ব্রিটিশ শাসনামলে কৃষকদের ওপর নীলকর সাহেব ও জমিদারদের অত্যাচারের কাহিনি প্রকাশ করতো এ ছাপাখানা।
Published : 12 Aug 2024, 02:42 PM
পত্রিকার নাম ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’। এটিকে বলা হয় বাংলাদেশ ভূখণ্ডের প্রথম সংবাদপত্র। প্রকাশিত হতো কুষ্টিয়ার কুমারখালী থেকে, সম্পাদক কাঙাল হরিনাথ মজুমদার (১৮৩৩-১৮৯৬)। তিনি ‘কাঙাল হরিনাথ’ নামেই পরিচিত। তার ছাপাখানার নাম ‘এমএন প্রেস’। কাঙালের বন্ধু মথুরা নাথ নামের শব্দ দুটির প্রথম বর্ণ নিয়ে এ নাম রাখেন তিনি। এই ‘এমএন প্রেস’ এখন ইতিহাসের অংশ।
কুষ্টিয়ার একটি সমৃদ্ধ উপজেলা কুমারখালী। তাঁতশিল্পের জন্য বিখ্যাত। আছে রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি, শিলাইদহে। সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেনের বাস্তুভিটা, লালনের আখড়া। আছে কাঙাল হরিনাথের বাড়ি ও জাদুঘর। কুষ্টিয়া থেকে ১৩-১৪ কিলোমিটার দূরে কুমারখালী শহরের প্রায় কাছেই কুণ্ডুপাড়ায়।
রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে একসময় অবহেলায় পড়ে ছিল সাংবাদিক কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের স্মৃতিগুলো। অবশেষে সরকারি উদ্যোগে জাদুঘর, অডিটরিয়াম ও পাঠাগার নির্মাণ করা হয়। গত বছর হরিনাথের ছাপাখানা জাদুঘরে স্থানান্তর করে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
বাংলা সংবাদপত্রের ইতিহাস লিখতে গেলে কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের নাম সবার আগে চলে আসে। লালনের সঙ্গে সখ্য ছিল কাঙাল হরিনাথের। তাকে বাংলাদেশের সংবাদপত্র প্রকাশ ও সাংবাদিকতার অগ্রদূত বলা হয়। ১৮৬৩ সালের এপ্রিল মাসে ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ নামে পত্রিকা প্রকাশ করেন। এ পত্রিকার মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লিখতেন তিনি। ওই সময়ে তার ব্যবহৃত প্রেসটিই ‘এমএন প্রেস’।
ঐতিহাসিক ‘এমএন প্রেসের’ কিছু যন্ত্রাংশ, অক্ষর, ছবি ও কিছু পাণ্ডুলিপিসহ বেশকিছু কালের সাক্ষী সংরক্ষণ করা আছে। ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ প্রথম নয় বছর ছাপা হতো কলকাতা থেকে। পরে এটি কুষ্টিয়া মথুরানাথ প্রেস (এমএন প্রেস) থেকে মুদ্রিত হয়।
পত্রিকাটি প্রায় ২২ বছর টিকে ছিল। প্রথমে এটি ছিল মাসিক, ১৮৬৪ সালে পাক্ষিক এবং ১৮৭১ সালে সাপ্তাহিকে পরিণত হয়। ১৮৮৪ সাল নাগাদ পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। যখন পত্রিকাটি মাসিক ছিল তখন এর দাম ছিল পাঁচ আনা। মূলত গ্রাম ও গ্রামবাসীদের অবস্থা প্রকাশের জন্য এর নাম রাখা হয় ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’।
তবে মূল লক্ষ্য ছিল কৃষকদের ওপর নীলকর সাহেব ও জমিদারদের অত্যাচারের কাহিনি প্রকাশ করা। তবে এই পত্রিকায় দর্শন, সাহিত্য ও অন্য সংবাদ প্রকাশিত হতো। লালন ফকিরের গানও প্রকাশ করেছিল এই পত্রিকা। প্রখ্যাত লেখক মীর মোশাররফ হোসেন ও জলধর সেন তাদের লেখক জীবনের সূত্রপাত করেছিলেন গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকায়। তাছাড়া শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণব, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ও প্রসন্নকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ ব্যক্তি এই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে জানা যায়।
মানবিক মূল্যবোধের চর্চার কারণেই হরিনাথ উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের শেষ পর্যায়ে বাংলাদেশের হিন্দু ও মুসলিম গোঁড়ামির নিন্দা করেছেন। হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক বিদ্বেষ স্বাভাবিকভাবেই তাকে বিচলিত করেছিলো। তিনি লিখেছেন, ‘জাতির নামে ধুয়া তুলে/ (দিচ্ছ) খড়ো ঘরে আগুন জ্বেলে/ এ জাত যে জাত মারবার কল/ নদীর জল করছি পান/ একই জমির খাচ্ছি ধান/ একই ভাষায় গাইছি গান/ ভাইয়ের বুকে ছুরি মারে/ (তারা) শয়তানের দল’।
ভাব ও ভাবনার সমন্বয় করেই তিনি যেন তার গানের ভাণ্ডার সাজিয়েছেন। যেমন এরকম একটি গান, ‘ওহে দিন তো গেলো সন্ধ্যা হলো/ পার কর আমারে তুমি পারের কর্তা শুনে বার্তা/ ডাকছি হে তোমারে।’ হরিনাথের গানেও সুর ধ্বনিত, ‘ভোলা মন, কী করিতে কী করিলি, সুধা বলে গরল খেলি।/ সংসারে সোনার খনি পরশমণি, রতনমণি না চিনিলি...।’ হরিনাথের এসব গান ও দর্শন তার পত্রিকা ও প্রেসকে ঘিরেই চালু ছিল।
তার পঞ্চম পুরুষ অশোক মজুমদারের স্ত্রী গীতা মজুমদার ও তার দুই ছেলের একজন দেবাশিষ মজুমদারের সঙ্গে কথা হয়েছিল আমার। দেবাশিষ জাদুঘরে অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করেন। তখন কাঙালের বাস্তুভিটার ঘরের এক কোণে অবহেলায় পড়ে ছিল ঐতিহাসিক এমএন প্রেস। এ প্রেসের কাহিনি বলতে গিয়ে গীতা মজুমদার জানান, প্রেসটি এখনও অচল হয়নি। ১৯৯৪ সালে সর্বশেষ এই যন্ত্রে কিছু ছাপা হয়েছিল। তারপর আর কোনোকিছু ছাপা হয়নি।
প্রেসটি কীভাবে চালানো হতো, তাও দেখালেন গীতা মজুমদার ও তার ছেলে-নাতিন। এটি যুক্তরাজ্য থেকে আসার পথে প্রথমে ছিনতাই হয়ে গিয়েছিল বলে জানান গীতা। ১৮৬৩ সালে ৬০০ টাকায় নিলামের মাধ্যমে প্রেসটি কেনা হয় বলে জানান তিনি।
কাঙালের স্মরণে বাস্তুভিটার আধা কিলোমিটার দূরে সরকার স্থাপন করেছে জাদুঘর। সেখানেই স্থান পেয়েছে ঐতিহাসিক এ ছাপাখানা। জাদুঘরে তার বিভিন্ন জিনিস, প্রেসের যন্ত্রপাতি-কালি সংরক্ষিত রয়েছে। রয়েছে পাঠাগার ও সম্মেলন কক্ষ। কাঙাল হরিনাথকে নিয়ে লেখা বিভিন্ন বই এখান থেকে কিনে নেওয়া যায়। জায়গাটি ছোট্ট, কিন্তু পরিবেশ মনোরম।