একটি ভালো শেয়ালের উপকথা

গ্রামের পাশে বনে এক শেয়াল বাস করত। সে সবসময় ভালো-মন্দ খেতে চাইত। এই যেমন- হাঁসের মাংস, মুরগির মাংস, আরও ভালো ভালো খাবার।

মোহাম্মদ অংকনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Oct 2020, 08:02 AM
Updated : 17 Oct 2020, 08:02 AM

কিন্তু সে কোনো কাজ করত না। বনে কখনও খুঁজেও দেখত না শিকার আছে কি নেই। এক প্রকার অলসই ছিল শেয়ালটা। তবে সে অনেক কূট-কৌশল জানত। সে এও জানত যে বনের পাশের গ্রামে অনেক গৃহপালিত হাঁস-মুরগি থাকে। সেসব সে যদি খেতে পারত, কী যে মজা হত, এটাই ভাবত সবসময়।

কিন্তু তাতে তার বিপদ আছে, সে সেটা ঠিকই বুঝত। একবার এক শেয়াল এমন বিপদ থেকে প্রাণে বেঁচে গেছে বলেই তো সে বিষয়টা জানে। তবুও তার আগ্রহের ঘাটতি নেই। এবিষয়ে সে মোটেও অলস না।

শেয়াল যেহেতু অনেক কূট-কৌশলী, তাই সে খোঁজ নেয় কোন কোন বাড়িতে কী কী উপায়ে প্রবেশ করা যায়। এভাবেই সে গোপনে খুঁজতে খুঁজতে গ্রামের এক বাড়িতে দেখতে পায় রোজ রাতে একটা কুকুর বসে বসে বাড়ি পাহারা দেয়। কিন্তু কুকুরকে কিভাবে বশে আনা যায়, তা নিয়ে ভাবতে থাকে।

কেননা, কুকুর তাকে দেখামাত্র ঘেউ ঘেউ করবে। কামড়াতে ছুটে আসবে। কুকুর তো বাড়ি পাহারা দিতেই বসে আছে। শেয়াল ভাবতে লাগল, কুকুরকে একটু লোভ দেখালে কেমন হয়? নিশ্চয়ই সে লোভে পড়ে আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করবে না। আর একবার যদি বন্ধুত্ব হয়, তাহলে তো আর কোনো কথাই নেই। এই সুযোগে অনেক কিছু করা যাবে।

কুকুরটা রাতে বাড়ি পাহারা দিলেও দিনে রাস্তা-ঘাটে, বন-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়। এমনই একদিন শেয়াল দেখতে পায় যে কুকুরটি দুপুরের রোদে দৌড়ে কোথা থেকে যেন আসছে। শেয়াল তাকে দূর থেকে ‘বন্ধু’ বলে ডাক ছাড়ে। এতে কুকুর থেমে যায় আর ভাবে, আমাকে কে বন্ধু বলে ডাকল?

পরক্ষণে দেখে যে শেয়াল। শেয়ালের এমন বন্ধুসুলভ ডাক শুনে কুকুরের মনটা ভরে ওঠে। যাকে সে সবসময় শত্রু মনে করে, যার ভয়ে সে সারারাত মালিকের হাঁস-মুরগি পাহারা দেয়, সেই শেয়াল ‘বন্ধু’ বলে ডাক দেওয়ায় সে যেমন অবাক হয়, তেমনি খুশিও হয়। দুজন দূর থেকে কথা বলা শুরু করে।

       ‘কী হে কুকুর বন্ধু, কোথা থেকে ফিরছ?’

       ‘এই তো একটু দৌড়াদৌড়ি করছিলাম। তা তুমি দূরে কেন? কাছে আসো। তোমাকে মোটেও আমি তাড়া করব না আজ।’

       ‘ঠিক আছে, বন্ধু। আসছি আমি।’

কুকুরকে কাছে পেয়ে শেয়াল তো ভীষণ খুশি হয়। সে কুকুরের কাছে এগিয়ে যায়। বলে, ‘শোনো কুকুর, তুমি থাকো গ্রামে আর আমি বনে। দুজন দুজায়গার প্রাণী। আমাদের মধ্যে কোনো শত্রুতা থাকুক, তা আমি মোটেও চাই না। তুমি আমার বন্ধু, আমিও তোমার বন্ধু। তুমি আমার কোনো ক্ষতি করবে না, আমিও তোমার ক্ষতি করব না। তুমি আমার বনে আসবে, আমিও তোমার গ্রামে যাব।’

       ‘সবই ঠিক আছে বন্ধু, তুমি আমার গ্রামে গেলে তো সবাই তোমাকে বেঁধে রাখবে। তখন তো আমি বাঁচাতে পারব না।’

       ‘সে নিয়ে মোটেও চিন্তা কর না। আমি একটা ব্যবস্থা করে নিব। আগে বল, তুমি রোজ আমার এখানে বেড়াতে আসবে কি না?’

       ‘জি, বন্ধুত্ব যখন হল, তখন তো আসতেই হবে।’

এভাবেই শেয়াল মোটামুটি কৌশল করে কুকুরে সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। কুকুরটা একটু বোকা স্বভাবের থাকায় শেয়ালের কূট-কৌশল বুঝে উঠতে পারে না। তারপর থেকে সে রোজ শেয়ালের এখানে আসে। শেয়াল তাকে নানা দামি খাবারের নাম বলে, খাওয়াবে বলে কথাও দেয়। কুকুর তো লোভ সামলাতে পারে না। সে বলে, ‘শেয়াল বন্ধু, আমি এসব পাব কিভাবে?’

       ‘নিশ্চয়ই পাবে। তার আগে আমার প্ল্যান মত তোমাকে কাজ করতে হবে।’

       ‘কী প্ল্যান বন্ধু?’

শেয়াল কুকুরকে তার প্ল্যানের কথা কানে কানে জানায়। কুকুর লোভে পড়ে তা মেনে নেয়।

সে রাতের কথা। মালিকের বাড়ি পাহারা বাদ রেখে কুকুর শেয়ালের বনে চলে যায়। আর শেয়াল তার প্ল্যান মত কুকুরের মত সাজতে শুরু করে। কুকুরের গলা থেকে লকেটটা নিয়ে সে নিজের গলায় পরে। নিজের লেজটা কুকুরের লেজের মত করে বাকা করে। এ বিষয়ে কুকুরও বেশ সাহায্য করে। কেননা, সে আজ ভালো-মন্দ খেতে পারবে। কী যে মজা তার ভেতর কাজ করে, তা বলে বোঝানো মুশকিলই বটে।

শেয়াল প্ল্যান অনুযায়ী কুকুরের বেশ ধারণ করে কুকুরকে তার গুহায় রেখে গ্রামে কুকুরের মালিকের বাড়িতে পাহারা দিতে ছোটে। পৌঁছানোর পর সে হাঁস-মুরগির পাহারা দিতে থাকে কুকুর সেজে। রাত গভীর হতেই সে তার মিশনে নামে। খোপ খুলে হাঁস-মুরগি ধরতে থাকে।

এদিকে হাঁস-মুরগিগুলো জোরে চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকে। এই শুনে মালিকের তো ঘুম ভেঙ্গে যায় তৎক্ষণাৎ। তিনি ভাবেন, ‘কী ব্যাপার হাঁস-মুরগিগুলো এমন চিৎকার করছেন কেন? কোনো শেয়াল এল কিনা? কুকুরটা গেল কোথায়?’

এই ভেবে মালিক লাইট জ্বালিয়ে বাহিরে চলে আসেন। তা টের পেয়ে শেয়ালটা সাবধান হয়। খোপটা আটকে দিয়ে ঘুমের অভিনয় শুরু করে। দৌড়ে পালালে বিপদ হতে পারে।

বাড়ির মালিক এমন ঘটনাকে একটু আড় চোখেই দেখে। কুকুর ঘুমাচ্ছে আর সে বের হওয়া মাত্রই হাঁস-মুরগির চেঁচামেচি বন্ধ। ব্যাপারটা কী। তাই তিনি এসে কুকুরকে সজাগ করতে চান। কিন্তু সজাগ করতে গিয়ে তার চোখে কেমন যেন খটকা লাগে। কুকুরের লেজটা সোজা সোজা লাগে, চোখ দুটোও কেমন যেন জ্বলজ্বল করতে দেখায়।

কুকুরের শরীর মোটাতাজা মনে হলেও এই কুকুরটাকে মালিক ভীষণ কাবুকাবু দেখেন। পরক্ষণেই তিনি বুঝতে পারেন যে এটি তার পালিত কুকুর নয়। তবে কে? কে তা প্রমাণ করতেই মালিক জাল ফেলে কুকুরটাকে আটকে ফেলে। ওমনি শেয়াল ঘুম ভাঙ্গিয়ে ‘হুক্কিহুয়া’ বলে ডেকে ওঠে। মালিক বুঝতে পারেন, এ তো কুকুর না, আস্ত শেয়াল। তিনি একটু ভরকে যান, তার কুকুরের গলায় পরানো মালা শেয়ালের গলায় এল কিভাবে? মালিক শেয়ালকে জিজ্ঞেস করে, ‘শেয়াল, বল তো আমার কুকুরকে কোথায় আটকে রেখেছ?’

বিপদ হতে পারে ভেবে না পালিয়ে শেয়াল এখন পড়ে গেছে মহাবিপদে। এখন তাকে তো সত্য কথা বলতেই হবে। তাই সে সমস্ত ঘটনা খুলে বলে। সে যে কুকুরকে বোকা বানিয়ে তার মালিকের বাড়িতে হানা দিবে, কুকুর তো সেটা বুঝতে পারেনি। মালিক কুকুরের প্রতি রাগ দেখাতে থাকে আর ভাবতে থাকে কুকুরটা আসুক আজ তাকে মজা দেখাব। কুকুর আর শেয়ালকে বেঁধে পিঠাব।

কিন্তু রাত শেষ হয়ে আসে, কুকুর তো আসে না। সে তো শেয়ালের আশায় গুহায় বসে আছে। শেয়াল তার জন্য স্পেশাল খাবার আনবে আর সে খাবে। তারপর বাড়ি ফিরে একটা ঘুম দিবে।

তারপর সকাল হয়ে যায়। শেয়ালকে বন্দি করে মালিক রেখে দেয়। ওদিকে সকাল হয়ে যাওয়ায় শেয়ালের জন্য অপেক্ষা না করে বন থেকে বাড়িতে চলে আসে কুকুর। এসে দেখে যে শেয়ালকে বন্দি করে রেখেছে তার মালিক। এটি দেখে তো সে রীতিমত অবাক হয়ে যায়। ভয়ও পায় ভীষণ। মালিক কুকুরকে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমাকে দিলাম হাঁস-মুরগি পাহারা দিতে আর তুমি তা অবহেলা করে শেয়ালকে কুকুর সাজিয়ে পাঠালে কেন? সে যে হাঁস-মুরগি ধরে খেতে লেগেছিল। যদি খেয়ে ফেলত, তখন কী হত?’

বোকা কুকুর এবার বুঝতে পারে যে শেয়াল তাকে চরম বোকা বানিয়েছে। সে নিজে কুকুর সেজে হাঁস-মুরগি খেতে চেয়েছিল আর সেখান থেকে তাকে ভাগ দিতে চেয়েছিল। কুকুর সব বুঝে মালিককে বলে, ‘আমি না বুঝে লোভে পড়ে এমনটা করেছি ফেলেছি, আমাকে মাফ করে দিন। শাস্তি তো শেয়ালের প্রাপ্য। আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে আমারই সর্বনাশে নেমেছে।’

কুকুরের মালিক যেমন শান্ত প্রকৃতির, তেমনি একটু রুক্ষ প্রকৃতির ছিল। তিনি মোটেও কুকুরকে মাফ করতে চান না। বিষয়টা দেখে বন্দি শেয়ালের কেমন যেন খারাপ লাগতে লাগে। সে ভাবে, ‘আমার কারণে কুকুরটা আজ বিপদের মুখোমুখি হচ্ছে। আমি তো শাস্তি পাবই; কিন্তু কুকুরটা শাস্তি পেলে তো আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না।’

তাই সে মালিককে অনুরোধ করতে থাকে। বলে, ‘হুজুর, আপনার কুকুরের কোনো দোষ নেই। আমিই বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়ে ওকে বোকা বানিয়ে এমন কাজ করেছি। কুকুরকে নয়, আমাকে বেশি বেশি শাস্তি দিন।’

মালিক শেয়ালের কথা শুনে সব বুঝতে পারেন। আসলেই কুকুরের কোনো দোষ নেই। আর কুকুর এমনটা করবে তাও বিশ্বাসযোগ্য না। কুকুরের প্রতি শেয়ালের এমন সৌহার্দ্যময় আচরণ দেখে মালিক ভাবেন, ‘কুকুরকে তো মাফ করেই দিব, সাথে শেয়ালটাকে শর্তসাপেক্ষে মাফ করে দিলে কেমন হয়?’

তারপর তিনি শেয়ালকে বলেন, ‘তাহলে সব অপরাধের মূলে যেহেতু তুমি, তোমাকে কী শাস্তি দিব, বল?’

       ‘আপনি আমায় যে শাস্তি দিবেন, তা আমি মেনে নিতে প্রস্তত। কেননা, সব দোষ আমার। আমি বনে শিকার না করে বসতবাড়ির হাঁস-মুরগির প্রতি লোভ আমার।’

       ‘আমি যদি তোমাকে শাস্তি না দিয়ে তোমাকে ভালো হওয়ার সুযোগ দিই, তুমি কি ভালো হবে?’

       ‘জি, হব। এ বিষয়ে আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন।’

       ‘তাহলে আমার সঙ্গে শপথ কর- আমি শপথ করছি যে আর কোনো দিন বন থেকে গ্রামে এসে হাঁস-মুরগি চুরি করব না। বন-জঙ্গলে ঘুরে নিজের আহার সংগ্রহ করব। কাউকে বোকা বানাব না।’

মালিকের সঙ্গে শেয়ালটা শপথ করে। এবং মালিক তাকে সত্যি ছেড়ে দেন। ভালো হওয়ার সুযোগ দেন। শেয়াল তার গলা থেকে লকেট খুলে কুকুরকে ফিরিয়ে দেয়। কুকুর তার মালিকের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। শেয়ালটা ছাড়া পেয়ে বনের পথে ছোটে আর ভাবে, ‘আসলে অন্যকে বিপদে ফেলে নিজে পেটভরে খেয়ে কোনো লাভ নেই। আমাকে অলসতা ভুলে নিজের আহার নিজে খুঁজে বের করে খেতে হবে। সাধ্যে যেটুকু জোটে তা দিয়েই চলবে। অযথা লোভ করে হাঁস-মুরগি খেতে যাওয়া মোটেও আমার উচিত হবে না। আজ যদি কুকুরের মালিক আমাকে ছেড়ে না দিত, তবে কেমন হত? যদি কুকুরটাকে শাস্তি দিত, তবে কেমন হত?

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com । সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!