ছোটগল্প: কাশবনের পরি

অদ্ভুত কাণ্ডটা ঘটল তখনই যখন আমরা বিকেলে হই চই করে কাশফুল তুলছিলাম। কাশবনের গভীর থেকে কে যেন বলছে- শোনো শোনো, কাশফুল তোলার আগে আমার একটি কথা শোনো, একটু থামো বন্ধুরা।

বিএম বরকতউল্লাহ্বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Sept 2020, 06:18 AM
Updated : 3 Sept 2020, 06:18 AM

আমরা থমকে দাঁড়ালাম। সবার ভয় ভয় লাগছিল। কারণ শহর থেকে একটু দূরে নদীর পাড়ে এই কাশবন। বিশাল কাশবন ফুলে ফুলে সাদা। কাশের বনে উড়ে বেড়াচ্ছে চড়ুই ফিঙ্গে আর মুনিয়া পাখি। এরা ছটফট করে উড়ে গিয়ে ফড়িং ধরে খায়।

চেনা অচেনা নানা রঙের ফড়িং উড়ছে। কাশফুলে ছোট ছোট পোকা ছোটাছুটি করছে। বাতাসে কাশবনে ঢেউ খেলছে। আমি, রবিন আর টুনি কাশবনের ঢেউয়ের মাঝে থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

কে ডাকল? আমরা মাথা ঘুরিয়ে গোটা বন দেখলাম। নাহ্ কাউকে চোখে পড়ছে না।

রবিন আমার দিকে তাকিয়ে শুকনো মুখে বলল- আয় চলে যাই। কেমন জানি ভয় করছে আমার!

আমারও ভয় করছে। চল, তাড়াতাড়ি কতগুলো ফুল নিয়ে আমরা দৌড়ে বাসায় চলে যাই। টুনি সাহস করে বলল।

আমি বললাম, ভয়ের কী আছে? মনে হয় একটি মেয়ে কথা বলেছে। তাকে ভয় পাব কেন?

ডাক দেই মেয়েটিকে? বলল রবিন।

আমি আর রবিন হাতের তালু চোঙ বানিয়ে ঠোঁটে লাগিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগলাম- কে কথা বলেছ, আমাদের কাছে এসো। চুপ করে আছ কেন? আসলে আসো, না আসলে নাই। আমরা কাশফুল তুলে নিয়ে বাড়ি চলে যাব।

আ-স-ছি...

কথাটি যেদিক থেকে এলো, আমরা সেদিকে তাকালাম। এক বিস্ময়কর ব্যাপার! কেউ চোখ ফেরাতে পারছি না। আমরা কাশবনে আছি না স্বপ্নের জগতে আছি, বুঝতে পারছি না।

ফুটফুটে একটি মেয়ে। কাশফুলের উপর দিয়ে উড়ে উড়ে আসছে। তার কাশফুলের দুটি ডানা। পোশাকও কাশফুলের। মাথায় কাশফুলের মুকুট। আমাদের দিকে পাখির মতো উড়ে আসছে সে। আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি; তাকে দেখে ভয় পাওয়ার কথা একেবারে ভুলে গিয়েছি।

মেয়েটি আমাদের সামনে এসে দপ্ করে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, আমি কাশপরি, চিনেছ আমাকে?

তুমি কাশপরি? আমরা জীবনেও কাশপরি দেখিনি। বলল টুনি।

পরিটি এতই সুন্দরী আর হাসিখুশি যে, আমরা ফুল তোলার কথা ভুলে গিয়ে পরির দিকে তাকিয়ে আছি। কি সুন্দর ফুটফুটে আর ধবধবে সাদা চটপটে কাশপরি!

আমার ছোট বোন টুনি। তাকেও কাশফুলের পাখা, পোশাক আর মুকুট পরালে এমনই লাগবে। মনে মনে আমি এমনই ভাবছি আর ছোট বোনকে কাশপরি বানিয়ে কাশবনে উড়ছি।

দুই.

আচ্ছা, কাশপরি, তুমি এখানে কী কর? জানতে চাইল রবিন।

বারে, আমি তো কাশপরি। কাশবনে থাকি। শরৎকাল এলেই আমরা চলে আসি কাশবনে। আর কাশবনই আমাদের ঘরবাড়ি।

তুমি কি একা একা থাক এই বনে, ভয় করে না তোমার? জানতে চাইল টুনি।

নাহ্, একা থাকি না, আরও কাশপরি আছে বনে। মোটেও ভয় করে না আমাদের।

কাশপরি বলতে থাকে- অনেক আগে এই বনের মাঝখান দিয়ে পায়েচলা মেঠো পথ ছিল। শরৎকালে অনেক মানুষ এ পথ দিয়ে হেঁটে যেতো। তারা কত কথা বলত। আমাদের খুব ভাল লাগত। যখন এ পথ ধরে চার বেহারার পালকি চড়ে নতুন বউ যেতো তখন আমরা অনেক মজা করতাম। জোছনা রাতে বেহারারা ‘ওহোমনারে ওহোমনা’ ‘ওহোমনারে ওহোমনা’ শব্দ করে পালকি নিয়ে যেতো। তাদের এই শব্দের এমনই তাল ছিল যে, মনে হতো তাদের কথার সাথে তাল দিয়ে কাশবনে ঢেউ খেলত। পালকিতে নতুন বউ নিয়ে যাওয়ার সময় আমরা বউকে ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে দিতাম। ওমনি কনের সাথের লোকেরা আনন্দে বলে উঠত, বউয়ের ভাগ্য অনেক ভাল। কাশপরিরা ফুল ছিটিয়ে দিয়েছে। এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে, বলো!

আমি বললাম, ভাদ্র-আশ্বিন এই দুই মাস শরৎ। কাশফুল তো শরৎকালের ফুল। তারপর তোমরা কোথায় থাক পরি?

বাংলাদেশের শরৎকাল ফুরিয়ে গেলে অন্য কোন দেশে শরৎকাল শুরু হয়। আমরা তখন সেই দেশে চলে যাই।

এ কথা শুনে টুনি পরির হাত শক্ত করে ধরে বলল- না পরি, তোমাকে আমরা আর কোথাও যেতে দেব না। তুমি থাকবে আমাদের সাথে। আমরা তোমার গল্প শুনব, তোমাকে বই পড়াব, স্কুলে নিয়ে যাব। অনেক মজা হবে।

পরিটি টুনিকে আদর করতে করতে বলল, চলো তোমাদের কাশবন দেখাই।

পরিটা আমাদের পুরো কাশবন দেখাল। খুব খাতির হয়ে গেল পরিটার সাথে।

সত্যিই তোমরা আমার ভাল বন্ধু। কিন্তু আমরা কাশবন ছাড়া থাকতে পারি না। তোমাদের কথা আমার মনে থাকবে। শরৎকাল এলেই তোমরা চলে আসবে এই বনে। এসেই ‘ছিছিলা’ বলে ডাক দিবে। আমি যেখানেই থাকি উড়ে চলে আসব তোমাদের কাছে।

আমরা পরের বছর সেই কাশবন দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানে আর কাশবন নেই। গড়ে উঠেছে নতুন শহর। কাশবন আর কাশপরি ছিছিলার জন্য আমাদের খুব কান্না পাচ্ছিল। পরিটা বলেছিল- আমরা কাশবন ছাড়া বাঁচতে পারি না। তবুও আমরা কয়েক বার ‘ছিছিলা’ বলে ডাক দিলাম। কোনো সাড়া পেলাম না। সেই পরিটা এখন কোথায় কেমন আছে আমার জানতে ইচ্ছে করে খুব।

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!