আজ এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়েছে। কিন্তু অবনিতা ফোনের সুইচ অফ করে রেখেছে।
Published : 22 Aug 2023, 05:17 PM
পাঁচতলা ছাদের কার্নিশে এসে দাঁড়িয়ে আছে অবনিতা। ছাদ থেকে রাস্তায় চলাচল করা মানুষগুলো দেখে মনে হচ্ছে ছোট ছোট পিঁপড়া যেন ধীর পায়ে হেঁটে চলেছে। অতিকায় গাড়িগুলোকে খুবই নগণ্য কিছু মনে হচ্ছে।
অন্যসময় হলে পাঁচতলা থেকে নিচের দিকে তাকালে ভয়ে অবনিতার বুক ধুকপুক করে কেঁপে উঠত। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যেত। কিন্তু আজ তার ভয়ের অনুভূতি লোপ পেয়ে গহীন অরণ্যে পাড়ি জমিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। মৃত্যুর ভয়কে সে আজ কোনোভাবে পরোয়া করছে না।
অবনিতা স্থির দাঁড়িয়ে আছে ছাদের কার্নিশে। সামনে কয়েকটি হলুদ পাখনাওয়ালা প্রজাপতি মনের সুখে নির্ভয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। প্রজাপতিদের ছাদ থেকে পড়ে যাওয়ার কোনো ভয় নেই।
আজ এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়েছে। অবনিতার বন্ধুরা সবাই স্কুলে একসাথে জড়ো হয়েছে। অনেকে খুশিতে আত্মহারা হয়ে ঢোল বাজাচ্ছে। বেশ কয়েকজন বান্ধবী অবনিতাকে ফোন দিয়েছিল। কিন্তু কেউ তার সাথে কথা বলতে পারেনি। কারণ অবনিতা ফোনের সুইচ অফ করে রেখেছে।
তার সবচেয়ে কাছের বান্ধবীরা সবাই জিপিএ ফাইভ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। একমাত্র অবনিতা রেজাল্ট ভালো করতে পারেনি। মানে সে এক বিষয়ে অকৃতকার্য হয়েছে। তাই অবনিতা আজ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যাবে! বিগত একবছর ধরে কি পরিশ্রমই না তাকে করতে হলো। রোজ সকালে ঘুমোঘুমো চোখে স্কুলে ছোটা। স্কুল শেষ করে কোচিংয়ে যাওয়া। আবার কোচিং শেষ করে বাসার স্যারের কাছে পড়তে বসা।
ছোট্ট শরীরটার ওপর কতটা ধকল গেছে তা শুধু অবনিতা জানে। আর জানে তার মা। মেয়েকে নিয়ে অনেক ইচ্ছে ছিল অবনিতার মা-বাবার। মেয়ে এসএসসিতে জিপিএ ফাইভ পেলে কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিল বাবা। মা নতুন একটি মোবাইল উপহার হিসেবে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু হায়, কাজের কাজ কিছুই হলো না।
সেদিন সবাই অধীর আগ্রহ নিয়ে বসেছিল অবনিতার রেজাল্ট দেখার জন্য। অনেকে নিশ্চিত ধরে নিয়েছিল সে জিপিএ ফাইভ পাবে। কিন্তু তার রেজাল্ট দেখে সবাই হতাশ হলো। পদার্থবিজ্ঞানে খারাপ করেছে অবনিতা। আর তা শোনার সাথে সাথে পাশের বাসার আন্টিরা অপদার্থ সব কথাবার্তা ছুড়ে দিচ্ছে তার মায়ের দিকে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো কখনও জিপিএ ফাইভ পাননি, কই তাকে তো এতো কথা শুনতে হয়নি! কিংবা জিপিএ ফাইভ না পেয়েও তো তিনি তার মেধার বিকাশ করতে পেরেছেন।
মা-বাবার মমতামাখা মুখের ছবি ভেসে উঠতেই অবনিতার দুই চোখ আর্দ্র হয়ে উঠল। তার এলোমেলো চুলগুলো নির্ভাবনায় উড়ছে। কার্নিশে শ্যাওলা জমেছে। ছাদে রাখা টবে বেশকিছু লাল টুকটুকে সন্ধ্যামালতী ফুটেছে।
আজ বাবার অশ্রুসিক্ত চোখ, মায়ের বিষন্ন মুখ সবকিছু যেন অবনিতার কাছে আজব মনে হলো। মাত্র মিনিট দুয়েকের মধ্যে কাছের মানুষগুলোর এভাবে বদলে যাওয়া সে মেনে নিতে পারেনি। বেঁচে থাকলে মানুষের এসব কটু কথা আরও শুনতে হবে। তাই ভেবে অবনিতা আত্মহত্যা করার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দেখতে দেখতে বিকেল ঘনিয়ে সন্ধ্যা হলো। খাবারের সন্ধানে অবিরাম ছুটে চলা বুনো বকগুলো আজকের মতো বিরতি নিয়ে ফিরে যাচ্ছে নিজ বাসায়। হয়তো প্রতিদিন এভাবে বুনো বক বাসায় ফিরবে। বিকেল হলে প্রজাপতিরা সব উড়বে।
কিন্তু অবনিতা হয়তো আর শুনতে পাবে না বাবার স্নেহমাখা ‘মা’ ডাক। মায়ের স্নিগ্ধ শাসন। বান্ধবীদের সাথে করা খুনসুটিগুলো নিমিষে তার দুই চোখে ভেসে উঠল। মা-বাবার মমতামাখা মুখের ছবি ভেসে উঠতেই অবনিতার দুই চোখ আর্দ্র হয়ে উঠল। তার এলোমেলো চুলগুলো নির্ভাবনায় উড়ছে। কার্নিশে শ্যাওলা জমেছে। ছাদে রাখা টবে বেশকিছু লাল টুকটুকে সন্ধ্যামালতী ফুটেছে।
এক পা, দুই পা করে অবনিতা ছাদ থেকে লাফ দেওয়ার জন্য ছাদের আরও কাছে এগিয়ে গেল। দুই চোখ বন্ধ করে ফেলল! শেষ নিশ্বাসটুকুও ছেড়ে দিল। এক, দুই, তিন। সব শেষ! অ্যাই, অবনি, অবনি উঠ। বেলা কয়টা বাজে খেয়াল আছে তোর! ঘুম থেকে উঠ। আজ না তোর রেজাল্ট বের হবে! কেমন মোষের মতো বেঘোরে ঘুমোচ্ছে দেখ মেয়ে!- মায়ের এমন ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে গেল অবনিতার। দুই চোখ খুলে দেখল, সে খাটে আরাম করে ঘুমাচ্ছে। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে। পাশে থাকা ছোট্ট ঘড়িটি টিকটিক করে চলছে।
ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে অবনিতা দেখল আজ তার এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবে। অবনিতার বুঝতে বাকি রইল না সে এতক্ষণ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কি দুঃস্বপ্নটাই না দেখেছে। তার গা দিয়ে পিনপিন করে ঘাম বের হচ্ছে।
এক লাফে খাট থেকে নেমে এলো অবনিতা, শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরল। তারপর আলতো করে কপালে এঁকে দিল স্নিগ্ধ চুমু। বেলা দশটার সময় অবনিতার রেজাল্ট বের হয়েছে। সে জিপিএ ফাইভ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে।