তুরস্কে গেলে যে পাঁচটি খাবার না খেলেই নয়, কী সেগুলো?
Published : 12 Apr 2025, 02:41 AM
পৃথিবীর প্রতিটি সংস্কৃতি তার নিজস্ব রন্ধনশৈলীর ভেতর দিয়ে কথা বলে। গানের মতো, গল্পের মতো, স্মৃতির মতো খাবারও একেকটা জাতির আত্মপরিচয়ের অদৃশ্য ভাষা হয়ে ওঠে। যেমন আমাদের দেশের একবেলা খিচুড়ি বৃষ্টির সঙ্গে মিশে গিয়ে হয়ে ওঠে এক রসনার নাম, তেমনি তুরস্কের রাস্তাঘাট, পাহাড়-পর্বত, উপকূল আর প্রাচীন শহরগুলোর গহীনে লুকিয়ে আছে এমন কিছু খাবার, যেগুলো কেবল ক্ষুধা মেটায় না— জাগায় বিস্ময়।
ইতালিয়ান পাস্তা, চীনা নুডলস বা ভারতীয় কারির মতো তুর্কি খাবারও আজ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু এই পরিচয়ের মধ্যে লুকিয়ে আছে কিছু ‘নির্বাসিত রত্ন’— তুরস্কে জনপ্রিয় হলেও বিশ্বদরবারে তারা এখনো নিভৃতচারী। অধিকাংশ পর্যটকের চোখ কেবল কাবাব ও ডোনারে আটকে থাকে। অথচ ডোনার, এই মোহনীয় রোলের বাইরে পা ফেললেই এক বিস্ময়কর খাদ্যজগতের দরজা খুলে যায়— যেখানে কাঁপছে কেল্লা পাচার গাঢ় ঝোল, উঁকি দিচ্ছে কোকোরেচের রহস্যময় গন্ধ, মাংসের মতো গলে পড়ছে গুভেচ, মুরগির বুক পুডিং হয়ে জেগে উঠছে তাভুক গোসুতে আর চায়ের সঙ্গে চুমুক দিয়ে মিষ্টিমুখ করছে কাটমার।
এই লেখায় আমি তুলে ধরছি তেমনই পাঁচটি খাবারের কথা— তুরস্কে তারা সুপরিচিত হলেও আন্তর্জাতিক ভোজনরসিকের তালিকায় এখনো উঠেনি। কিন্তু তুরস্কে ভ্রমণের সময় এই খাবারগুলোর স্বাদ না পেলে সে যাত্রা যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। চলুন, সেই অদেখা স্বাদের খোঁজে যাই।
কেল্লা পাচা
ভেড়া বা ছাগলের মাথা ও পা দিয়ে তৈরি এই পুষ্টিকর স্যুপ শীতের সকালে বা অসুস্থতার ক্লান্তিকর মুহূর্তে প্রাণে নতুন জোয়ার আনে। কোলাজেন ও প্রোটিনে ভরপুর এই খাবারটি আমাদের নেহারির দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের মতো। তবে নেহারির তীক্ষ্ণ মশলার ঝাঁঝ এতে নেই। নেহারিতে যেমন বড় বড় নল্লি, রগ, ক্ষুরা বা গিঁটের দেখা মেলে, কেল্লা পাচায় তেমনটি নয়। বরং মাংস, রগ কিংবা মগজের ছোট ছোট টুকরোগুলো যেন ঝোলের মাঝে খেলা করে, স্বাদের এক কোমল নৃত্যে মেতে ওঠে।
কেল্লা পাচা প্রস্তুতিতে ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়। মাথা ও পা যত্নে পরিষ্কার করে লবণ, রসুন, পেঁয়াজ দিয়ে দীর্ঘক্ষণ সিদ্ধ করা হয়। ফলে গাঢ়, জেলির মতো ঝোল তৈরি হয়, যা জিহ্বায় স্বাদের জাদু ছড়ায়। কখনো ডিমের কুসুম বা ময়দা মিশিয়ে ঝোলকে আরও গাঢ় ও ঘন করা হয়। পরিবেশনের সময় এতে লেবুর রস, রসুনের সস এবং শুকনো মরিচের গুঁড়ো ছড়িয়ে দেওয়া হয়, যা এর স্বাদকে আরও মুখরোচক করে তোলে।
উত্তর ভারতের আওয়াধে শ্রমজীবী মানুষের জন্য নেহারির প্রচলন শুরু হয়। ফজরের নামাজের পর নেহারি খেলে শরীরে শক্তি আসতো, যা শ্রমিকদের সারাদিন নিরলস কাজে সহায়তা করতো। আশ্চর্যজনকভাবে, তুরস্কের শ্রমজীবীদের মধ্যে কেল্লা পাচাও খুব জনপ্রিয়। নেহারির মতোই এটি দীর্ঘ সময় জ্বাল দিয়ে রান্না করা হয় এবং ভোরে বা সকালের নাশতায় তুরস্কে কেল্লা পাচা অনেকের প্রিয় খাবার।
কোকোরেচ
তুরস্কের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের প্রাচীন শহর বুরসার সুবিস্তৃত পথে ঘুরতে ঘুরতে পরিচয় হয় কোকোরেচ নামক এক রহস্যময় খাবারের সঙ্গে। আমার তুর্কি বন্ধু সামেত আমাকে কোকোরেচের স্বাদ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ২০১৯ সালে, যখন ডোনার পাওয়া যেত পাঁচ-সাত লিরায়, তখন কোকোরেচের ছোট এক অংশের দাম ছিল পনেরো থেকে পঁচিশ লিরা। কোকোরেচ তুরস্কের সবচেয়ে মশলাদার খাবারগুলোর মধ্যে একটি। সামেতের কথা শুনতেই আমাদের সঙ্গী দুই প্রবাসী বাংলাদেশি— মেহেদি ভাই ও আশিক ভাইয়ের চোখে বিস্ময়, মুখে অস্বস্তি ফুটে উঠলো। মেহেদি ভাই বললেন, “মায়ের রান্নার গরুর মাংসের স্বাদ আমার হৃদয়ে, এখন পশুর ফেলে দেওয়া কোনও অংশ দিয়ে তৈরি খাবার খাবো?”
কোকোরেচ তৈরি হয় ভেড়া বা ছাগলের অন্ত্র বা ইন্টেস্টাইন দিয়ে। এ খাবার কিছুটা চর্বিযুক্ত। আমাদের দেশে পশু জবাইয়ের পর অন্ত্র বা নাড়ি প্রায়ই আবর্জনায় ফেলা হয়। এজন্য কোকোরেচ অনেকের কাছে ‘অরুচিকর’ মনে হতে পারে। এর তীক্ষ্ণ, কখনো অসহ্য গন্ধ কারো কারো মনে বিস্ময় বা বিতৃষ্ণা জাগায়। তবু এই গন্ধ ও স্বাদের মধ্যে লুকিয়ে আছে এক অজানা রসনার আকর্ষণ, যা সাহসীদের জন্য নতুন এক আবিষ্কার হতে পারে।
কোকোরেচ প্রস্তুতি যেন এক শিল্প। প্রথমে অন্ত্রগুলো যত্নসহকারে ধুয়ে পরিষ্কার করা হয়। এরপর থাইম, লাল মরিচ, লবণ মাখিয়ে গ্রিলে গেঁথে আগুনের উত্তাপে ঝলসানো হয়। আগুনের স্পর্শে যেন কোকোরেচের স্বাদ জেগে ওঠে। রান্নার পর ছোট ছোট টুকরো করে কেটে আগুনে পোড়ানো টমেটো, পেঁয়াজ, মরিচের মতো রঙিন সবজি, পার্সলি আর মশলার জাদুকরী মিশ্রণের সঙ্গে রুটিতে ভরে সুস্বাদু স্যান্ডউইচ তৈরি করা হয়।
তবে যারা ভিন্নতার সন্ধানে, তারা চাইলে স্যান্ডউইচের বদলে কোকোরেচকে একটি স্বতন্ত্র পদ হিসেবেও উপভোগ করতে পারেন। তুরস্কের ইজমির ও দেনিজলি শহর কোকোরেচের জন্য যেন এক স্বর্গরাজ্য, যেখানে এই খাবারের খ্যাতি দিগন্ত ছুঁয়েছে। আমাদের দেশের অনেকেই হয়তো কোকোরেচের প্রতি প্রথমে দ্বিধাগ্রস্ত হবেন, রুচিতে বাধা পেতে পারেন। কিন্তু একবার যদি সাহস করে এই খাবারের স্বাদ নিতে পারেন, তবে সে অভিজ্ঞতা মনের গভীরে দাগ কাটবে।
গুভেচ
গুভেচ তুর্কি রন্ধনশিল্পের এক অমূল্য রত্ন। আমার খাওয়া সেরা খাবারগুলোর মধ্যে এর স্থান অনন্য। কুরবানির ঈদে তুরস্ক আর তার পাশের দেশের গ্রামগুলোতে গুভেচ এক ঐতিহ্যের অংশ হয়ে ওঠে। গুভেচ যেন গ্রামীণ সৌন্দর্যের এক জীবন্ত চিত্র, যা আমাদের দেশের কুরবানির সময় মাটির হাঁড়িতে খড়ি বা লাকড়ির চুলায় রান্না হওয়া মাংসের সঙ্গে তুলনীয়। এককালে, যখন রেফ্রিজারেটরের প্রচলন ছিল না, তখন আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলে এভাবেই মাংস রান্না ও সংরক্ষণ করা হতো। কিন্তু আজকাল এমন দৃশ্য আর চোখে পড়ে না, যেন সময়ের স্রোতে হারিয়ে গেছে একটি কাব্যময় অধ্যায়।
গুভেচকে তুরস্কের নিজস্ব শৈলীতে রান্না হওয়া এক মাংসের স্টু বলা যায়। এটি প্রস্তুত করতে চাই পাথরের তৈরি বিশেষ পাত্র আর এক বিশেষায়িত চুলা, যা আমাদের দেশের পুরাতন দিনের বেকারিগুলোতে ব্যবহৃত চুলার সঙ্গে কিছুটা মিল আছে। গুভেচ রান্নায় সাধারণত গরু, খাসি বা ভেড়ার মাংস ব্যবহার করা হয়। স্বাদের জন্য লবণ, গোলমরিচ, থাইম আর কখনো কখনো শুকনো লাল মরিচ মেশানো হয়। মাংসকে কমপক্ষে ছয় ঘণ্টা ধরে আঁচে রাখা হয়। পাথরের পাত্রে দীর্ঘক্ষণ রান্নার ফলে সব উপাদানের স্বাদ একত্রে মিশে যায়।
ধীর আঁচে রান্না করার ফলে মাংস এতোটা নরম ও রসালো হয় যে মুখে দিলেই গলে যায়। মাংসের গায়ে থাকা চর্বি তেল হয়ে উপরে ভেসে ওঠে। সাধারণত নরম রুটি, ভাত কিংবা পিলাফের সাথে একে পরিবেশন করা হয়।
কুতাহিয়া শহরে একবার গুভেচ খাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। খাওয়ার পর তৃপ্তি নিয়ে শেফ মেহমেতকে বলেছিলাম, “এটা আমার জীবনের সেরা খাবারগুলোর একটা।” তিনি আবেগে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। তার সেই উষ্ণতা আর ভালোবাসা আমার মনে চিরকাল থাকবে।
তাভুক গোসু
তুরস্কে মুরগির বুকের মাংস দিয়ে পুডিংয়ের মতো এক অনন্য স্বাদের মিষ্টান্ন তৈরি হয়, যার নাম তাভুক গোসু। তবে এই স্বাদের সন্ধান তুরস্কের সর্বত্র মেলে না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে বুরসা শহরের এক ক্যাফেতে তাভুক গোসুর দেখা পেয়েছিলাম। তবে আমি এতে মাংসের স্বাদ খুঁজে পাইনি। বরং প্রতিটি কামড়ে মনে হচ্ছিল, যেন ঘন দুধে ডোবানো মালাইচপের স্বাদ নিচ্ছি।
মুরগির বুকের মাংসকে দীর্ঘ সময় জ্বাল দিয়ে এমন সূক্ষ্ম, মোলায়েম ও মিহি করে ফেলা হয় যে, তাতে আর আঁশের কোনো চিহ্ন থাকে না, মুখে নেওয়ার সাথে সাথে যেন তা মিলিয়ে যায়। পরিবেশনের সময় এর উপর দারুচিনির গুঁড়ো ছড়িয়ে দেওয়া হয়, যা স্বাদে এক উষ্ণতার স্পর্শ এনে দেয়। তাভুক গোসু কেবল কোন খাবার নয়, এক ঐতিহাসিক যাত্রা যা উসমানি সাম্রাজ্যের রাজকীয়তার স্মৃতি বয়ে আনে।
কাটমার
প্রথম দৃষ্টিতে কাটমারকে দেখে মনে হয় যেন মোগলাই পরোটা। কিন্তু মোগলাই পরোটার সেই মচমচে ভাব এতে নেই। স্বাদেও রয়েছে একটি স্বাতন্ত্র্য। কাটমার পরিচিত একটি সুস্বাদু পেস্ট্রি হিসেবে, যা তৈরি হয় পাতলা খামিরবিহীন ময়দার স্তর দিয়ে। বাকলাভা কিংবা কুনাফের ভিড়ে কাটমারের নাম অবশ্য সেভাবে উচ্চারিত হয় না। প্রথমে ময়দাকে পাতলা করে টেনে নেওয়া হয়, এরপর প্রতিটি স্তরে ঘি বা মাখনের প্রলেপ দেওয়া হয়। ভেতরে ভরা হয় পেস্তা, হ্যাজেলনাট কিংবা ক্লটেড ক্রিম— যাকে বলা হয় ‘কায়মাক’; উপরিভাগে ছড়িয়ে দেওয়া হয় চিনির মিষ্টি আবরণ।
তারপর ওভেনের উত্তাপে বেক করে নেওয়া হয় এই সৃষ্টিকে। গরম গরম পরিবেশনের সময় এর বাইরের ক্রিস্পি স্তর আর ভেতরের নরম, মিষ্টিময় অংশ এক অসাধারণ স্বাদের সমন্বয় তৈরি করে। পরিবেশনের মুহূর্তে অনেক সময় কাটমারের উপর ছড়িয়ে দেওয়া হয় পেস্তাবাদামের সবুজ গুঁড়ো, যেন এর সৌন্দর্য ও স্বাদে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। চায়ের সঙ্গে এর স্বাদ আনন্দের সাগরে ভাসায়।
ছয় মাস তুরস্কের মাটিতে কাটিয়েও দেশটির অনেক খাবারের স্বাদ নেওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তুর্কিদের আতিথেয়তা হৃদয়ে গেঁথে যায়। খাবার কেবল পেট ভরানোর জিনিস নয়। এটি একটি জাতির সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ইতিহাসের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। তুরস্কের রান্নাঘর যেন এক সুগন্ধী জাদুঘর—লুকিয়ে আছে নানা প্রদেশীয় পদ, শতাব্দীর ঐতিহ্য আর নিখুঁত ঘরোয়া রান্নার স্বাদ। এই অনালোচিত খাবারগুলোর ভেতরেই মেলে এক জাতিস্মরের খোঁজ— যেখানে ইতিহাস আর রুচি একই কড়াইয়ে ফোটে। ভ্রমণপিপাসুদের জন্য তাই তুরস্ক মানেই শুধু দর্শন নয়, রসনাভ্রমণও।