কী পড়বে: আবোল তাবোল

একটা ছড়ার বই, তার শুরুতে লেখা-- “যাহা আজগুবি, যাহা উদ্ভট, যাহা অসম্ভব, তাহাদের লইয়াই এই পুস্তকের কারবার। ইহা খেয়াল রসের বই। সুতরাং সে রস যাঁহারা উপভোগ করিতে পারেন না, এ পুস্তক তাহাদের জন্য নহে। পুস্তকের অধিকাংশ ছবি ও কবিতা নানা সময়ে ‘সন্দেশ’ পত্রিকা হইতে সংগৃহীত হইয়াছে। এক্ষণ আবশ্যক মত সংশোধন ও পরিবর্তন করিয়া এবং নানা স্থলে নূতন মালমসলা যোগ করিয়া সেগুলি পুস্তকাকারে প্রকাশ করা হইল।”

নাবীল অনুসূর্যবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Oct 2013, 01:49 PM
Updated : 30 Oct 2013, 02:19 PM

বইয়ের নাম: আবোল তাবোল

লেখকের নাম: সুকুমার রায়

প্রথম প্রকাশ: ১৯২৩

ভাষা: বাংলা

প্রকাশক: ইউ রায় এন্ড সন্স

মোট ছড়া: ৫০টি (৭টি বেনামী)

ছোটদের ছড়ার বইয়ের শুরুতে অমন ঘটা করে ভ‚মিকা লেখার কী দরকার ছিল? দরকার হয়ে পড়েছিল এ জন্য যে, এর আগে বাংলায় কেউ খেয়াল রসের বই-ই লেখেনি। খেয়াল রস মানে অদ্ভুত রস; যত সব অদ্ভুতুড়ে কথাবার্তা, ননসেন্স লিটারেচার। বাংলায় খেয়াল রসের লেখা সেই প্রথম। আর অমন সব অদ্ভুতুড়ে ছড়া, সবার ভালো না লেগে পারে! ছোটদের তো বটেই, এমনকি বড়-বুড়ো সক্কলে ছড়াগুলোতে মজে গেল। বইটির নাম-- ‘আবোল তাবোল’।

বইটির প্রথম ছড়া ‘আবোল তাবোল- ১’-এও সুকুমার রায় তাই বলেছেন--

“আয়রে ভোলা খেয়াল-খোলা

        স্বপনদোলা নাচিয়ে আয়,

আয়রে পাগল আবোল তাবোল

        মত্ত মাদল বাজিয়ে আয়।

*** *** ***

আজগুবি চাল বেঠিক বেতাল

        মাতবি মাতাল রঙ্গেতে--

আয়রে তবে ভুলের ভবে

        অসম্ভবের ছন্দেতে।”

বইটির অনেকগুলো ছড়া এত্ত জনপ্রিয় যে, রীতিমতো কিংবদন্তি হয়ে গেছে। এখনও সেসব ছড়া মানুষের মুখে মুখে ফেরে। আর ছড়াগুলোও কী অদ্ভুতুড়ে! যতসব আজগুবি কথাবার্তা। কিন্তু আজগুবি হলে কী হবে, ছড়াগুলো যে কী মজার! আর ছন্দের গাঁথুনিও কী ভীষণ শক্তিশালী।

এই যেমন ‘খিচুড়ি’ ছড়াটি। হাঁস আর সজারু মিলে নাকি ‘হাঁসজারু’ হয়ে গেল! বক আর কচ্ছপ মিলে হল ‘বকচ্ছপ’! ছাগল আর বিছাও ভাবল, আমরাও মিলে যাই; হয়ে গেল ‘বিছাগল’! এমনি ‘গিরগিটিয়া’, ‘হাতিমি’, ‘মোরগরু’! শেষে কী হল--

“সিংহের শিং নেই, এই তার কষ্ট

হরিণে সাথে মিলে শিং হল পষ্ট।”

কিংবা ‘শব্দকল্পদ্রুম’ ছড়ার ফুলটাই-বা কেমন অদ্ভুত; ওই ফুল ফুটলে নাকি পটকা ফাটার মতো শব্দ হয়!

“ঠাস ঠাস দ্রুম দ্রাম, শুনে লাগে খটকা--

ফুল ফোটে? তাই বল! আমি ভাবি পটকা!

শাঁইশাঁই পনপন, ভয়ে কান বন্ধ--

ওই বুঝি ছুটে যায় সে ফুলের গন্ধ?”

আর ছোটবেলায় ‘বাবুরাম সাপুড়ে’ শোনেনি, এমন বাঙালি-সন্তানও আছে নাকি!

“বাবুরাম সাপুড়ে

কোথা যাস বাপুরে?

আয় বাবা দেখে যা,

দুটো সাপ রেখে যা!

যে সাপের চোখ নেই,

শিং নেই নোখ নেই,”

আর ‘কুমড়োপটাশ’ ছড়ার কুমড়োপটাশ আরেক অদ্ভুতুড়ে প্রাণী! ও যে কখন কী করে, আর তাইতে কী যে হয়!

“(যদি) কুমড়োপটাশ নাচে--

          খবরদার এসো না কেউ আস্তাবলের কাছে;

          চাইবে নাকো ডাইনে বাঁয়ে চাইবে নাকো পাছে;

          চার পা তুলে থাকবে ঝুলে হট্টমূলার গাছে!”

আর ‘প্যাঁচা আর প্যাঁচানি’ ছড়ার প্রথম দুই চরণ কী মজার--

“প্যাঁচা কয় প্যাঁচানি

খাসা তোর চ্যাঁচানি!”

‘একুশে আইন’ ছড়াটি কেবল অদ্ভুতুড়েই নয়, প্রতীকীও; যেন ইংরাজ সরকারকেই ব্যঙ্গ করছেন তিনি--

“শিবঠাকুরের আপন দেশে,

আইন কানুন সর্বনেশে!

কেউ যদি যায় পিছলে পড়ে,

প্যায়দা এসে পাকড়ে ধরে,

কাজির কাছে হয় বিচার--

                একুশ টাকা দণ্ড তার।”

আর ‘হুঁকোমুখো হ্যাংলা’ যে কী আজব প্রাণী! হ্যাংলা মোটেও হাসে না। সারাক্ষণ ফ্যাকাশে মুখে কাঁদ কাঁদ হয়ে থাকে। আবার মাঝে মাঝে মনে যখন খুব ফূর্তি আসে, তখন থপ থপ পায়ে নাচে, আর সারাদিন গান গায়।

একদিন সে খুব চিন্তায় পড়ে গেছে। তার দুই লেজ, ডাইনে আর বাঁয়ে। ডানে মাছি বসলে ডানের লেজ দিয়ে মারে। বামে বসলে অস্ত্র বাঁয়ের লেজ। কিন্তু--

“যদি দেখি কোন পাজি         বসে ঠিক মাঝামাঝি,

                কি যে করি ভেবে নাহি পাইরে-

ভেবে দেখ একি দায়,           কোন ল্যাজে মারি তায়

                দুটি বই ল্যাজ মোর নাই রে!”

‘রামগরুড়ের ছানা’রাও কম অদ্ভুত নয়। তাদের নাকি হাসতে মানা। এই বুঝি কেউ হেসে দিল, সারাক্ষণ তাদের মনে সেই ভয়। ভুলেও বনের ধারে যায় না; যদি “দখিন হাওয়ার সুরসুরিতে” হেসে ফেলে!

“রামগরুড়ের বাসা ধমক দিয়ে ঠাসা,

                হাসির হাওয়া বন্ধ সেথায়

                নিষেধ সেথায় হাসা।”

‘ভয় পেয়ো না’ ছড়াতে আবার কে যেন কাকে দাওয়াত করছে। বলছে, এস আমার বাসায়, কোনো ভয় নেই। আমার হাতে মুগুর আছে, তা দেখে ভয়ের কী আছে! আমার মুগুর এমন নরম, ও দিয়ে মারলে একদমই ব্যথা লাগে না! শেষে ভয় ভাঙাতে গিয়ে এমন রেগে গেল, বলতে লাগল--

“অভয় দিচ্ছি শুনছ না যে? ধরব নাকি ঠ্যাং দুটা?

বসলে তোমার মুণ্ডু চেপে বুঝবে তখন কাণ্ডটা!

আমি আছি গিন্নি আছেন, আছে আমার নয় ছেলে-

সবাই মিলে কামড়ে দেব মিথ্যে অমন ভয় পেলে।”

এমনি অদ্ভুত অদ্ভুত সব ছড়া আছে পুরো ‘আবোল তাবোল’ জুড়েই। আর শুরুর ছড়ার সঙ্গে মিল আছে শেষের ছড়াটিরও-- ‘আবোল তাবোল- ২’। তাতে এমন অদ্ভুতুড়ে ছড়ার রাজ্যের সমাপ্তি ঘোষণা করেছেন সুকুমার। শেষের চরণগুলো এ রকম--

“মক্ষিরাণী পক্ষীরাজ-

দস্যি ছেলে লক্ষ্মী আজ!

আদিম কালের চাঁদিম হিম

তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম।

ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর,

গানের পালা সাঙ্গ মোর।”