বাংলা প্রবাদের সঠিক উৎস সম্পর্কে কোনও প্রামাণ্য নথি পাওয়া যায় না। দীর্ঘদিন ধরে লোকমুখে প্রচার হতে হতে এগুলো ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠা পায়।
Published : 21 Aug 2023, 12:45 PM
অভিধান হলো ভাষার শব্দ সংগ্রহমূলক গ্রন্থ। আমরা অভিধানে শব্দের একটি অর্থ যেমন পাই তেমন একটি শব্দের একাধিক অর্থও পাই। শব্দের অর্থ সবসময় একইরকম থাকে না। কালের পরিক্রমায় একটি শব্দ একাধিক নতুন নতুন অর্থ পরিগ্রহ করে।
ভুক্তিশব্দের সঙ্গে অর্থের সবসময় যে মিল থাকে এমনটিও নয়। এ জন্যই অভিধান হলো শব্দের রহস্যঘেরা এক বিস্ময়কর জগৎ। এতে অবগাহন করে নিরবচ্ছিন্ন সম্পর্ক স্থাপন করে শব্দের মণিমুক্তা কুড়াতে হয়। ভুক্তিশব্দের সঙ্গে অর্থ গঠনের যে বোঝাপড়া তার পেছনে কাজ করে মানুষের বহুবিচিত্র সব চিন্তাভাবনা। এ সূত্র ধরেই আমরা জানবো এমনই কিছু শব্দ বা শব্দবন্ধের অর্থের গল্প।
ষষ্ঠী বিভক্তি ‘এর’ বনাম সর্বনাম ‘এঁর’
ইদানীং বিশেষ বা সম্মাননীয় কোনো ব্যক্তির জন্ম বা মৃত্যুদিনে আমরা বিভিন্ন ব্যানার, ফেস্টুন, লিফলেট, পোস্টার বা কার্ডে প্রায়ই দেখতে পাচ্ছি তাদের নামের সঙ্গে চন্দ্রবিন্দু দিয়ে ‘এঁর’ আলাদা করে লেখা হচ্ছে। যেমন: ‘আজ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এঁর জন্মদিন’ বা ‘আজ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম-এঁর মৃত্যুবার্ষিকী’। এই বাক্যদুটোর একটিও শুদ্ধ নয়। কিন্তু কেন? এর ব্যাখ্যা কী? তবে চলো জেনে নিই।
এ আলোচনার শুরুতেই বিভক্তি ও সর্বনাম এবং এর প্রয়োগ সম্পর্কে পাঠককে একটু ধারণা দেওয়া প্রয়োজন। কেননা ভ্রান্তির শুরু এখান থেকেই।
বিভক্তি: যে ধ্বনি বা ধ্বনিগুচ্ছ শব্দ বা ধাতুর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পদ গঠন করে এবং বাক্যের মধ্যে পদগুলির ভূমিকা, পারস্পরিক সম্পর্ক ও বৈশিষ্ট্যকে স্পষ্ট করে তাকে বিভক্তি বলে। অর্থাৎ শব্দকে বাক্যে ব্যবহার করে পদে রূপান্তরিত করার জন্য শব্দের সঙ্গে যা যোগ করতে হয় তা হলো বিভক্তি। এ, এর, র, তে প্রভৃতি বিভক্তি বাংলায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। যেমন: কমল+কে=কমলকে, পৃথিবী+তে=পৃথিবীতে, শ্যাম+এর=শ্যামের, করিম+এর=করিমের প্রভৃতি।
কারকভেদে শব্দবিভক্তিকে সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়মানুযায়ী প্রথমা, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী, ষষ্ঠী ও সপ্তমী বিভক্তিরূপে বিভাজিত করা হয়েছে। আলোচনার সুবিধার্থে বলে রাখি ‘র’ এবং ‘এর’ হলো ষষ্ঠী বিভক্তির উদাহরণ। বিভক্তি সবসময় শব্দের সঙ্গে সেঁটে থাকে। একে আলাদা করে লেখা যায় না।
সর্বনাম: বিশেষ্য কিংবা বিশেষ্যস্থানীয় খণ্ডবাক্য ও বাক্যাংশের পরিবর্তে বসে এমন পদকে বলা হয় সর্বনাম। এর আরেক নাম প্রতিনাম। যেমন: আমি, তুমি, সে, যাঁর, তাঁর, কে, এটি, কী প্রভৃতি সর্বনামের উদাহরণ। পুরুষভেদে সর্বনামের তিনটি ভাগ: উত্তমপুরুষ, মধ্যমপুরুষ এবং প্রথমপুরুষ। রচনায় সর্বনাম ব্যবহারের একটি অন্যতম কারণ হলো, একই বিশেষ্য পদের বারবার ব্যবহার পরিহার করা। যেমন: “নবীনদা আমাদের গ্রামে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছেন। ‘তাঁর’ এই মহৎ কীর্তি এ গ্রামের সকলেই স্বীকার করেন।” এখানে তাঁর শব্দটি হলো সর্বনাম। আর তাকে সম্মান প্রদর্শনের লক্ষ্যে তার শব্দে চন্দ্রবিন্দু বসেছে।
এবার আসি মূল প্রসঙ্গে লেখার শুরুতে দুটো বাক্য অশুদ্ধ বলেছিলাম, এর প্রথম কারণ হলো বাক্যদ্বয়ে ব্যবহৃত ‘এঁর’ হলো ষষ্ঠী বিভক্তি। এটি সর্বনাম নয়। সে হিসেবে ‘এঁর’ ওপর কখনো সম্মানসূচক চন্দ্রবিন্দু বসার প্রশ্নই ওঠে না। আর ষষ্ঠী বিভক্তি শুদ্ধরূপে ব্যবহারের শর্ত হিসেবে ‘এর’ পদটি সংশ্লিষ্ট পদের সঙ্গে সেঁটে বসার কথা ছিল। কিন্তু উল্লিখিত বাক্যদ্বয়ে এই শর্ত দুটোর কোনোটিই মান্য হয়নি। তাই উল্লিখিত বাক্যদ্বয় অশুদ্ধ।
সুতরাং লিখতে হবে ‘আজ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন’ বা ‘আজ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকী’। কেননা এ দুটোতেই বিভক্তি হিসেবে ‘এর’ যুক্ত হয়েছে। অনুরূপ, ‘রবীন্দ্রনাথের কবিতা’, ‘নজরুলের গজল’, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী, শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মবার্ষিকী প্রভৃতি লিখতে হবে। এ পদবন্ধ থেকে কখনোই ‘এর’ আলাদা করা ব্যাকরণসম্মত নয়। এটি স্পষ্টতই ভুল প্রয়োগ।
তবে বাক্যে পরিস্থিতির প্রসঙ্গ (Context of situation) অনুসারে ‘এঁর’ পদটি সর্বনাম হিসেবে ব্যবহার করা হলেও তা সংশ্লিষ্ট শব্দের সঙ্গে সেঁটে বসবে না। সর্বনাম আলাদা পদ হিসেবে বসবে। যেমন: ‘করিম সাহেব এ গ্রামের মাথা। এঁর কথা এ গ্রামের সকলেই মান্য করে।‘ এখানে ‘এঁর’ হলো সর্বনাম। আবার করিম সাহেবের সম্মানার্থে এখানে চন্দ্রবিন্দুর ব্যবহার সিদ্ধ হয়েছে। এভাবে সর্বনাম হিসেবে ‘এঁর’ ব্যবহার ভুল না হলেও আমাদের ভাষিক প্রতিবেশে এর ব্যবহার বিরল। ভাষা প্রয়োগের এ ধরনটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পরিলক্ষিত হলেও আমাদের সংস্কৃতি, ভাষাবোধ এবং ভাষাপ্রয়োগে এর ব্যবহার অপেক্ষাকৃত অনেক কম। সুতরাং বিভক্তি এবং সর্বনামের বিষয়টি বিবেচনা করেই ‘এর’ এবং ‘এঁর’ প্রয়োগ বাঞ্ছনীয়।
চোরে চোরে মাসতুতো ভাই
লোকসংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বাগধারা ও প্রবাদ-প্রবচন। লোকসমাজে গভীর চিন্তা বা প্রাজ্ঞ কিছু প্রকাশ করার জন্য প্রবাদে-প্রবচন ও বাগধারার বিকল্প নেই। একটি গভীর সমস্যা প্রকাশ করতে যেখানে অনেক কথা বলতে হয় সেখানে একটি প্রবাদই যথেষ্ট। অনেক প্রবাদ এমনই শক্তিশালী যে তা দেশের লোকসমাজের সর্বত্র প্রচলিত। আবহমান কাল থেকে প্রচলিত লোকসমাজের প্রজ্ঞাপূর্ণ, যৌক্তিক ও অভিজ্ঞতানির্ভর প্রাঞ্জল প্রকাশই বিদ্বৎসমাজে প্রবাদ-প্রবচনরূপে প্রচলিত।
এমনই একটি জনপ্রিয় প্রবাদ হলো ‘চোরে চোরে মাসতুতো ভাই’। এই প্রবাদটির অর্থ হলো অন্যায় কাজে সায় দেওয়া কিংবা অন্যায়কারীর পক্ষ অবলম্বন করে অন্যায়ের সহযোগী হওয়া। কিন্তু প্রশ্ন হলো চোরে চোরে মাসতুতো ভাই কেন? অন্য কোনো ভাই কি হতে পারতো না? এ পেছনের গল্পটা কী? তবে চলো জেনে নিই।
একদল চোর শেষ রাতের দিকে এক বর্ধিষ্ণু গৃহস্থ বাড়ি থেকে বেশ কিছু বাসনপত্র চুরি করেছিল। আলো ফুটতেই তারা সমস্যায় পড়ে। কারণ সকালে লোকের চোখে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। পাছে ধরা পড়ে যায়, সেই ভয়ে চোরেরা সংলগ্ন এক সহিসের আস্তাবল থেকে একটি খাটিয়া চুরি করে।
তার পরে সেই খাটিয়াতে চোরাই মালগুলো রেখে তাকে মৃতদেহের মতো করে সাদা চাদরে ঢেকে দেয় এবং ‘বলো হরি হরি বোল’ বলতে বলতে রাস্তা দিয়ে চলতে শুরু করে। গ্রামের লোকজন মনে করে কেউ বোধহয় মারা গিয়েছেন। আর তাকে দাহ করতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ফলে সন্দেহ করে না।
পথে এক পাকা চোরের সঙ্গে দেখা। সেই সেয়ানা চোর কিন্তু একবার মৃতদেহের দিকে তাকিয়েই সবকিছু বুঝতে পেরে যায়। কারণ মৃতদেহ ঢাকা দেওয়া কাপড়ের তলা দিয়ে চোরাই বদনার নল দেখা যাচ্ছিল। চোরের সর্দারকে সে কথা জানাতেই বাকি চোরেরা সেই পাকা চোরকে তাদের দলে যোগ দিতে বলে। এও জানায় যে, তাকেও সমান ভাগ দেওয়া হবে।
পাকা চোর খুশি হয়ে নিজে থেকে এগিয়ে এসে খাটিয়া বহনের ভাগ নিতে কাঁধ লাগায়। কারণ সর্বসমক্ষে ভাগ নেওয়ার আহ্বান মানে মড়া বহনের ভাগ নেওয়া। পাকা চোর ইঙ্গিত বুঝে কাজে নামে এবং প্রকাশ্যে জানতে চায়, ‘মেসো কখন মরেছে?’ অর্থাৎ, মৃতের স্ত্রী যেন তার মাসি এবং বাকি চোরেরা তার মাসতুতো ভাই। সেই থেকেই নাকি এই প্রবাদের উদ্ভব হয়েছে।
সমস্ত বাংলা প্রবাদের সঠিক উৎস সম্পর্কে কোনও প্রামাণ্য নথি পাওয়া যায় না। দীর্ঘদিন ধরে লোকমুখে প্রচার হতে হতে এগুলো ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠা পায়। এ প্রবাদটির উৎস সম্পর্কেও একই কথা বলা চলে। তবে উল্লিখিত গল্পটির সূত্র হিসেবে সুবল চন্দ্র মিত্রের ‘সরল বাঙ্গালা অভিধানটি দেখা যেতে পারে।
ট্যাবু বা সুভাষণ
ভাষাবিজ্ঞানে ‘ট্যাবু’ বলে একটি পারিভাষিক শব্দ রয়েছে, যার বাংলা অর্থ হলো সুভাষণ। যে শব্দের অর্থ মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব বা কঠিন; যে শব্দের উচ্চারণ সর্বত্র শোভন নয় বা যে শব্দের ওপর সামাজিক বিধিনিষেধ আছে, সেগুলোর জন্য সভ্য ভাষাভাষী সমাজে বেছে নেওয়া হয় এক বা একাধিক এমন শব্দ, যাতে মূল অর্থ টিকে থাকলেও প্রকাশের কারণে সেই অর্থের চাপ কমে আসে বা থাকে না। অর্থাৎ অকল্যাণকর বা নেতিবাচক কোনো কথার পরিবর্তে ইতিবাচক ও মঙ্গলময় কথা ব্যবহার করার বিষয়টিকেই ভাষাবিজ্ঞানে সুভাষণ বলে।
‘সুভাষণ’ বাংলা পরিভাষাটি নিজেই সুভাষণের একটি উদাহরণ। ইংরেজি ‘Euphemism’ শব্দটির গোড়া গ্রিক। অর্থ হলো যে কথা শুনতে ভালো লাগে। আর একটু সুভাষিত করে বললে, ‘শ্রুতিমধুর বচন’। ভাষাচার্য সুকুমার সেন সুভাষণের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, অকল্যাণসূচক অথবা নিন্দিত বা কুৎসিত অর্থকে কল্যাণসূচকরূপে বা ভদ্রভাবে প্রকাশ করার জন্য ভাষায় সুভাষণ অলংকারের আশ্রয় নেওয়া হয়। নিচে ট্যাবু বা সুভাষণের কিছু উদাহরণ দেওয়া হলো:
মারা যাওয়া > গঙ্গা লাভ করা বা ঈশ্বরপ্রাপ্তি ঘটা
চাল ফুরিয়ে গেছে > চাল বাড়ন্ত
যদি তিনি মারা যান > তার যদি ভালোমন্দ কিছু হয়ে যায়
কাজের মেয়ে > গৃহপরিচারিকা
গার্মেন্টস কর্মী > বস্ত্রবালিকা
গরিব লোক > অল্প আয়ের ব্যক্তি
আজ তাহলে যাই > আজ তাহলে আসি
বসন্ত রোগ > মায়ের দয়া বা মায়ের অনুগ্রহ প্রভৃতি।