মহান মুক্তিযুদ্ধে তার নেতৃত্বে ‘দাসপার্টি’ মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে দাঁড়ায় পাক হানাদারদের কাছে। জগৎজ্যোতির মুখোমুখি হওয়া মানে হানাদারদের একটি পরাজয়ের গল্প। উত্তর-পূর্ব রণাঙ্গনে মুক্তিসেনাদের কাছে প্রেরণার রসদ হয়ে উঠেন তিনি। মৃত্যুর সময়ও তিনি রেখে যান সেই প্রেরণার উৎস। আজ তার ৪৯তম শাহাদাত দিবস।
তার পুরো নাম জগৎজ্যোতি দাস। ডাক নাম শ্যামা। সহযোদ্ধাদের রক্ষার জন্য একাকি লড়ে প্রাণ দিয়ে যাওয়া বাংলার এ সূর্যসন্তানের জন্ম হবিগঞ্জের আজমিরিগঞ্জ উপজেলার জলসুখা গ্রামে এক নিম্নবিত্ত পরিবারে। জন্ম ২৬ এপ্রিল ১৯৪৯ সালে। বাবা জীতেন্দ্র চন্দ্র দাস ও মা হরিমতি দাসের দুই ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে জগৎজ্যোতি দাস ছিলেন সবার ছোট।
বাবা ও বড় ভাই রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। হতদরিদ্র পরিবারে জন্ম নিয়েও তিনি ১৯৬৮ সালে দ্বিতীয় বিভাগে এনট্রান্স পরীক্ষায় পাশ করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি ভর্তি হন সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন উচ্চ মাধ্যমিক শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী।
যুদ্ধের রণকৌশল রপ্ত করতে ট্রেনিংয়ের জন্য চলে যান মেঘালয়ে। প্রায় ৩২ দিনের প্রশিক্ষণ পর্বের মধ্যে ইকো-১ ট্রেনিং ক্যাম্পের ডিউটি সার্জেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। ওই সময় অ্যামবুশে পা দিলে কিভাবে বের হওয়া যায়, গ্রেনেড নিক্ষেপ, বিমান ধ্বংস, স্থলপথে শত্রুকে পরাস্ত করার কৌশলসহ গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধের ময়দানে একজন দক্ষ সৈনিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেন জগৎজ্যোতি। নেতৃত্বের গুণাবলী থাকায় ৩৬ জন সাহসী যুবক নিয়ে গড়ে তোলেন ‘দাস কোম্পানি’, সহ অধিনায়কের দায়িত্বে ছিলেন ইলিয়াছ।
মুক্তিযুদ্ধে টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের অধীনে বিস্তীর্ণ ভাটি অঞ্চল শত্রুমুক্ত রাখার দায়িত্ব পড়েছিল তার উপর। দিরাই, শাল্লা, ছাতক, আজমিরিগঞ্জ, বানিয়াচং, জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনার নৌপথ পাক দখলমুক্ত রাখার যুদ্ধে প্রাণ বাজি রেখে লড়ে যান দাস কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা। এসব অঞ্চলে তিনি ছিলেন পাক বাহিনীকে দলিত-মথিত করে এগিয়ে যাবার অগ্রপথিক।
শুধু তার সাহসী অভিযানের কারণে পাকিস্তান সরকার রেডিওতে ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়, ‘এই রুট দিয়ে চলাচলকারী ব্যক্তিদের জানমালের দায়িত্ব সরকার নেবে না’। মাত্র ১৩ জন সহযোদ্ধা নিয়ে বানিয়াচংয়ে পাক বাহিনীর ২৫০ সেনা ও দোসরদের অগ্রগতি রোধ করে দেন, যুদ্ধে প্রাণ হারায় পাক বাহিনীর ৩৫ জল্লাদ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আল বদরদের কাছে জগৎজ্যোতি ছিলেন এক মূর্তিমান আতঙ্ক। বিশাল ভাটিবাংলায় পাক বাহিনীকে পরাভূত করতে দাবড়ে বেড়িয়েছেন তিনি।
জামালপুর মুক্ত করার অভিযানে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হন জগৎজ্যোতি, হারাতে হয় তার সহযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম বীর বিক্রমকে। মাত্র ১০-১২ জন সহযোদ্ধা নিয়ে তিনি মুক্ত করেন শ্রীপুর। খালিয়াজুড়ি থানায় ধ্বংস করে দেন শত্রুদের বার্জ। অগাস্ট মাসে কোন গুলি করা ছাড়াই দিরাই-শাল্লায় অভিযান চালিয়ে কৌশলে আটক করেন দশ সদস্যের রাজাকারের দলকে, যারা এলাকায় নির্যাতন চালাচ্ছিলো- খুন, ধর্ষণ ও লুটপাট চালাচ্ছিলো।
রানীগঞ্জ ও কাদিরগঞ্জে অভিযান চালিয়েও জ্যোতি আটক করেন পাক হায়েনাদের দোসর রাজাকারদের। ২৯ জুলাই বৃহস্পতিবার জামালগঞ্জ থানা ও নৌবন্দর সাচনাবাজার শত্রুমুক্ত করে আলোচনার শীর্ষে চলে আসেন জগৎজ্যোতি। স্বাধীন বাংলা বেতারে তার বীরত্বগাথা, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রণকৌশল আর কূটচালে তাকে মূল টার্গেট করা হয়। সুযোগের সন্ধানে থাকে পাক-দোসর রাজাকাররা।
জ্যোতির নেতৃত্বে সিলেট সুনামগঞ্জ সড়কের বদলপুর ব্রিজ বিধ্বস্ত করা হয়। আর তারই কৃতিত্বের কারণে দাস কোম্পানির যোদ্ধারা ভারতীয় কমান্ড বাহিনীর মেজর জিএস ভাটের প্রশংসা পায়। ১৭ অগাস্ট পাহাড়পুরে কমান্ডার জগৎজ্যোতির রণকৌশল আর বীরত্বে রক্ষা পায় অসংখ্য নিরীহ নর-নারী। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে তার বীরত্বগাথা প্রচার হয়। জগৎজ্যোতি একা হাতে একটি এলএমজি নিয়ে দখল করে নেন জামালপুর থানা যেখানে আস্তানা গেড়েছিল স্থানীয় পাকিস্তানি হায়নাদের দোসর রাজাকাররা।
১৬ নভেম্বর, ১৯৭১। জগৎজ্যোতি জানতেন না এই দিনে তার অন্তিম অভিযান পরিচালিত হবে। জগৎজ্যোতি ও তার সঙ্গীদের লক্ষ্যস্থল ছিল বাহুবল মতান্তরে বানিয়াচং। কিন্তু লক্ষ্যস্থলে যাবার আগেই বদলপুর নামক স্থানে হানাদারদের কূটকৌশলের ফাঁদে পা দেন জগৎজ্যোতি। বদলপুরে ৩-৪ জন রাজাকার ব্যবসায়ীদের নৌকা আটক করে চাঁদা আদায় করছিল। দেখতে পেয়ে ক্ষুব্ধ জ্যোতি রাজাকারদের ধরে আনার নির্দেশ দেন।
কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের দেখেই পিছু হটতে থাকে কৌশলী রাজাকাররা। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন জগৎজ্যোতি, ভাবতেও পারেননি কী ফাঁদ তাঁর সামনে। সঙ্গী ১০-১২ জন মুক্তিযোদ্ধা আর সামান্য গোলাবারুদ নিয়ে তাড়া করেন রাজাকারদের। অদূরেই কুচক্রী পাকসেনাদের বিশাল বহর আর প্রচুর সংখ্যক গোলাবারুদ নিয়ে অপেক্ষা করছিল তার।
অজান্তেই চক্রব্যূহে প্রবেশ করেন জগৎজ্যোতি। আগে থেকে প্রস্তুত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিশাল বহরের ফাঁদে পড়ে যান জগৎজ্যোতি ও তার সহযোদ্ধারা। বর্তমানে শাল্লা উপজেলা সদর ঘুঙ্গিয়ারগাঁও থানায় পাকিস্তানি ক্যাম্প থেকে মাত্র ২০০ গজ দূরে রাজাকার আর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে ‘দাস কোম্পানি’।
রণাঙ্গনে পরিস্থিতির ভয়াবহতা চিন্তা করে এক পর্যায়ে জ্যোতি তার দলকে বাঁচানোর জন্য রিট্রিট করার নির্দেশ দিয়ে একটিমাত্র এলএমজি নিয়ে নিজে কাভারিং ফায়ার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এজন্য জ্যোতি সহযোদ্ধাদের নির্দেশ দেন জীবন বাঁচিয়ে অন্যত্র নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার। এরপর দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন মাত্র দুইজন- জ্যোতি ও ইলিয়াছ।
তারা যুদ্ধ করতে থাকেন একটানা, কিন্তু হঠাৎ সহযোদ্ধা ইলিয়াস পাঁজরে গুলিবিদ্ধ হন। জ্যোতি পিছু না হটে তার মাথার লাল পাগড়ি খুলে শক্ত করে ইলিয়াসের বুকে এবং পিঠে বেঁধে দেন, যাতে তার রক্তক্ষরণ থেমে যায়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে বিকেলে জগৎজ্যোতি দাস নতুন ম্যাগজিন লোড করে পজিশন নিয়ে শত্রুর অবস্থান দেখার জন্য মাথা উঁচু করতেই একটি বুলেট তার বুকে বিদ্ধ হয়। জগৎজ্যোতি তখন ‘আমি আর নাই, আমি গেলাম’ বলে কৈয়ারবিলের পানিতে ডুবে যান।
লোকমুখে শোনা যায়, গুলিবদ্ধ হওয়ার পরও তিনি জীবিত ছিলেন। তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় অত্যাচার করতে করতে। তার গায়ে পেরেক বিদ্ধ করে সেই ছবি খবরে ছাপানো হয়। আজমিরিগঞ্জ বাজারে নিয়ে আসা হয় তার লাশ। তখন ছিল ঈদের বাজার। শত শত লোকের সামনে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে ক্ষত-বিক্ষত করা হয় তার লাশকে।
রাজাকাররা থুতু ফেলতে থাকে তার উপর। এমনকি জগৎজ্যোতির মা-বাবাকেও ধরে আনা হয় বিভৎস লাশ দেখাতে। পরিবারে যখন স্বজন হারানোর কান্নার রোল তখন আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় জগৎজ্যোতির বাড়িতে। ভাসিয়ে দেওয়া হয় তার ক্ষত-বিক্ষত লাশ ভেড়ামোহনার জলে।
অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার তাকে সর্বোচ্চ বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। প্রথম ব্যক্তি হিসেবে জগৎজ্যোতিকে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক দেওয়ার ঘোষণা সেসময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়েছিল। অল ইন্ডিয়া রেডিওসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত হয় জগৎজ্যোতির বীরত্বগাথা।
কিন্তু স্বাধীনতার পর প্রতিশ্রুতি থেকে ফিরে আসে বাংলাদেশ সরকার। হয়তো সামরিক ব্যক্তিত্ব না হওয়ার কারণে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে তাকে ভূষিত করা হয়নি। কিন্তু জগৎজ্যোতি দাস ভাটিবাংলার সাধারণ মানুষসহ রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের কাছে শ্রেষ্ঠ বীরদের অন্যতম।
লেখক পরিচিতি: সাবেক ছাত্রনেতা ও আওয়ামী লীগ নেতা
কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না! |