গল্প
কলেজ মাঠে সার্কাস তাঁবুর কাছে পৌঁছে তারা দেখলো, আরো অনেক স্কুলের ছেলেমেয়েরা এসেছে। আজকের এই শো শুধু স্কুলের ছেলেমেয়েদের জন্য।
Published : 28 Jun 2024, 11:01 AM
অ্যাসেম্বলির জাতীয় সঙ্গীত শেষ হলে গেমস স্যার বললেন, “ছেলেমেয়েরা! হেডস্যার এখন তোমাদের উদ্দেশে কিছু কথা বলবেন। তোমরা কেউ হৈচৈ করো না। মনোযোগ দিয়ে শোনো।”
অত্যন্ত ভালো মানুষ হেডস্যারকে সব ছাত্রছাত্রী খুবই পছন্দ করে। সবাই যদিও সবসময় হেডস্যারের কথা মনোযোগ দিয়েই শোনে, তারপরও গেমস স্যারের কথায় সবাই আরো সোজা হয়ে দাঁড়ালো। পুরো মাঠজুড়ে পিনপতন নীরবতা।
“আমার প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীরা.... ”, হেডস্যার কথা শুরু করলেন।
“তোমরা সবাই জানো নিশ্চয়, খলিশাকুন্ডিতে সার্কাস পার্টি এসেছে। তা কে কে দেখেছো? হাত তোলোতো দেখি।”
হেডস্যার দেখার জন্য থামলেন। সবার মাঝে একটা নীরব চাঞ্চল্য বয়ে গেলো। কিন্তু কেউ হাত উঠালো না। একটা কৌতুকপূর্ণ হাসি স্যারের চোখে মুখে ক্ষণিকের জন্য খেলে গেলো।
“কেউ দেখেনি?”
আবার কথা বলতে শুরু করলেন হেডস্যার, “কিন্তু আমি যতটুকু জানি, এ ব্যাপারে তোমাদের খুব আগ্রহ। আজই তো দেখলাম, মোহাম্মদপুরে হাতি এসেছে এবং তোমাদের অনেকেই দেখছে। কয়েকজন ছেলেতো অ্যাসেম্বলিতেও দেরি করে উপস্থিত হয়েছে।”
সবাই চকিতে একবার ছোটনদের তিনজনের দিকে তাকালো। ওদের তিনজন অবশ্য ভয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে। হেডস্যারও একবার ওদের দিকে তাকিয়ে কথা বলা বলতে লাগলেন, “না, তার জন্য আমি ছেলেদের দোষ দিচ্ছি না। এটা তো কৌতূহলেরই বয়স। স্কুলে আসার সময় আমিও মোহাম্মদপুর বাজারে থেমেছিলাম হাতি দেখার জন্য।”
কথাটা বলার সময় স্যার এমন মুখভঙ্গি করলেন যে সব ছেলেমেয়ে এমনকি অন্য স্যারেরা পর্যন্ত হেসে উঠলেন। ছোটনদের ভয় কেটে গেলো এই হাসিতে। সবার হাসি থামলে আবার বলা শুরু করলেন তিনি। আমি আসলে একটা ঘোষণা দেবো। তা হলো.... লম্বা করে টেনে বললেন, “আমরা... আজ...সবাই.. মিলে... সার্কাস দেখতে যাবো!”
পুরো ব্যাপারটা বুঝতে সবার এক সেকেন্ড সময় লাগে। তারপর সবাই একসাথে চিৎকার করে ওঠে।
গেমস স্যার হাসিমুখে ধমক দিয়ে চিৎকার থামালেন। পরে হেডস্যার যা বললেন তাতে বোঝা গেলো, সার্কাস দল আজ দুপুর বারোটার শো দেখার জন্য স্কুলের সব ছাত্র-ছাত্রীসহ স্যারদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। স্যাররাও সম্মতি জানিয়ে দিয়েছেন। তাদের একটাই শর্ত, সবাইকে স্কুল ড্রেস পরে যেতে হবে।
বড় রাস্তা ধরে গেলে অনেক ঘুরে যেতে হয়। ভ্যানগাড়িতে জনপ্রতি দশ টাকা করে ভাড়া দিয়ে সবার যাওয়াও ব্যয়সাপেক্ষ। একজনকেও বাদ দিয়ে স্যার যাবেন না। শর্টকাট একটা রাস্তা হলো- মাঠের ভেতর দিয়ে সহজেই খলিশাকুন্ডি যাওয়া যায়। তাই সিদ্ধান্ত হলো, মাঠ দিয়ে যাওয়া হবে। এখন যেহেতু মাঠে ফসল, তাই লাইন ধরে আইল দিয়ে হেঁটে যাবে সবাই।
বারোটার শো। দশটা বাজে এখন। তাই শুধু উপস্থিতি গণনা করেই বেরিয়ে পড়তে হবে। এর ঠিক বিশ মিনিটের মাথায় দেখা গেলো স্কুলের সব ছাত্রছাত্রীসহ স্যারেরা সোনালি রোদ গায়ে মেখে সোজা লাইন ধরে আইল বেয়ে হেঁটে চলেছে। মাঠে কাজ করতে থাকা কৃষকেরা আগ্রহ নিয়ে কোথায় যাচ্ছে জানতে চাইলে হেডস্যার হাসি মুখে বলছেন, “যাই, ছেলে-মেয়েদের সার্কাস দেখিয়ে নিয়ে আসি।”
কলেজ মাঠে সার্কাস তাঁবুর কাছে পৌঁছে তারা দেখলো, আরো অনেক স্কুলের ছেলেমেয়েরা এসেছে। আজকের এই শো শুধু স্কুলের ছেলেমেয়েদের জন্য।
ভেতরে ঢুকে সবাই অবাক। কী সুন্দর সবকিছু! স্যার ও ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আলাদা বসার জায়গা। ছোটন উঁচুতে উঠে একটা জায়গা পছন্দ করে বসলো। এখান থেকে সবকিছু ভালোভাবে দেখা যাবে। তার পাশে বসল রিন্টু ও সজল।
জাতীয় সঙ্গীত শুরু হলে সবাই উঠে দাঁড়িয়ে গলা মিলালো। তারপর লম্বা একজন, কালো ড্রেস পরে ঢুকলো দুই কাঁধে দুটো টিয়া পাখি নিয়ে। পাখি দুটো পুরো এলাকাজুড়ে চক্কর দিয়ে আবার কাঁধে বসলো। একটা টিয়া বললো, “দেখেছো আজ কত পোলাপান!”
অমনি আরেকটা টিয়া বললো, “এই ‘পোলাপান’ কি কথা? এরা সবাই স্কুলে পড়ে। তুই কোনোদিন স্কুলে পড়েছিস? যা মাফ চেয়ে নে। সরি বল। শিক্ষিতদের কাছে সরি বলে মাফ চাইতে হয়।”
টিয়া পাখিটা দুই ডানা একত্রে করে এমনভাবে ‘সরি’ বলে মাফ চাইলো যে, সবাই হেসে হাততালি দিয়ে উঠলো। ছোটনের তো তালি থামেই না। তারপর একের পর এক খেলা। ঘোড়ার সাথে কথোপকথন, ছাগলের নাচ, বাঁদরের বাঁদরামি যা দেখায় তাতেই সবাই খুশিতে লাফিয়ে ওঠে। তবে তারের উপর দুটো মেয়ের সাইকেল চালানোর সময় সবাই অনেক হাততালি দিচ্ছিল, কিন্তু ছোটন ভালো করে দেখতেই পারলো না। ভয়ে সারাক্ষণ চোখ বন্ধ করে ছিল। ইশ! যদি পড়ে যায়!
ছোটনের অবস্থা দেখেতো পাশে বসা রিন্টু ও সজল হেসে বাঁচে না। ছুরি ছুড়ে মানুষ আটকানো বোর্ড বিদ্ধ করা, হাত দিয়ে ঘুসি মেরে টিউবলাইট ভেঙে ফেলা এরকম দু’একটা বিপজ্জনক খেলা বাদে, হাতির বলখেলা, সজারুর নৃত্য ও নানা রকম খেলার সময় কারো তালি থামেই না। কখন যে তিন ঘণ্টা শেষ হলো বোঝাই গেলো না। আবার সেই লাইন ধরে আইল বেয়ে ফেরা। এবার সবাই যেন পাখায় ভর করে উড়ে উড়ে ফিরছে। অদ্ভুত এক ভালো লাগার ঘোর সবার চোখে মুখে।
সেদিন বাড়িতে ফিরে ছোটনের গল্প আর থামে না। একটু পর পর, “আব্বা শোনেন” বলে শুরু করছে একেকটা খেলার বর্ণনা। ছোট ভাই লাবুও ভাইয়ের কাছে আগ্রহ নিয়ে সার্কাসের গল্প শুনছে। রাতে পাটি পেতে মা খেতে দিয়েছেন। খেতে খেতে নানা গল্প। অধিকাংশ গল্পই অবশ্য আজকে ছোটনের সার্কাস দেখা নিয়ে।
মা ছোটনের প্লেটে ভাত দিতে দিতে বললেন, “সার্কাস দলের এই স্কুলের ছেলেমেয়েদের ফ্রি দেখানোটা আমার খুব ভালো লেগেছে। কি খুশি সবাই!” বাবাও সমর্থন করে মাথা নাড়লেন। তখন ছোটন বললো, “আমি বড় হয়ে একটা সার্কাস দল দেবো। আর প্রতি সপ্তাহে একদিন স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ফ্রি করে দেবো। খুব ভালো হবে তাহলে, তাই না আব্বা!”
মা হেসে ছোটনের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন, “আমার পাগল ছেলে কী বলে দেখো!” বাবা কিছু বললেন না, শুধু অদ্ভুত এক মায়াবী চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
ত্রিশ বছর পর। ছোটনের হাতে একটা রুলটানা মোটা খাতা। এতে তার আব্বা দোকানের হিসাব লিখতেন। আব্বা মারা গেছেন বছর দুই হলো। মায়ের কাছ থেকে কিছুদিন আগে এই খাতাটা সে পেয়েছে। নিছক কৌতূহলে পাতা উল্টাতে উল্টাতে এক জায়গায় চোখ আটকে গেলো।
সেখানে লেখা, “আজ ৯ মার্চ, ১৯৯৫ সাল। আমার বড় ছেলেটার শখ, সার্কাস দল তৈরি করে স্কুলের ছেলেমেয়েদের ফ্রি সার্কাস দেখাবে। আমি খুব গরিব। ছেলেদের কোনো ইচ্ছা আমি পূরণ করতে পারি না। আমার ক্ষমতা সীমিত। কিন্তু অপার ক্ষমতার অধিকারী একজন আছেন আমাদের মাথার উপর। সেই রাব্বুল আলামিনের কাছে আমার প্রার্থনা, তুমি আমার ছেলেটার মনের আশা পূরণ করো। আমিন।”
রাব্বুল আলামিন ছোটনের আব্বার প্রার্থনা শুনেছেন। ছোটন এখন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের অধ্যাপক। একটা সার্কাস দল তিন বন্ধু মিলে চালায়। গণিতের শিক্ষক হয়ে ছোটনের সার্কাস দলের মালিক বনে যাওয়ার কাহিনিটা বেশ মজার। অন্য কোন একদিন আমরা সে কাহিনি শুনবো। এখনকার গণিতের অধ্যাপক রোকনুজ্জামান ছোটনের অবস্থা দেখি-
সে নিজ আগ্রহে কিছু মজার ম্যাজিক শিখেছে। বৃহস্পতিবার শোতে ছোটন নিজে কিছু ম্যাজিক দেখায়, বাকি সময় ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে বসে শো দেখে। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে আর হাততালি দেয়। দেখে খুশিমাখা কৌতূহলে ঝলমলে চোখ। এই আধুনিক গ্যাজেটের যুগেও শিশুরা মুগ্ধ হয়ে সার্কাস দেখে। এটা দেখাও বড় আনন্দের। অদ্ভুত এই আনন্দে বারবার ঝাপসা হয়ে আসে ছোটনের চোখ।