হুমায়ূন আহমেদ ও এক কাপ চা

জ্যোৎস্নাপুত্র হুমায়ূন স্যারের দেখা পাওয়াটা তো কম কথা নয়। হোক না স্বপ্নে, স্মৃতিটা তো মধুর হয়েই থাকবে!

>> সোহরাব শান্তবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 July 2013, 08:58 AM
Updated : 3 August 2013, 02:12 PM

জ্যোৎস্নাপুত্র হুমায়ূন স্যারের দেখা পাওয়াটা তো কম কথা নয়। হোক না স্বপ্নে, স্মৃতিটা তো মধুর হয়েই থাকবে!

স্যারের সঙ্গে সময়টা ভালোই কাটছে। তিনি হিমু, মিসির আলীর স্রষ্টা, হুমায়ূন আহমেদ। আমাদের হুমায়ূন স্যার। কয়েকদিন হল আমরা ষোলজন ছেলে স্কাউট ক্যাম্পে আছি। অবশ্য স্যার এখানে গোপনে এসেছেন। তিনি যে জাতীয় পর্যায়ের একজন স্কাউটার, এ বিষয়টি অনেকেরই জানা নেই! বাংলাদেশ স্কাউটের ডেপুটি কমিশনার তিনি।

আমাদের ক্যাম্পিং হচ্ছে খুব সুন্দর পরিবেশে, স্কাউট কমপ্লেক্সে। স্কাউট কমপ্লেক্সটা দেখার মতো। বেশ গোছানো। চালু হয়েছে বেশিদিন হয়নি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটা হাওরের মাঝখানে, দ্বীপের মতো একটা জায়গা। পাশাপাশি দুটো কমপ্লেক্স। প্রথমটা স্কাউট কমপ্লেক্স, দ্বিতীয়টি সার্ক কমপ্লেক্স।

বর্ষাকাল। চারদিকে পানি থৈ থৈ করছে। আমাদের দেশের বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টায় পানির রংটাও বদলে গেছে! একেবারে নীল পানি। জায়গাটাকে হঠাৎ দেখলে ক্যারিবীয় দ্বীপের মতো লাগে।

স্যার খুবই মজার মানুষ। এটা সবাই জানেন। কথা কম বলেন। কিন্তু যা বলেন, রং-রস মাখিয়ে বলেন! প্রতিদিনের নির্দিষ্ট সেশন শেষে আমরা কমপ্লেক্সের বিশাল খোলা মাঠে ভলিবল, ক্রিকেট খেলি। ফুল বাগানে ঘুরে ঘুরে মনের আনন্দে ছবি তুলি।

মজায় দিন কাটলেও একটা বড় দুঃখ কিন্তু আছেই আমাদের। এখানকার পানিতে নামা নিষেধ। এমনকি নৌকায় চড়া পর্যন্ত! অবশ্য নিষেধাজ্ঞার কারণও আছে। পানি নীল করতে এক ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়েছে। এই রাসায়নিকের প্রভাবে মানুষের চামড়ার খুব ক্ষতি হয়। তাই আগামী চার বছর এই পানিতে নামা নিষেধ। স্কাউট ভবনের পাশের সার্ক ভবনে যাওয়ার ব্যাপারেও আছে কঠিন নিষেধাজ্ঞা। ঢাকার বাইরে এমন আধুনিক কমপ্লেক্স করার জন্য হুমায়ূন স্যার আমাদের সামনে প্রায়ই সরকারের প্রশংসা করেন।

আজকের সেশন প্রায় শেষ পর্যায়ে। সন্ধ্যা হয় হয়। হুমায়ূন স্যার হঠাৎ বলে উঠলেন, “স্যারের গন্ধ পাওয়া যায়!”

আমরা একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করি, এটা আবার কেমন কথা? হুমায়ূন স্যার উত্তেজিত, “একজন গিয়ে স্যারকে তাড়াতাড়ি খুঁজে বের কর। তাঁর হাতের চা না খেলে আমাকে হয়তো এই নীল পানিতে ডুবে মরতে হবে।”

আমরা হা হয়ে তাকিয়ে আছি। কী করব, কিছুই বুঝতে পারছি না। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “যাও, স্যারের হাতের চা নিয়ে আস। তাড়াতাড়ি আসবে।”

আমি সেই অদৃশ্য স্যারের খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম। বুঝতে পারছি না হুমায়ূন স্যার কাকে স্যার সম্বোধন করেছেন। কোথায় পাব তাঁকে? আমরা ষোলজন, হুমায়ূন স্যার, বাবুর্চি, সুইপার আর দুজন দারোয়ান ছাড়া এখানে কেউ নেই। কিন্তু ‘স্যার’? তাও আবার হুমায়ূন আহমেদ স্যার নিজেই যাকে স্যার ডাকছেন! এমন কাউকে তো এতদিন চেখে পড়েনি! উপায় না দেখে ছুটলাম সার্ক কমপ্লেক্সের দিকে। অনেক কষ্টে দেয়াল টপকে ঢুকতে হল। টাইপরা এক দাঁরোয়ান পথ আটকে দাঁড়াল-- “এখানে কী চাই?”

প্রশ্ন শুনে বোকার মতো বলে দিলাম, “হুমায়ূন স্যারের জন্য স্যারের হাতের চা নিতে ...।”

কথা ভালোভাবে শেষ করতে না দিয়ে দারোয়ান আমাকে একটা অন্ধকার ঘরে টেনে নিয়ে গেল।

একলা বসে আছি অনেকক্ষণ হল। কোথাও কোনো শব্দ নেই। হঠাৎ মাথার উপর একটা শব্দ পেয়ে কান খাড়া হয়ে গেল আমার। পরিষ্কার চা বানানোর শব্দ! কাপ-পিরিচ আর চামচের টুংটাং শব্দ, বুঝতে ভুল হবে কেন!

“স্যার, হুমায়ূন স্যারের জন্য এক কাপ চা হবে?” শুকনো গলায় অন্ধকারে কথাটা ছুঁড়ে দিয়ে চুপ হয়ে গেলাম।

কাকে স্যার ডাকলাম আমি? ভূত-টুত নয়তো! বাতি জ্বলে উঠল তখনই। লোকটাকে তো চিনি বলেই মনে হচ্ছে। গতকালও কয়েকটা জাতীয় পত্রিকায় ছবি ছাপা হয়েছে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার না তিনি! ঘরের কোনার দিকে বসা একজনকে তো সৈয়দ শামসুল হক বলেই মনে হচ্ছে! অদূরে আরও কয়েকজন আড্ডায় মগ্ন। সবাইকে চেনা যাচ্ছে না। কবি-সাহিত্যিকদের কেউ হবে নিশ্চয়ই।

সবকিছু পরিষ্কার হচ্ছে এখন আমার কাছে। ঢাকা ছেড়ে সবাই এখানে এসেছে তাহলে? আর পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতায় খবর বেরুচ্ছে-- ‘দেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিকরা উধাও।’ টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিকরা ক্যামেরাসহ হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে তাঁদের!

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার ডাকতেই কাছে গেলাম। আমার হাতে দুটো চায়ের কাপ ধরিয়ে দিলেন তিনি।

আমি বললাম, “হুমায়ূন স্যারের জন্য এক কাপ হলেই চলবে স্যার।”

তিনি হেসে বললেন, “এক কাপ তোমার জন্য!”

দুকাপ চা হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। দেয়াল টপকাতে গিয়ে পড়লাম বিপদে। মালি কুঁজো হয়ে পাতাবাহারের পাতা কেটে সাইজ করছিল। উপায় না দেখে তার পিঠকেই সিড়ি বানাতে বাধ্য হলাম! লাফ দিয়ে পেরিয়ে এলাম দেয়াল। অথচ বেচারা কিছুই বুঝতে পারল না!

এদিকে স্যারের অবস্থা খারাপ। আমার আসতে দেরি হওয়ায় হয়তো এ অবস্থা। ক্যাম্পের ছেলেরা হুমায়ূন স্যারকে ঘিরে আছে। স্যারের গায়ের রং নীল হয়ে আসছে। তবে কি স্যার এই নীল পানিতে মিশে যাবেন? ভয়ে আমাদের আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড়। কাঁপা কাঁপা হাতে চায়ের কাপটা এগিয়ে দিলাম তাঁর কাছে। আশ্চর্য, এক চুমুক দিতেই স্বাভাবিক হতে লাগল তাঁর শরীর। এখানে যা ঘটছে, তা কেবল বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিতেই মানায়। স্যার সুস্থ হয়ে উঠতেই আমরা হৈ-হুল্লোড় শুরু করে দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশটা মেঘে ঢেকে গেল। বৃষ্টিও শুরু হয়ে গেল। সেশনরুমে ঢুকতে ঢুকতেই ভিজে একসা।

বিকেলে আকাশ পরিষ্কার হয়ে এল। দূরে একটা পালতোলা নৌকা দেখে আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। এই ডিজিটাল যুগেও পালের নৌকা, দেখতে মন্দ না। পনের মিনিটের মধ্যেই নৌকাটা স্কাউট কমপ্লেক্সের ঘাটে এসে ভিড়ল। নৌকা থেকে নেমে এলেন জাদুকর জুয়েল আইচ। সঙ্গে দুই কিশোর। এদের ঘন-কালো গোঁফ দেখে না হেসে পারলাম না কেউ। রহস্যের জট খুলল তখনই। জুয়েল আইচ তাঁর জাদু দিয়ে অভিনেতা আবুল হায়াৎ ও হুমায়ূন ফরিদীর এ অবস্থা করেছেন!

রাতের খাবারের পর শুরু হল মজার এক আড্ডা। এতে যোগ দিলেন সার্ক ভবনের সেই বিখ্যাতরাও। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার আড্ডার আনুষ্ঠানিক সভাপতি। রসালো আলাপের জন্য হুমায়ূন আহমেদ স্যারই হয়ে উঠলেন আড্ডার মধ্যমণি।

আকাশে একটা অদ্ভুত শব্দ শুরু হওয়ায় আড্ডায় ছেদ পড়ল। আমাদের চোখের সামনে ভোঁ-ভোঁ শব্দে নেমে এল তিনটা অদ্ভুত প্রাণী। এঁরা এসেছে মঙ্গলগ্রহ থেকে। আমার ধারণা এঁদের সঙ্গে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সভা করতেই এখানে এসেছেন কবি-সাহিত্যিকরা। কিন্তু কেন এই সভা বুঝতে পারছি না।

সভায় বেশিক্ষণ থাকা হল না আমার। হুমায়ূন স্যার ইশারা করলেন বেরিয়ে যেতে। আমি তাই করলাম। হুমায়ূন স্যার নিজেও পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলেন। সঙ্গে জুয়েল আইচ। আকাশে তখন গোল ফকফকা চাঁদ। হুমায়ূন স্যার বললেন, “কী সুন্দর চান্নিপসর রাত। এমন জ্যোৎস্না কতদিন দেখা হয় না!”

আমাদের নিয়ে নৌকায় চড়ে বসলেন তিনি। একসময় একটা লোকগানের সুর তুললেন। তবে মুখ দিয়ে নয়, নাক দিয়ে। করুণ সেই সুর। আমরা অনেকক্ষণ নৌকায়। রাত গভীর হয়ে এল। জ্যোৎস্নার আলো কমে আসছে। আকাশের হালকা মেঘ এতক্ষণ চেখে পড়েনি আমাদের। ঝমঝমিয়ে যখন বৃষ্টি পড়ছে, হুমায়ূন স্যারের চোখে তখন পানি!

“ওহ-হো..। আরেকটু হলে তো ভিজে গোসলই করে ফেলতাম। ঘুমানোর আগে জানালাটা বন্ধ করতে ভুলে যাওয়ার অভ্যেসটা বদলাতেই পারছি না। এই একটা কারণেই মা আমাকে মাঝে মাঝে গাধার সঙ্গে তুলনা করেন! এমন বদঅভ্যাস থাকা খারাপ না।”

বদঅভ্যাস হোক আর যাই হোক, জ্যোৎস্নাপুত্র হুমায়ূন স্যারের দেখা পাওয়াটা তো কম কথা নয়। হোক না স্বপ্নে, স্মৃতিটা তো মধুর হয়েই থাকবে!

বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকম/শান্ত/এনজে/সাগর/আরএস/জুলাই ২০/১৩