বিধবা ও তোতাপাখি, শেষ কিস্তি

ব্রিটিশ সাহিত্যিক ভার্জিনিয়া উলফ (১৮৮২ - ১৯৪১) শিশু-কিশোরদের জন্য ‘দ্য উইডো অ্যান্ড দ্য প্যারট’ শিরোনামে এ গল্পটি লেখেন ১৯২২-২৩ সালে। প্রায় ৬৬ বছর অজ্ঞাত অবস্থায় থাকার পর এ পাণ্ডুলিপিটি আবিষ্কার করেন উলফের ভাইয়ের ছেলে লেখক কোয়েটিন বেল। ১৯৮৮ সালে এটি বই আকারে প্রকাশিত হয়।

ফাহিমা কানিজ লাভাফাহিমা কানিজ লাভা
Published : 11 Nov 2022, 04:39 AM
Updated : 11 Nov 2022, 04:39 AM

মিসেস গেজ যখন বিছানায় শুয়ে এসব ভাবছিলেন, তখন হঠাৎ জানালায় সামান্য টোকা দেওয়ার মতো শব্দ হলো। পরপর তিনবার কেউ টোকা মারল। মিসেস গেজ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিছানা থেকে নেমে জানালার কাছে গেলেন। অবাক হয়ে দেখলেন, জানালার ধারে বসে ছিল একটা মস্ত বড় তোতাপাখি।

বৃষ্টি থেমে গেছে এবং এটা একটা সুন্দর চাঁদনী রাত ছিল। তিনি প্রথমে খুব শঙ্কিত হয়েছিলেন, কিন্তু শীঘ্রই ধূসর তোতা জেমসকে চিনতে পারলেন। পাখিটা যে পালিয়ে বাঁচতে পেরেছে- তা দেখে মিসেস গেজ সত্যিই আনন্দিত হলেন। তিনি জানালা খুললেন এবং পাখিটার মাথায় কয়েকবার টোকা দিয়ে তাকে ভেতরে আসতে বললেন।

তোতাপাখি আলতো করে তার মাথা এদিক-ওদিক নাড়িয়ে যেন এর উত্তর দিল। তারপর উড়ে মাটিতে বসল, কয়েক কদম সামনে গেল। তারপর আবার পেছনে ফিরে তাকাল যেন দেখতে পারে মিসেস গেজ পিছু পিছু আসছিলেন কিনা। তারপর পাখিটা গেল জানালার ধারে, যেখানে মিসেস গেজ একটু আগে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

হঠাৎ করেই সে খুবই উত্তেজিত হয়ে ডানা ঝাপটাতে লাগল এবং বারবার তার ঠোঁট দিয়ে মেঝেতে টোকা দিতে লাগল। এসময় সে খুব চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘বাড়িতে কেউ নেই! বাড়িতে কেউ নেই!’

মিসেস গেজ নিজেকে বললেন, ‘প্রাণীটার কাজের মধ্যে আমাদের জানার চেয়েও বেশি কোনো অর্থ আছে। খুব ভালো, জেমস।’ তিনি উচ্চস্বরে বললেন। মিসেস গেজ পাখিটার সাথে এমনভাবে কথা বললেল যেন সে একজন মানুষ। ‘আমি তোমার কথা মেনে নেব। আমার কাপড়টা ঠিক করা পর্যন্ত একটু অপেক্ষা কর।’ এই বলে তিনি একটা বড় অ্যাপ্রোনের ওপর পিন লাগালেন। এরপর যতটা সম্ভব নিঃশব্দে নিচে নামলেন এবং মিসেস ফোর্ডকে না জাগিয়ে একাই বেরিয়ে গেলেন।

বোঝাই যাচ্ছিল যে তোতা জেমস বেশ সন্তুষ্ট ছিল। সে কয়েক গজ সামনে এগিয়ে পুড়ে যাওয়া বাড়িটার দিকে চলে গেল। মিসেস গেজও তাকে যত দ্রুত সম্ভব অনুসরণ করছিলেন। তোতাপাখিটি এমনভাবে যাচ্ছিল যেন সে তার পথটি পুরোপুরি জানে। সে গেল বাড়ির পেছনের দিকে, যেখানে রান্নাঘরটা ছিল। সেখানে ইটের মেঝে ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই, যেটা তখনও আগুন নেভানোর জন্য ছুঁড়ে মারা পানির কারণে ভেজা ছিল। মিসেস গেজ বিস্ময়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন যখন জেমস এদিক-ওদিক ঠোঁট দিয়ে ঠুকরে ইটগুলো পরীক্ষা করছিল। খুব অদ্ভুত একটা দৃশ্য। মিসেস গেজের যদি পশুদের সাথে থাকার অভ্যাস না থাকত, তাহলে সম্ভবত এতক্ষণে তিনি মাথা গরম করে বাড়ি ফিরে যেতেন।

কিন্তু আরও অদ্ভুত ব্যাপার তখনও বাকি। এতক্ষণ তোতাপাখিটা একটা কথাও বলেনি। হঠাৎ করেই সে খুবই উত্তেজিত হয়ে ডানা ঝাপটাতে লাগল এবং বারবার তার ঠোঁট দিয়ে মেঝেতে টোকা দিতে লাগল। এসময় সে খুব চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘বাড়িতে কেউ নেই! বাড়িতে কেউ নেই!’ মিসেস গেজ ভয় পাচ্ছিলেন যে পুরো গ্রামটাই না জেগে যায়!

‘এত উত্তেজিত হয়ো না জেমস, তুমি তো নিজেরই ক্ষতি করে বসবে।’ রেগে বললেন মিসেস গেজ। কিন্তু পাখিটা আগের চেয়ে আরও বেশি হিংস্রভাবে ইটের উপর তার আক্রমণ চালিয়ে যেতে লাগল। ‘এর মানে কী হতে পারে?’ রান্নাঘরের মেঝেতে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে বললেন মিসেস গেজ। চাঁদের আলো যথেষ্ট উজ্জ্বল ছিল। সেই আলোয় তিনি বুঝতে পারছিলেন যে বিছিয়ে রাখা ইটগুলোর মধ্যে কয়েকটা ইট ছিল অন্যগুলোর তুলনায় অসমান। মনে হচ্ছিল যেন সেগুলো তুলে নেওয়া হয়েছিল। তিনি একটি বড় সেফটিপিন দিয়ে তার অ্যাপ্রোনটি বেঁধে রেখেছিলেন। এবার তিনি ইটের মধ্যে সেই পিনটি দিয়ে চাপ দিয়ে বুঝতে পারলেন সেগুলো একেবারেই আলগাভাবে রাখা হয়েছে।

খুব শীঘ্রই তিনি সেখান থেকে একটা ইট নিজের হাতে তুলে নিলেন। মিসেস গেজ একটা ইট তুলতে না তুলতেই তোতাপাখিটা পাশের আরেকটি ইটের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং তার ঠোঁট দিয়ে সেটাকে টোকা দিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘বাড়িতে কেউ নেই!’ এর মানে মিসেস গেজ বুঝতে পারলেন, এই ইটটাও সরাতে হবে। তাই তারা চাঁদের আলোয় ইটগুলো তুলতে থাকল, যতক্ষণ না তারা ছয় ফুট বাই সাড়ে চার ফুটের মতো একটা জায়গা খালি করে ফেলল। এবার তোতার মনে হলো যথেষ্ট হয়েছে, কিন্তু এবার কী করতে হবে?

মিসেস গেজ একটু জিরিয়ে নিলেন এবং ঠিক করলেন তোতা জেমস তার আচরণ দিয়ে তাকে যেভাবে পরিচালনা করবে, সেভাবেই তিনি চলবেন। অবশ্য বেশিক্ষণ জিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হলো না। কয়েক মিনিটের জন্য পাখিটা বালুময় ভূমিতে আঁচড় দেওয়ার পর, যেমনটা আপনি হয়তো দেখে থাকবেন মুরগিকে তার নখ দিয়ে বালুতে আঁচড় দিতে, সে গোলাকার হলুদ পাথরের পিণ্ডের মতো কিছু একটা খুঁজে বের করলো। তার উত্তেজনা এতটাই বেড়ে গেল যে মিসেস গেজ তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে গেলেন। তিনি বিস্ময়ের সাথে দেখলেন যে তারা যে জায়গাটা খুঁড়ে বের করেছিল, তা এই গোলাকার হলুদ পাথরের লম্বা রোল দিয়ে ভরা। সেগুলো এত সুন্দরভাবে একসাথে রাখা হয়েছে যে তাদের সরানোটা বেশ কঠিন কাজই ছিল। 

যে মুহূর্তে মিসেস গেজ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন, জেমস তোতাপাখিটা চিৎকার করে উঠল, ‘বাড়িতে কেউ নেই! বাড়িতে কেউ নেই!’ সেই সঙ্গে তার দাঁড়ানোর লাঠিটা থেকে পড়ে মরে গেল।

কিন্তু সেখানে কী থাকতে পারে? আর কী উদ্দেশ্যেই বা তাদের এখানে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর তারা ততক্ষণ পাবে না যতক্ষণ তারা উপরের পুরো স্তরটি সরিয়ে ফেলল। এরপর তারা এর নিচে পড়ে থাকা অয়েলক্লথের টুকরাটিও সরিয়ে ফেলল। এবার তারা চোখের সামনে যা দেখল, তা যেন বিশ্বাস করাই কঠিন! সারিবদ্ধ ও সুন্দরভাবে পালিশ করা হাজার হাজার মুদ্রা সেখানে রাখা। সেগুলো উজ্জ্বল চাঁদের আলোতে চকচক করে উঠল!

তাহলে এই ছিল কৃপণ জোসেফের গুপ্তধন লুকিয়ে রাখার জায়গা! লোকটা এটাও নিশ্চিত করেছিলেন যে এত সহজে যেন কেউ এটা খুঁজে না পায়। প্রথমত, তিনি তার ধন-সম্পদ যেখানে লুকিয়ে রেখেছিলেন, সেখানে একটি রান্নাঘর তৈরি করেছিলেন, তা-ও এমনভাবে যেন আগুন সেগুলোকে ধ্বংস করতে না পারে এবং গুপ্তধনের অস্তিত্ব কেউ অনুমান করতে না পারে। দ্বিতীয়ত, তিনি মুদ্রাগুলোর উপরের স্তরে কিছু আঠালো পদার্থ দিয়ে প্রলেপ করে দিয়েছিলেন, তারপর সেগুলোকে মাটিতে গড়িয়ে দিয়েছিলেন। এতে করে যদি কেউ ঘটনাক্রমে জায়গাটা আবিষ্কার করেও ফেলত, দেখত যে সেখানে নুড়ি পাথর ছাড়া আর কিছুই নেই। সুতরাং, শুধু আগুন লাগার মতো একটা কাকতালীয় ঘটনা এবং তোতাপাখির বিচক্ষণতার কারণেই জোসেফের এত অসাধারণ নৈপুণ্য ধরা পড়ে গেল।

মিসেস গেজ এবং তোতা খুব পরিশ্রম করে মুদ্রাগুলোকে সরিয়ে ফেলল, যার সংখ্যা ছিল তিন হাজার, বেশিও না কমও না। সেগুলো মিসেস গেজ মাটিতে তার অ্যাপ্রোনটি ছড়িয়ে দিয়ে তার ওপর রাখলেন। তিন হাজারতম মুদ্রাটি অ্যাপ্রোনে রাখার পর তোতাটা বিজয়ীর মতো আনন্দে বাতাসে উড়ল এবং মিসেস গেজের মাথার উপরে খুব মৃদুভাবে নামল। এরপর তারা খুব আস্তে আস্তে মিসেস ফোর্ডের কুটিরে ফিরে এলো, কারণ মিসেস গেজ খোঁড়া ছিলেন, যেমনটি আমি আগেই বলেছি। আর তাছাড়া এখন তিনি তার অ্যাপ্রোনে থাকা সম্পদের ভারে আরও ধীর হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু কেউ কিছু জানা বা বোঝার আগেই তিনি সেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া বাড়িটা ছেড়ে গেলেন।

পরদিন তিনি ইয়র্কশায়ারে ফিরে এলেন। মিস্টার স্টেসি তাকে আরও একবার লুইসে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং মিসেস গেজের কাঠের বাক্সটি কতটা ভারি হয়ে উঠেছে তা দেখে বরং অবাকই হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি একজন শান্ত প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তিনি শুধু এই উপসংহারে পৌঁছেছিলেন যে রডমেলের সদয় লোকেরা আগুনে সমস্ত সম্পত্তির ভয়ঙ্কর ক্ষতির জন্য মিসেস গেজকে সান্ত্বনা দিতে কিছু উপহার দিয়েছিল। হৃদয়বান মিস্টার স্টেসি অর্ধেক মুকুটের বিনিময়ে তোতাপাখিটাকে কেনার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন, কিন্তু মিসেস গেজ একরকম ক্ষোভের সাথে তার সেই সদয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে তিনি ইন্ডিজের সমস্ত সম্পদের বিনিময়েও পাখিটা বিক্রি করবেন না। ফলে মিস্টার স্টেসি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে বৃদ্ধ এই নারী সমস্যায় ভুগে ভুগে পাগল হয়ে গেছেন।

এখন শুধু বলা যায় যে মিসেস গেজ তার নিরাপত্তার জন্য স্পিলবিতে ফিরে এসেছেন। সেখানে সাথে করে তিনি তার কালো বাক্সটি ব্যাংকে নিয়ে গেলেন এবং তোতা জেমস ও তার কুকুর শ্যাগের সাথে অনেক বয়স পর্যন্ত খুব আরাম ও সুখে বসবাস করেছিলেন।

মৃত্যুশয্যায় শুয়ে থাকার সময় তিনি পাদ্রীকে (রেভারেন্ড স্যামুয়েল ট্যালবয়েসের ছেলে) পুরো ঘটনাটি বলেছিলেন। তিনি আরও নিশ্চিত ছিলেন যে তোতা জেমস ইচ্ছে করেই ওই বাড়িটি পুড়িয়ে দিয়েছিল, এমনকি সে নদীর তীরে তার বিপদ সম্পর্কেও সচেতন ছিল। পাখিটা কেবল তাকে ডুবে যাওয়া থেকেই রক্ষা করেনি, বরং তিন হাজার মুদ্রার সন্ধানও দিয়েছিল, যা অন্য কোনো উপায়ে পাওয়া যেত না। এটা পশুপাখিদের প্রতি তার দয়ার পুরস্কার।

পাদ্রী ভাবল, বুড়িটা মনে মনে তার অতীতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এটা নিশ্চিত যে, যে মুহূর্তে মিসেস গেজ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন, জেমস তোতাপাখিটা চিৎকার করে উঠল, ‘বাড়িতে কেউ নেই! বাড়িতে কেউ নেই!’ সেই সঙ্গে তার দাঁড়ানোর লাঠিটা থেকে পড়ে মরে গেল। কুকুর শ্যাগও কয়েক বছর আগে মারা গিয়েছিল।

রডমেলের দর্শনার্থীরা এখনও সেই বাড়িটার ধ্বংসাবশেষ দেখতে পায়, যা পঞ্চাশ বছর আগে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সাধারণভাবে এটা বলা হয় যে আপনি যদি চাঁদের আলোতে এটি দেখতে যান, তাহলে আপনি শুনতে পাবেন একটি তোতাপাখি তার ঠোঁট দিয়ে ইটের মেঝেতে টোকা দিচ্ছে। অনেকেই অবশ্য সেখানে একজন বৃদ্ধ নারীকে সাদা অ্যাপ্রোন পরে বসে থাকতেও দেখেছেন। 

কিডজ ম্যাগাজিনে বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!