‘শিশুর পাঠাভ্যাস গড়তে নিজেদেরও বই পড়তে হবে’

‘কিডজ’ এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে কথাসাহিত্যিক শাহনাজ মুন্নী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক কবি মাজহার সরকার।

কিডজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Feb 2023, 05:41 AM
Updated : 11 Feb 2023, 05:41 AM

শাহনাজ মুন্নী কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক। তার লেখা গল্প, কবিতা, উপন্যাস, শিশুসাহিত্য ও প্রবন্ধ মিলে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ২৪। উল্লেখযোগ্য বই হলো ‘জ্বীনের কন্যা’, ‘এক ক্রুদ্ধ অন্ধকার’, ‘বাদুর ও ব্র্যান্ডি’, ‘তৃতীয় ঘণ্টা পড়ার আগেই’, ‘পান সুন্দরী’ ইত্যাদি। শিশুকিশোরদের জন্য লিখেছেন ‘সেন্ট মার্টিনের সেন্টু মিয়া’, ‘পিঁপড়ার আমেরিকা ভ্রমণ’ ও ‘রাত তেরটা’।

অমর একুশে বইমেলা উপলক্ষে ‘কিডজ’ এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে নিজের শৈশব–কৈশোরের গল্প শুনিয়েছেন শাহনাজ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক কবি মাজহার সরকার।

আপনি ৩০ বছর ধরে সাহিত্যচর্চা করছেন, এবছর ‘অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার’ পেয়েছেন। আপনাকে অভিনন্দন জানাই, আর আপনার অনুভূতি জানতে চাই?

আমার মনে হয়েছে যে, এ পুরস্কারপ্রাপ্তি আমার মা-সন্তান-স্বজন-বন্ধু এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের অনেক আনন্দিত করেছে। তাদের আনন্দ দেখে আমার আনন্দ হয়েছে। পুরস্কার একটা অনুষঙ্গ, যেটা ভেবে তো আর লেখক লিখেন না, তিনি লিখেন প্রত্যাশা ছাড়া। তারপরও যখন পুরস্কারপ্রাপ্তির ঘটনা ঘটে তখন একটা বাড়তি পাওয়া। আমি বিষয়গুলো এভাবে দেখি।

আপনার লেখালেখির শুরুটা কীভাবে? লেখালেখিতে কোনো ব্যক্তি বা শৈশব-কৈশোরের ঘটনা অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে কি, আর কীভাবে?

ছোটবেলায় আমার পারিবারিক পরিবেশটাই ছিল খুব পড়াশোনার উপযোগী। বাসায় পাঠ্যপুস্তকের বাইরে অনেক বই ছিল। আমার বাবা-মা, খালা-মামা, প্রত্যেকেরই পাঠাভ্যাস ছিল। তাদের সঙ্গেই তো আমার বেড়ে ওঠা, আমারও ছোট্টবেলা থেকে পাঠাভ্যাস গড়ে ওঠে। তখন গোগ্রাসে পড়তাম আরকি। যা কাছে পেতাম তা-ই পড়তাম, কোন বাছাই ছাড়া। ওই অর্থে বোধ হয় একপর্যায়ে আমার মধ্যে লেখকসত্তার জন্ম হয়েছে। আমি লিখতে শুরু করি ছোট্টবেলায়, সেটা ফাইভ-সিক্সে থাকতেই। কোথাও ছাপতে দিতাম না, কিন্তু যা মনে আসতো তা-ই লিখতাম।

আপনি পেশায় সাংবাদিক। নিজের পেশাগত দায়িত্বের বাইরে সাহিত্যচর্চা করছেন। এ লড়াইটা কেমন?

আমি সাহিত্যচর্চাটা জীবনযাপন থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাই না। খুব সময় করে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে নির্জনকক্ষে গিয়ে তারপর লিখতে হবে- এমন কোনকিছু করি না। আমি এটাকে আমার জীবনচর্চার অংশ হিসেবে নিয়েছি। যে কারণে আমি যেরকম চাকরি করছি, যেরকম রান্না করছি, যেরকম সংসার করছি, সন্তান লালন-পালন করছি, তেমন করে সাহিত্যচর্চাও করছি। এটা আমার প্রতিদিনের জীবনযাপনের অংশ। প্রতিদিন চেষ্টা করছি অন্তত একটি লাইন লিখতে। অনেক কাজের ভিড়েও চেষ্টা করছি অন্তত দুটো শব্দ লিখতে। মাথায় যখন কোন আইডিয়া এসেছে, আমি সেটা যে অবস্থায় থাকি- পথেঘাটে থাকি যেখানেই থাকি নোট করে রাখি, একটু সুযোগ পেলেই লিখতে বসি, আমার নিজের কাজ গুছিয়ে যদি একটু সময় পাই। আমার সঙ্গে সবসময় ল্যাপটপ থাকে, খাতা-কলম থাকে। ট্রাফিক জ্যামে যখন আটকে থাকি আমি লিখি।

আপনার পেশা ও লেখালেখিতে একটা আগ্রহের বিষয় শিশু। শিশু-কিশোরদের জন্য বেশকিছু বই লিখেছেন, শিশুদের ওপর সংবাদ উপস্থাপন করে ২০০৯ সালে ‘মীনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ডস’ পেয়েছেন। শিশুদের নিয়ে কাজ করার আগ্রহ কীভাবে এলো?

আমি আসলে শিশুদের নিয়েই লিখতাম। আমার ছোট্ট ভাই-বোনরা সেসব লেখা খুব পড়তো। তারপর বড় হওয়ার পর কিশোরদের নিয়ে লিখতাম। যখন আমার সন্তান জন্ম নিলো তখন আমি ওদের জন্য লিখলাম। কারণ বড়দের লেখা তো ওরা বোঝে না, ছোটদের লেখা বোঝে। বানিয়ে বানিয়ে ওদের অনেক গল্প শোনাতাম, এ গল্পগুলোই একসময় লিখতে শুরু করলাম। আমি মনে করি, শিশুদের জন্য শিশু-উপযোগী লেখা খুব দরকার। শিশুরা তো ভবিষ্যতের পাঠক। তারা যদি ভালো বই পড়ে একটা রুচি গড়ে ওঠে, তার সাহিত্য-চেতনাবোধ গড়ে ওঠে, পাঠাভ্যাস গড়ে ওঠে। সেটি আমাদের সমাজের জন্য, দেশের জন্য উপকার। এজন্য আমি মনে করি লেখকদের উচিত শিশুকিশোর পাঠকদের জন্য কিছু না কিছু লিখা, যাতে এই শিশুটি তার চরিত্র গঠন করতে পারে, আনন্দ উপভোগ করতে পারে।

গণমাধ্যমে দর্শক হিসেবে প্রাপ্তবয়স্কদের প্রাধান্য দিতে দেখা যায়, শিশুদের উপর সংবাদ পরিবেশনে কী কী নীতি থাকা উচিত বলে মনে করেন?

বাসার ড্রইংরুমে টেলিভিশনে যখন সংবাদ চলে তখন বাড়ির শিশুটিও সঙ্গে থাকতে পারে। আমরা যখন সংবাদ পরিবেশন করি তখন বড়রা একভাবে নিই, আর শিশুরা আরেকভাবে নেয়। সুতরাং আমাদের একটু সংবেদনশীল হতে হবে যে আমি যেভাবে সংবাদটি লিখছি বা পরিবেশন করছি তা শিশুমনে যেন কোন বিরূপভাব তৈরি না করে। টেলিভিশন কিংবা পত্রিকায় শিশুকিশোরদের সংবাদ কমই থাকে। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় সংবাদটিতে শিশুও যুক্ত আছে। যখন শিশুরা সংশ্লিষ্ট থাকে তখন একটু ভেবেচিন্তে লিখতে হয়, যাতে শিশুর মানসিক কোন সমস্যা না হয়। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, একজন শিশুরও কথা বলার অধিকার নিশ্চয় আছে। সুতরাং সংবাদে তাকে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। তার বক্তব্য বা মতামত কী তা জানতে হবে। অনেক সময় শিশুদের নিয়ে সংবাদে শিশুকেই উপেক্ষা করা হয়। যাকিছু শিশু বিষয়ক, যাকিছু তাদের কল্যাণের জন্য জরুরি সে বিষয়গুলো জনসম্মুখে তুলে ধরতে হবে। শিশুদের অধিকার এবং তাদের বঞ্চনার বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে।

আমাদের জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ শিশু। তাদের অধিকাংশ শিক্ষাবঞ্চিত বা ঝরে পড়া। এ অবস্থায় আমাদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাক্রমে পাঠ্যবই নিয়ে ফি-বছর নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে, সিলেবাস পরিবর্তন করা হয়। একটি স্থিতিশীল পাঠ্যক্রম তৈরিতে আপনার পরামর্শ কী?

পাঠ্যপুস্তক যুগোপযোগী করতে হলে সেটা তো পরিবর্তন করতে হবে। কোনকিছুই আসলে স্থিতিশীল না। আমরা ছোটবেলা যে জগতে বড় হয়েছি এখন শিশুদের সে জগত ভিন্ন, পরিবর্তন তো দরকার। কিন্তু সেই পরিবর্তনটা যারা করবেন তারা যেন সঠিকভাবে করেন। শিশুর কী জরুরি- বিষয়গুলো যারা ভাবেন যারা গবেষণা করেন তাদেরই এই কাজ করা উচিত। আবার এই যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে শিশুদের ভুল তথ্য দেওয়া, তাদের বিভ্রান্ত করা, এ জিনিসগুলো বন্ধ হওয়া উচিত।

আগে জমিতে হালের লাঙল ফেলে ওই অবস্থায় প্রাথমিক স্কুলের অনেক শিক্ষক ক্লাস নিতে স্কুলে যেতেন, ক্লাস শেষে আবার লাঙল ধরতেন। ছুটির ঘণ্টা বাজতেই শিশুরা একসঙ্গে ছুটে মাঠের দিকে দৌড়াতো, খালি পায়ে জমির আল ধরে বাড়ি ফিরতো। শৈশবে প্রথম গল্প বা রূপকথা শোনা হতো নানী-দাদীর মুখে। এখনকার নগর কিংবা মফস্বল শহরের অনেক শিশু-কিশোর যেন ‘কাউচ পটেটো’। অনেকে সময়ের প্রয়োজনে অনলাইন ক্লাস, ইন্টারনেট ব্যবহারে অভ্যস্ত হচ্ছে। এ পরিবর্তনটা কীভাবে দেখছেন?

আপনি ঠিক বলেছেন, আসলে এখনকার শৈশব থেকে আমাদের শৈশব অন্যরকম ছিল। এখন মা-বাবারা দেখি শিশুর কান্না থামাতে মোবাইল ফোন খুলে দিয়ে বসে থাকে। প্রায় স্কুলগুলোতে খেলার মাঠ নেই। শিশুরা স্কুলে গিয়ে বদ্ধঘরের মধ্যে ঢোকে, কিছু পুঁথিপড়া অভিজ্ঞতা নিয়ে চলে আসে। যে ধরণের বিকাশ দরকার তা হচ্ছে না। কম্পিউটার-মোবাইল ফোন অবশ্যই দরকার, তবে আসক্তি ভয়াবহ বৃদ্ধি পেয়েছে। এক্ষেত্রে দুটি জিনিস লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অভিভাবকদের নিজেদের আচরণে পরিবর্তন আনা দরকার। তারা যদি শিশুকে মোবাইল ফোন দিয়ে ভাবে যে আমি আমার কাজটা করি আর সন্তান মোবাইলে খেলা করুক, শিশুতো এভাবেই অভ্যস্ত হবে। শিশুদের কোয়ালিটি টাইম দেওয়া, তাদের খেলাধুলা করার সুযোগ করে দেওয়া উচিত। বদ্ধ স্কুলগুলোতে বাইরের আলো-বাতাসের ব্যবস্থা করা উচিত। অনেক মা-বাবা সারাক্ষণ ‘পড় পড়’ করে, কিন্তু শিশু যদি দেখে মা-বাবাই বই পড়ছে না তাহলে তো সে এটাই শিখবে। নিজেরা না বদলালে শিশুকে বদলাতে পারবো না। আরেকটা ব্যাপার হলো, স্কুলে পাঠ্যপুস্তকের বাইরে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হতে শিশুদের উৎসাহিত করতে হবে।

আপনার প্রথম গল্পের বই ‘জ্বীনের কন্যা’, প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। গল্প লিখতে আসলে কী কী লাগে?

‘জ্বীনের কন্যা’ অনেকগুলো ছোটগল্পের সংকলন। ওখানে প্রায় ১০-১২টা ছোটগল্প আছে। ওগুলো আমি বিভিন্ন সময় লিখেছি। তখন মাস্টার্স পাস করলাম, ১৯৯৪ সালে। তার আগে থেকে লেখা শুরু হয়েছিল। গল্প লেখার জন্য হয়কি অভিজ্ঞতার বিষয় থাকে, কল্পনার একটা ব্যাপার থাকে। হয়তো ছোট্ট একটা বাস্তব গল্প শুনলাম কারও কাছে, তার উপর ভর করে বাকিটা কল্পনা মিশিয়ে গল্পটা তৈরি করা। যেমন ‘জ্বীনের কন্যা’ গল্পটা আমি আমার মায়ের কাছ থেকে শুনেছিলাম। মায়ের গ্রামে একজন নারী ছিলেন যিনি জ্বীন পালতেন। তিনি গ্রাম থেকে একটু দূরে থাকতেন। ওই গল্পটা হচ্ছে মূল ভিত্তি। বাকিটা কল্পনা মিশিয়ে লিখেছি।

আপনার প্রিয় লেখক কে এবং কেন? প্রিয় কোন বই?

আমিতো অনেক লেখকের বই পড়ি, তারপরও কিছু নাম বলতে পারি- বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর। অমিয়ভূষণ মজুমদারের কথাও বলা যায়। দীর্ঘ পাঠপরিক্রমায় অনেকের লেখা পড়েছি। আমার অসংখ্য প্রিয় লেখক, অনেক প্রিয় বই।

এবারের বইমেলায় আপনার নতুন কী বই প্রকাশিত হয়েছে? বিষয়বস্তু কী?

বইমেলায় মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত হয়েছে আমার উপন্যাস ‘স্নানের শব্দ’। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র একজন নারী, যিনি তার কর্মজীবনের সর্বোচ্চ সাফল্য পেয়েছেন, তিনি তার প্রতিষ্ঠানের সিইও হয়েছেন। এ পর্যন্ত আসতে তাকে যে কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়েছে, নানা চড়াই-উতরাই, তার যে সংগ্রাম তার যে দুঃখ-বেদনা সবকিছু। আবার আনন্দ আছে, প্রাপ্তিও আছে। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অনেক সময় তাকে কৌশল করতে হয়েছে। তা করতে গিয়ে অনেক সময় নৈতিকভাবে তার অবস্থান সে ধরে রাখতে পারেনি। তাই মানসিক টানাপোড়েনও আছে। এ বিষয়গুলো নিয়ে উপন্যাস ‘স্নানের শব্দ’।

ভবিষ্যতে শিশুদের জন্য আরও কী লেখার বা করার পরিকল্পনা আছে আপনার?

শিশুদের জগত বিচিত্র। ওদের সঙ্গে মিশতে হবে, মনটা বুঝতে হবে। ওদের জন্য আরও কিছু গল্প লেখার ইচ্ছে আছে।

কিডজ ম্যাগাজিনে বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!