কাঁকড়াছড়ির অংসুই

কাঁকড়াছড়ির গভীর জঙ্গল। উঁচু নিচু পাহাড়। ঘন ঝোপঝাড়ে ভর্তি। কোনো মানুষ বনে হারিয়ে গেলে খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

মিলন বনিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 May 2021, 05:56 AM
Updated : 28 May 2021, 06:15 AM

ঘন বনের মাঝখানে একটুখানি সমতল জায়গা। তার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পাহাড়ি ছড়ার স্বচ্ছ পানির ধারা। পাহাড়ি এলাকায় ছড়ার পানিগুলো বেশ ঠান্ডা। পরিষ্কার এবং খেতেও সুস্বাদু। গভীর জঙ্গলে বসবাসকারী পাহাড়িদের এই ছড়ায় একমাত্র পানির উৎস।

ছেলেটির নাম অংসুই মারমা। প্রতিদিন কাঁকড়াছড়ির জঙ্গলে গরু চড়াতে আসে। যে প্রধান রাস্তা ধরে সে আসে তা ছড়া থেকে তিন চার মাইল হবে। আশপাশে কোনো বাড়ি ঘর নেই। দশ বারো বছরের ছেলেটা প্রতিদিন সকালে গরু নিয়ে আসে, আবার সন্ধ্যায় ফিরে যায়।

মাঝে মাঝে অংসুই-র ভীষণ মন খারাপ হয়। এত বড় বনে সে একা। কারও সাথে যে একটু কথা বলবে তারও উপায় নেয়। চারপাশে পাহাড় ঘেরা বনভূমি। এই সমতল ভূমির ঝর্ণাধারার সাথে তার সখ্যতা। পাশে শতবর্ষী একটি বটগাছ। বটের লতাগুলো মাটিতে ঝুলে আছে। শিকড়গুলোকেই এক একটা গাছ মনে হচ্ছে। কিছু কিছু এখনও ঝুলছে। গাছের নিচে বসলে যে কারও মন ভালো হয়ে যাবে। ঝির ঝিরে মিষ্টি বাতাস। শীতল হাওয়া। ছায়া সুনিবিড়। এ পথ দিয়ে যাওয়ার সময় বনের কাঠুরিয়ারা বটের ছায়ায় একটু জিরিয়ে নেয়।

অংসুই বটের ঝুলন্ত লতা দিয়ে একটা দোলনা বানিয়ে নিয়েছে। নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে পাহাড়ি ঝরনা। সকালে দুটো পান্তা ভাতে লবণ মরিচ মেখে খেয়ে বের হয়। সারাদিন পেটে আর কোনো দানাপানি পড়ে না। প্রায়ই বনবাদাড়ে ঘুরতে ঘুরতে বুনো ফলমূল পেলে খেয়ে নেয়। তার পর ঝর্ণার কাছে আসে। দু’হাতের খোলস ভরে ঠান্ডা পানি পান করে। তারপর দোলনায় ঘুমিয়ে পড়ে। যেদিন মন ভালো থাকে সেদিন কোমর থেকে বাঁশের বাঁশিটা বের করে বাজায়। মনটা হালকা হয়।

আজও গরু নিয়ে আসার সময় তার সমবয়সী বন্ধুদের দেখেছে স্কুলে যেতে। তারও খুব ইচ্ছা। সেও স্কুলে যাবে। কিন্তু পারছে না। ছোটবেলায় ম্যালেরিয়ায় মা মারা গেছে। এখন সৎমায়ের ঘরে দুবেলা খেয়ে পড়ে থাকতে হচ্ছে। বাবা ক্যাচিংলা মারমা। জুম চাষ করে। মা-ও সাহায্য করে। তবে বেশির ভাগ সময় তাড়ি খেয়ে পড়ে থাকে। অংসুই এর কোনো খোঁজ খবর নেয় না।

আজ আসার সময় বন্ধু তরুণের কাছ থেকে একটা বই চেয়ে নিয়েছে। প্রথমে দিতে চায়নি। অনুরোধ করে বলেছে- আমি তো পড়তে জানি না। মাঠে বসে বসে ছবিগুলো দেখবো। কোনো ক্ষতি করব না। আবার বিকেলে তোর বাড়ি গিয়ে দিয়ে আসবো।

আজ বাঁশিটা বের করা হয়নি। শুধু উল্টেপাল্টে বইয়ের ছবিগুলো দেখছে। একটা ছবি দেখে চোখ আটকে গেলো। ছবিটা হুবহু এই বটগাছটার মতো যেখানে অংসুই বসে আছে। অংসুইয়ের কাছে ব্যাপারটা বিশ্বাস হচ্ছে না।

বনের ভেতর চড়ছে গরুগুলো। ছোট অংসুই-এর কান দুটো সজাগ। ছবি দেখছে আর গরুগুলোর গতিবিধি খেয়াল করছে। গরুর গলায় দড়ি নেই। বাঁশের ঘণ্টা বাঁধা থাকে। গরুগুলো যখন মাথা নেড়ে ঘাস খায় তখনই টুং টাং টুং টাং শব্দ হয়।

অংসুই সেই শব্দ শুনে গরুগুলোর অবস্থান বুঝতে পরে। খুব ক্লান্ত লাগছে। বইয়ে মধ্যে গ্রামের ছবি, প্রকৃতির ছবি আর মায়ের ছবিগুলো তাকে মুগ্ধ করছে। অংসুই ভাবছে, আমি যদি পড়তে জানতাম তাহলে কতো ভালো হতো। অমনি ছোট শিশুর মনে একটা স্বপ্ন খেলে যায়। সে বইটা বন্ধ করে বাঁশিতে ফুঁ দিল। ক্ষুধাও লেগেছে। কিন্তু কোনো উপায় নেয়। আশপাশে কোনো খাবারও পাওয়া যাবে না। তাছাড়া এখান থেকে আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। বেলা পড়ে এলে গরুগুলো নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। তরুণের বইটা ফেরত দিতে হবে। তারপর ভাত খেয়ে ঘুমাবে।

অংসুইকে স্বপ্নটা তাড়া করছে। দোলনায় দুলতে দুলতে ক্লান্তিতে চোখ বুঝে এলো। রোদের তাপটা তেমন গায়ে লাগছে না। মাথার উপরে ডালে বসে দুটো শালিক কিচির মিচির করছে। তারপর কোথা থেকে একটা সুন্দর পরী এসে অংসুইকে ডেকে বলছে- অংসুই ওঠো, বলে হাতে ধরা জাদুর কাঠিটা অংসুই-র মাথায় বুলিয়ে দিল।

অংসুই-এর ঘুম ভেঙে যায়। চোখ মেলে দেখে তারই সমবয়সী অপূর্ব সুন্দরী একটা মেয়ে। মেয়ে তো নয় যেন সাক্ষাৎ পরি। এত সুন্দর মেয়ে অংসুই আগে কখনো দেখেনি। তার পরনে ধবধবে সাদা পোশাক। একটুও ময়লা নেই। আর কী অপূর্ব সুন্দর হাসি! মাথায় হীরের তাজ। দুপুরের রোদে চিক্ চিক্ করছে।

অংসুই চোখ মুছে জিজ্ঞাসা করল-

তুমি কে ভাই?

আমি পাহাড় পরি, ঝর্ণা।

তুমি কোথায় থাকো?

এই বনে।

আমি তো প্রতিদিন এখানে গরু চড়াতে আসি। তোমাকে তো কখনও দেখিনি।

কিন্তু আমি তো প্রতিদিন তোমাকে দেখি।

এই বলে মেয়েটি হাসল। অবাক হলো অংসুই। ভাবল একি করে সম্ভব। কোন ভূঁত টুত নয় তো। এই ভেবে জিজ্ঞাসা করল-

তুমি কি একা থাকো? তোমার কেউ নেই?

আমার সবাই আছে। আজ আমার বন্ধুরা সবাই স্কুলে গেছে। আমি যায়নি। তাই ভাবলাম তোমার সাথে একটু গল্প করে আসি।

বেশতো। এসো বসে গল্প করি। তুমি খুব ভালো আর খুব সুন্দর।

তুমিও বেশ সুন্দর। দেখো না তোমার কানের লতিদুটো স্বাভাবিকের চেয়ে একটু লম্বা। ঠিক ভগবান বুদ্ধের মতো।

অংসুই নিজের কান দুটো ধরে দেখল। এভাবে কখনও ভেবে দেখেনি। সে লজ্জা পেয়ে বলল-

সত্যি কি ভগবানের কান দুটো একটু বড়? কেন জানি না। তিনি তো ভগবান। তাই হয়তো।

তুমি তো পড়তে জানো না। শুধু ছবি দেখছিলে বুঝি।

তুমি কি করে জানলে?

বললাম তো, আমি সব জানি।

এর মধ্যে পুরো বনজুড়ে অনেকগুলো পাখি জড়ো হয়েছে। চারদিকে পাখির কলকাকলি। পাশাপাশি হরিণ, বনমোরগ, শেয়াল, আরও অনেক পশু-পাখি হাজির হলো। সবাই যেন ঝর্ণা পরিকে পাহারা দিচ্ছে। কোলাহল করে আনন্দ করছে। তাদের দেখিয়ে ঝর্ণা পরি বলল-

ওই দেখ আমার সব বন্ধুরা এসেছে। এসেই কেমন হৈচৈ শুরু করেছে দেখো।

তা তুমি স্কুলে যাওনি কেন?

আজ আমার স্কুলে যাওয়া মানা। কারণ আজ আমার জন্মদিন। মা-বাবার কাছে থাকতে হবে। সারাদিন বন্ধুরা আসবে, আনন্দ হবে, খাওয়া দাওয়া হবে, এই আর কী!

ইস্, তোমার জন্মদিন! শুনেছি জন্মদিনে বন্ধুকে উপহার দিতে হয়। কিন্তু আমার তো কিছু নেই। তোমাকে কী দেব?

ও নিয়ে ভেবো না। আমি তো তোমার বন্ধু। বলো আমার জন্মদিনে তুমি কী চাও?

আমি কী চাইব? আমি তো লেখাপড়া জানি না।

তুমি কি পড়ালেখা শিখতে চাও?

চাই তো। কিন্তু কে আমাকে শেখাবে?

আমি শেখাবো।

কিন্তু এখানে তো স্কুল নেই। আমার বুঝি স্কুলে যেতে হবে না? বই কোথায় পাবো?

সবই হবে। আগে বলি শোনো। তুমি প্রতিদিন সকালে এখানে গরু নিয়ে আসবে।

এই বলে ঝর্ণা পরি হাত উঁচিয়ে একটা বাক্স হাতে দিয়ে বলল-

এই নাও, তোমার পোশাক আর বই। এগুলো নিয়ে তুমি স্কুলে যাবে। ও বুঝেছি, তুমি ভাবছ গরুগুলোর কী হবে? কিছু ভেবো না। আমি তো এখানে থাকি। আমার অনেক বন্ধু। আমরা তোমার গরুগুলো পাহারা দেবো। কোনো অসুবিধা হবে না। তুমি স্কুল শেষে বিকেলবেলা এদিকে এসে গরু নিয়ে ঘরে ফিরে যাবে। কেমন মজা হবে বল তো?

অংসুই কিছুই ভাবতে পারছে না। এমন কথা শুনে বনের সব পশু-পাখিগুলো হাততালি দিয়ে উঠল। ওদিকে গরুগুলো কখন যে এই দলে যোগ দিয়েছে অংসুই খেয়াল করেনি। আনন্দে অংসুই-র দুচোখে জল এসে গেছে। কী বলবে বুঝতে পারছে না। গরুগুলো ঘন ঘন শিং নেড়ে সম্মতি জানাচ্ছে। যেন তারাও খুব আনন্দ পাচ্ছে। এবার অংসুই-র এর কোমল মুখখানা লাল হয়ে গেল। সে ভাবছে এসব কী করে সম্ভব। আমিতো স্বপ্ন দেখছি না। স্পষ্ট দেখতে পারছি সবকিছু। কৃতজ্ঞতার সাথে বলল-

আমি কী বলে তোমায় ধন্যবাদ দেব বুঝতে পারছি না। সত্যিই আমার লেখাপড়া করার খুব ইচ্ছা।

ঠিক আছে। কাল আবার দেখা হবে। তোমার সব স্বপ্নই পূরণ হবে। এই বলে পাহাড় পরী চলে যাওয়ার জন্য মুখ ফেরাল। হাত নেড়ে বলল- ভালো থেকো। আমি চললাম। কাল আবার আসব।

একটু দাঁড়াও। অংসুই হাত তুলে বলল।

সময় নেয় তো। দেখছ না সবাই কেমন তাড়া দিচ্ছে।

আচ্ছা। এই নাও, বলে বাঁশিটা এগিয়ে দিয়ে বলল- শুভ জন্মদিন। আমার তো আর কিছু নেই। তুমি কিছু মনে করো না।

এটাই আমার জন্য অনেক বড় উপহার। তোমাকে ধন্যবাদ। এবার আসি। কাল কথা হবে।

এবার গরু নিয়ে ফেরার পালা। বেলা পড়ে গেছে। গোয়াল ঘরে গরু বেঁধে বইটা নিয়ে তরুণের বাড়ি যেতেই তরুণ অগ্রহ নিয়ে বলল- আয়, আমার পাশে বস। আমি তোকে লেখাপড়া শেখাবো। আমার মা বাবা বলেছে, এতে ভগবান আমাদের ভালো করবে।

অংসুই পাটিতে বসে ফ্যাল ফ্যাল করে তরুণের মুখের দিকে চেয়ে থাকে। বারবার পাহাড় পরি ঝর্ণার কথা মনে হচ্ছে। তরুণ শিক্ষকের মতো বলছে- এবার বল, স্বরে-অ, স্বরে-আ। অংসুই মুখে মুখে তাই বলে যাচ্ছে।   

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!