লাল সবুজ জামা

ঘরে অনেক জিনিস। কিন্তু রাকিবের চোখ আটকে গেল লাল-সবুজ জামাটার দিকে তাকিয়ে। এতদিন হলো মামার বাড়িতে এসেছে, কিন্তু এ জামাটা কেন বাধাঁই করে রাখা হয়েছে তা জানার আগ্রহ প্রকাশ করেনি।

রণজিৎ সরকাররণজিৎ সরকার
Published : 23 Dec 2020, 05:16 AM
Updated : 23 Dec 2020, 05:16 AM

আজ কেন যেন তার খুব ইচ্ছে হলো জামাটা এখানে কেন রাখা হয়েছে, রাখার উদ্দেশ্য কী তা জানা। রাকিব জামাটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এমন সময় তার মামা ইজার এসে বললেন, ‘রাকিব, জামার দিকে তাকিয়ে কী দেখছ?’

রাকিব বলল, ‘মামা, জামাটা এখানে এভাবে রাখার রহস্য জানতে চাই।’

মামা আগ্রহ নিয়ে বললেন, ‘তুমি ঠিক ধরেছ। রহস্য নয়, মূল ঘটনাটা আমার জানা আছে। তোমাকে অবশ্যই বলব। এটা তোমার জানা উচিত।’

‘মামা, এ জামার কারণেই কি আপনার লাল রঙ প্রিয়, আর তাই লাল পোশাক বেশি পরেন?’

‘বলতে পারো। কিছুটা।’

‘মামা তাহলে এবার বলো। এ জামার কাহিনি কী!’

মামা গভীরভাবে জামার দিকে তাকালেন। তারপর দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়লেন। বললেন, ‘শোনো রাকিব, আমরা তিন ভাই ছিলাম। তোমার তিন মামা।’

‘এখনো তো আপনারা দুজন আছেন। বাকি একজন কোথায়?’

‘তিনি আর আমাদের মাঝে নেই।’

‘কোথায় আছেন?’

‘তোমার মামার নাম ছিল ইমরান। তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ হয়েছেন। আর এ জামাটা তার।’

মামার কথা শোনার পর রাকিব কিছু বলতে পারল না। জামার দিকে তাকিয়ে মুক্তিযোদ্ধা মামার প্রতি শ্রদ্ধা ও দোয়া করতে লাগলো মনে মনে।

মামা বললেন, ‘রাকিব, কি হলো, কথা বলো।’

মাথা উঁচু করে রাকিব বলল, ‘আচ্ছা মামা, জামাটা কীভাবে সংগ্রহ করেছিলেন?’

‘ভাইয়া যে এলাকায় যুদ্ধ করেছিলেন সেখান শহীদ হন। ভাইয়ার বন্ধু ছিল রাসেল। তিনি জীবিত ছিলেন। ভাইয়া শহীদ হয়েছেন যুদ্ধ শেষ হওয়ার কয়েক দিন আগে। যুদ্ধ শেষ হলে ভাইয়ার ওই বন্ধু জামাটা নিয়ে এসে মায়ের কাছে বলেছিলেন, আপনার সন্তান ফিরে আসেনি। শহীদ হয়েছে। যুদ্ধ অবস্থায় এ জামাটা পরেছিল। শেষ স্মৃতি জামাটা নিয়ে এসেছি। এটা রাখুন।

রক্ত মাখা জামাটা পেয়ে বুকে চেপে ধরলেন মা। মায়ের চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়েছিল। কিন্তু কান্নার শব্দ শোনা যায়নি। জামা বুকে জড়িয়ে ধরে মনে হয় স্বাধীন বাংলাদেশ বুকে ধরে রেখেছেন। আমরা আর মাকে কোন প্রশ্ন করিনি। তখন আমি জামাটা সুন্দর করে রেখে দিলাম। কয়েকদিন পর বাঁধাই করে নিয়ে এসে রেখে দিলাম।’

‘এ হলো জামার ঘটনা।’

‘এ তো একটা জামার ঘটনা গেল। ঘটনা আরও আছে।’

‘আবার কিসের ঘটনা।’

‘এলাকার কিছু মানুষ এ জামাটার কথা শুনতে পারে না। জামাটা আমাদের বাড়ি থেকে চুরি হয়ে যায়।’

জামা চুরির কথা শুনে রাকিব অবাক হয়ে বলে, ‘কারা জামাটা চুরি করেছিল মামা!’

‘চুরি করেছিল আমাদের এলাকার মানুষজন। যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, তারা।’

‘বলেন কি! যুদ্ধ করে জীবন দিয়ে স্বাধীন একটা দেশ যে উপহার দিল তার জামা চুরি। ভাবতে অবাক লাগে মামা। সত্যি আমরা মানুষ কবে হব। পরে জামাটা উদ্ধার করলে কীভাবে?’

‘এলাকায় যত মুক্তিযোদ্ধা আছে সবাই মিলি এলাকায় মাইকিং করা হলো। যে জামাটা চুরি করেছে সে যেন ভালোভাবে জামাটা ফেরত দেয়। যদি ফেরত না দেয় তাহলে যাদের সন্দেহ হবে তাদের কিন্তু খবর আছে। বাড়ি বাড়ি অভিযান চালানো হবে।’

মামার কথা শেষ না হতেই রাকিব বলল, ‘মামা তাহলে তো এ জামা উদ্ধার করা নিয়ে এলাকায় ব্যাপক উত্তেজনা শুরু হয়েছিল।’

‘হ্যাঁ, ব্যাপক। কারণ কি জানো।’

‘কী?’

‘মুক্তিযোদ্ধা অনেকেই বুঝতে পেরেছিলেন, কারা আসলে জামাটা লুকিয়ে রেখেছিল। তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্যই জামাটার খোঁজ নেওয়া শুরু হয়।’

‘আসলে জামাটাকে কে চুরি করেছিল মামা?’

‘এ এলাকার একজন রাজাকার। সে শুধু জামা চুরি করেনি, এলাকার অনেক হিন্দু-মুসলিমদের বাড়ি থেকে অনেক কিছু লুট করে নিয়ে এসে তার বাড়িতে রেখেছে। তার কাছ থেকে সব উদ্ধার করার জন্যই জামা খোঁজার উদ্দেশ্যে তার বাসায় যায় সবাই।’

‘মামা বেশ কৌশলী তো ছিল সবাই!’

‘কৌশলী না হলে তো আবার কোনো কিছু উদ্ধার করা যাবে না।’

‘অবশেষে কীভাবে উদ্ধার করলে মামা?’

‘গ্রামের অনেক বাড়িতে যাওয়া শুরু করল সবাই। তারপর যখন মজিদের বাড়িতে ঢোকা হলো তখন মজিদ বুঝতে পারল। সে ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু তার স্ত্রী এসে হাজির হলো। হাতে জামাটা।

‘মামা, মজিদের স্ত্রী জামা নিয়ে এসে হাজির! কিছু বুঝতে পারছি না।’

‘ভাগ্নে আগে আমার কথা শেষ করতে দাও। তারপর না তুমি বুঝতে পারবে।’

‘আচ্ছা মামা বলেন।’

‘তারপর জামাটা হাতে উঁচু করে ধরে বললেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমরা স্বামী যে অন্যায় করেছে তার জন্য আমি আপনাদের কাছে ক্ষমা চাই। এ জামাটা একটা শহীদ মুক্তিযোদ্ধার জামা। আমি তাদের পরিবারকে ফেরত দিতে চাই। শুধু এ জামা নয়, এ এলাকার যার যা কিছু আমাদের বাড়িতে আছে তা দেখে দেখে নিয়ে যাবেন সবাই। উপস্থিত আমরা সবাই অবাক হলাম তার স্ত্রীর কথা শুনে। তারপর আমরা জামাটা নিয়ে এলাম। আর এ এলাকার লোকজন এসে ওদের যার যা জিনিস আছে তা নিয়ে যেতে লাগল।’

‘তাই! খুবই ভালো কাজ হয়েছে। আর কোন বড় রকমের শাস্তি দেননি।’

‘এর চেয়ে আর বড় রকমের অপমান আর শাস্তি কী হতে পারে। তারপর থেকে তিনি এ এলাকায় মাথা উঁচু করে চলতে পারেন না।’

‘আচ্ছা, মামা আপনার এলাকায় যারা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন তাদের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য কী কিছু করেছেন?’

‘না, তেমন তো কিছু করা হয়নি।’

‘এটা তো ভুল করেছেন মামা। আপনাদের উচিত ছিল ইমরান মামার নামে হোক কিংবা এ গ্রামে আরও যারা শহীদ হয়েছেন তাদের নাম দিয়ে একটা স্মৃতিস্তম্ভ করা, তাহলে খুবই ভালো হতো। পরবর্তী প্রজন্ম এলাকাভিত্তিক শহীদদের নাম জানতে পারত।’

‘তুমি তো ভালো কথা বলেছ ভাগ্নে। এটা তো ভালো আইডিয়া দিয়েছ।’

‘খুব দ্রুত করা উচিত। যদি এলাকায় কোন শিশুকে প্রশ্ন করা হয়, তোমার এলাকায় কজন মুক্তিযোদ্ধা আছে? তাদের নাম বলো। আমার মনে হয় অনেকেই পারবে না। এ এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে যদি কোন স্মৃতিস্তম্ভ বা ভাস্কর্য থাকত তাহলে কিন্তু এলাকায় যে মানুষটা দেখত তখন তার কৌতুহল তৈরি হতো আর মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানার আগ্রহ বাড়ত। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানার পর তার দেশের প্রতি অনেক দায়িত্ব কর্তব্য বেড়ে যাবে।’

‘তুমি সুন্দর কথা বলেছ দেখছি।’

‘শুধু দেখলে হবে না মামা। কাজটা করে দেখিয়ে দিতে হবে। কারণ আমার মনে হয় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষেরা যদি এমন একটা উদ্যোগ নিত যে গ্রামে গ্রামে যত মুক্তিযোদ্ধা আছে তাদের নাম দিয়ে একটা করে স্মৃতিস্তম্ভ বা মিনার তৈরি হবে তাহলে খুব ভালো হতো। যুগ যুগ তাদের নামটা মনে রাখত সবাই। তাদের আত্মদানের কারণে হয়তো আমাদের এ প্রজন্মের দেশের প্রতি ভালোবাসা ও দেশপ্রেম তৈরি হতো।’

‘ভাগ্নে তুমি আমার মনের কথা বলেছ। এটা আমাদের করা খুব প্রয়োজন। এ বিষয়টা আমি কর্তৃপক্ষকে বলার চেষ্টা করব।

‘মামা আমাদের কিন্তু এ দেশটাকে রক্ষা করে মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রদ্ধা করে এসব কাজ করতে হবে। অগ্রসর হতে হবে।’

মামা ভাগ্নের গল্পের মাঝে এসে হাজির হলেন তার মামি। মামি এসেই বললেন, ‘কি ব্যাপার তোমারা এত সময় এখানে কী আলোচনা করো?’

‘মামি এ জামাটার রহস্য জানার ইচ্ছা ছিল। তাই আমি মামার কাছ থেকে বিষয়টা জানার চেষ্টা করলাম।’

‘তোমার যে সবকিছুতে জানার ইচ্ছা সেটা আমি ভালো করে জানি। আর সেজন্য তুমি মেধাবী। আশা রাখি তুমি তোমার মেধা কাজে লাগিয়ে দেশ ও দশের সেবায় কাজে লাগাবে।’

মামা বললেন, ‘শোনো, ও বড় একটা আইডিয়া দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে যা এতদিন হয়তো কেউ ভাবেনি। কিন্তু আমার ভাগ্নে এ বয়সে এমন সুন্দর একটা ভাবনা ভেবেছে। তাই আমি অবাক হলাম। তোমাকে ধন্যবাদ।’

মামি বললেন, ‘কি আইডিয়া তোমাকে বলেছে? আমাকে এখন বলা যাবে নাকি যাবে না?’

‘অবশ্যই তোমাকে বলা যাবে। আর বাস্তবায়ন করতে হলে তোমার পরামর্শ লাগবে।’

‘কী আইডিয়া! আমাকে বলো।’

‘প্রতিটি গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের একটা তালিকা করে সেই তালিকা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নামে স্মৃতিস্তম্ভ বা মিনার তৈরি করা।’

‘আর বলতে হবে না। আমি বুঝতে পেরেছি। ঠিক যেভাবে আমাদের কলেজে যারা শহীদ হয়েছে তাদের নাম লেখা রয়েছে ঠিক সেভাবেই তো!’

‘হ্যাঁ। ঠিক এভাবেই।’

মামি বললেন, ‘তুমি কোনো চিন্তা করো না। এলাকার সব বন্ধুকে বলো। এমন কাজের কথা শুনলে সবাই এগিয়ে যাবে।’

‘তুমি যা বললে আমি তা অবশ্যই পালন করব। কেউ যদি না-ও এগিয়ে আসে আমি আমার গ্রামে শুরু করব। আশা করি আমার গ্রাম থেকে এ কাজটির শুভ সূচনা হবে।’

‘ঠিক আছে মামা। তাহলে কবে শুরু করবেন?’

‘আজ আমি আর তুমি গ্রামে বের হব। গ্রাম ঘুরে ঘুরে দেখব কোথায় ভালো জায়গা পাওয়া যায়।’

‘মামা জায়গাটা এমনভাবে নির্ধারণ করতে হবে যেন গ্রামের সবাই দেখতে পায় এবং অন্য মানুষও সেটা সহজে বুঝতে পারে।’

‘ঠিক আছে মামা। তুমি থাকতে থাকতে চলো গ্রামটা ঘুরে আসি। আমি আর তুমি দেখার পর গ্রামের মানুষকে নিয়ে তো বসতে হবে।’

‘তা ঠিক, সবাইকে জানিয়ে কাজটা করা ভালো। আর এ কাজটা তো আর তোমার একা করা সম্ভব না। সবাই মিলে করতে হবে।’

‘তা তো অবশ্যই।’

‘তাহলে চলো আমরা বের হই।’

মামা ভাগ্নে গ্রামে ঘুরতে বের হলো। গ্রামের বিভিন্ন জায়গা ঘুরতে লাগল। ঘুরতে ঘুরতে এমন একটা জায়গা পছন্দ হলো যেটা হলো গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের পাশে বাজারের কাছে ওই তিন রাস্তার মাথায়। এ জায়গাটা কারো ব্যক্তিগত না। সরকারি জায়গা।

ওই রাতেই মামা ইজার এসে গ্রামের প্রতিটি মানুষকে তার বাসায় ডাকল। কয়েকজন বাদে গ্রামের মোটামুটি সবাই রাজি হয়ে গেল। শুরু হলো গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের নাম সংগ্রহ করা। ইজার তার বন্ধুদের নিয়ে গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের নাম সংগ্রহ করতে লাগল।

যুদ্ধকালীন শহীদ হয়েছেন ত্রিশজন। যুদ্ধের পর মুত্যুবরণ করেছেন বাইশজন। আর এখন জীবিত আছেন আটজন। এ পঞ্চাশজনের নাম ধরে সে অনুযায়ী মিনার করতে কত টাকা বাজেট লাগবে রাজস্ত্রীর কাছে জানতে চাওয়া হলো। বাজেট শুনে কাজ শুরু হলো। ধীরে ধীরে কাজ শেষ হলো। এলাকার সব মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে উদ্বোধন করা হলো মিনার।

পরদিন বিভিন্ন পত্রিকায় এ স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির খবর ছাপা হলো। অনেক দূর থেকে মানুষ আসতে শুরু করল দেখার জন্য। ধীরে ধীরে দেশের বিভিন্ন গ্রামে এমন কাজ শুরু হলো। সে সংবাদগুলো পত্রিকায় পড়ে মামা-ভাগ্নে আনন্দ পায়।

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!