’ সেদিন গাবদা মনে হয় বেশ লজ্জা পেয়েছিল। আর আমরা সবাই খুব হেসেছিলাম। পরে ভাবলাম ওকে হাউসে গিয়ে সরি বলব। কিন্তু সরি আর বলা হয়ে ওঠেনি। ওই ঘটনায় মোটামুটি সবাই তাকে 'গাবদা' নামে ডাকত। জানি না ভেতরে ভেতরে ও কষ্ট পেত কিনা। তবে আমার নিজেকে বেশ অপরাধী মনে হত। ভাবতাম, আহা! ছেলেটার টিজ নাম জানাজানি হয়ে গেল!

একদিন গেমস টাইমে দেখলাম স্টাফ গাবদাকে ড্রিল শেখাচ্ছে। বেচারার শরীর থেকে টপাটপ ঘাম বের হচ্ছে। আমি কাছে গিয়ে বললাম, ‘স্টাফ, ওকে ছেড়ে দিন। ওর ক্লাসমেটরা তো সব হাউসে চলে গেছে।’ কী মনে করে স্টাফ ছেড়ে দিলেন। গাবদা একটু হাসল। আনন্দ আর বেদনার মাঝামাঝি সে হাসির অর্থ ছিল অনেক।

অনেক দিন পরের কথা। সকালের পিটিতে দৌড়াচ্ছি। এক চক্কর দৌড় তখনও শেষ হয়নি। এমন সময় দেখতে পেলাম গাবদা মাটিতে লুটিয়ে আছে। হয়তো বিশাল শরীরটাকে দৌড়ানোর সময় ধরে রাখতে পারেনি। দেখলাম গাবদার মুখ থেকে গোঙানির শব্দ আসছে। কলেজ মাইক্রোবাসে করে গাবদাকে মেডিকেলে পাঠানো হলো। গাবদা ফিরে আসল বিকেল চারটায়। ওকে রাখা হল কলেজ-মস্কের সামনে। সবাইকে শেষবারের মতো ওকে দেখতে যেতে বলা হলো।

আমাদের কলেজটা ছিল আবাসিক। সবাই একসঙ্গেই থাকতাম। গাবদাকে হারানোর শোক মুহূর্তে ছড়িয়ে গেল। দিনটি ছিল ১০-১০-১০। আর একটু পরই কলেজ থেকে চলে যাবে গাবদা — আমাদের ওয়াহেদ। গাবদাকে শেষবারের মতো দেখতে আমি যেতে পারেনি। হুট ওর চলে যাওয়াটা মানতেও পারছিলাম না। কিছুক্ষণ পর কলেজের বিশেষ গাড়িতে ওকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। কলেজ আউট— ওয়াহেদ। আর ‘কলেজ-আউট’ হবেই না কেন, মৃত ছাত্রকে কোন কলেজ রাখে!

কিডজ ম্যাগাজিনে বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!