বাপ-দাদার স্যার, প্রধানমন্ত্রীর স্যার, আমারও স্যার

এই পুটু কী করছিলি?

আনিসুর রহমানআনিসুর রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 May 2020, 06:23 PM
Updated : 28 May 2020, 06:23 PM

কী আর করব? মনটা খুব খারাপ। এই দুষ্টু করোনাভাইরাস এসে একটার পর একটা শয়তানি করতেছে। স্কুলে যাওয়া বন্ধ হলো। খেলতে যেতে পারি না। বেড়াতে যেতে পারি না। ঈদের আনন্দও হলো না।

এর মধ্যে আরো বড় একটা খারাপ খবর। আমার জীবনে এত বড় খারাপ খবর আর পাইনি। সব সর্বনাশের মূল করোনাভাইরাস। ভাইরাসটাকে যদি হাতের কাছে পাইতাম পলিথিনে ভরে ময়লার বাক্সে ফেলে দিতাম।

এই পুটু তোকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম কী করছিস, আর তুই তোর মন খারাপের কথা বলে যাচ্ছিস তো যাচ্ছিস। মন খারাপ কেন সেটা বলবি তো!

তাহলে শোন টিয়া, তুই কি শুনিসনি আনিস স্যার মারা গেছেন?

শুনবো না কেন?

এটা আবার কে না শুনেছে? এই খবর তো সব জায়গায় সবার মুখে। ও বুঝেছি এই জন্যই তোর মন খারাপ!

এই জন্যই মন খারাপ। আমার খুব ইচ্ছে ছিল বাবার সঙ্গে ফুল নিয়ে দেখতে যাব। দুষ্টু করোনাভাইরাসের জন্য সেটাও হলো না।

আর বলিস না। করোনাভাইরাসের কারণে শিশু অ্যাকাডেমির চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতাও হলো না, ছড়া আর গানের ক্লাশগুলোও বন্ধ। তুই মন খারাপ করে কতক্ষণ থাকবি? কিছু একটা করে মন ভাল করে ফেল।

আচ্ছা আমি কি আমাদের বাসার ড্রাইভার আঙ্কেলকে দিয়ে তোর জন্য চকলেট পাঠিয়ে দিব?

নারে টিয়া। আমার জন্য কিচ্ছু পাঠাতে হবে না। যদি পারিস তোদের আশপাশে কারো খাবারের কষ্ট থাকলে তাদেরকে খাবার দিস।

তা দিবনি। কিন্তু তোর মন ভাল করবি কীভাবে?

জানি না। মাথায় একটা বুদ্ধি আসছে, আনিস স্যারের একটা ছবি আঁকব।

তাতে মন ভাল হবে কিনা জানি না। ছবিটা এঁকে বাবাকে বলব একটা পত্রিকায় পাঠিয়ে দিতে। কিন্তু তাতেই বা কী হবে? আনিস স্যার তো আর জানবেনও না, দেখবেনও না।

পুটু, মন খারাপ করিস না। উনি দেখতেও পারেন। আমি দাদীর কাছে শুনেছি, মানুষ মরে গেলেও তাদের আত্মা নাকি আমাদের আশপাশেই থাকে। আবার কেউ বলে মানুষ মরে আকাশে উঠে যায়। তাহলে তো আনিস স্যার তোর ছবি দেখতেও পারেন।

যাক টিয়া, একটা উপায় পাওয়া গেল। ছবিটা এঁকে ফেলি। আনিস স্যার যত তাড়াতাড়ি দেখবেন সেটাই ভাল।

আচ্ছা টিয়া, একটা কথা বলত, মানুষ মরে তো বেহেস্তে বা দোজখে যায়।

আমার ধারণা, আনিস স্যার নিশ্চিত বেহেস্তেই যাবেন।

আচ্ছা বেহেস্ত আর দোজখ দুটোই কি আকাশে? দুটোই কি পাশাপাশি?

এরকম প্রশ্ন তো আমারও। আচ্ছা গুগলে খোঁজ করে দেখিস তো?

তা দেখবনি। তুই তোর দাদীকে জিজ্ঞেস করিস তো কী বলে।

তা করবনি। তার আগে তুই একটা কথা বল তো, আনিস স্যার কি তোরও স্যার?

হা রে টিয়া, উনি আমার দাদার স্যার, আমার বাবার স্যার, আমার মায়ের স্যার, এমনকি আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও স্যার। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন, তাদের স্যার।

কিন্তু তিনি তো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার ছিলেন, তোর স্যার কীভাবে?

তুই কি তাঁর কাছে পড়েছিস?

তাঁর কাছে সবাইকে পড়তে হবে কেন? আমি তাঁর কাছে না পড়লেও সঙ্গে বসে গল্প করেছি অনেক।

তাহলে স্যার বলছিস কেন? দাদু বললেই পারিস।

আনিস স্যার আমাকে বলেছিলেন, পুটু তুমি আমাকে দাদু বললেই পার। আমি তোমার দাদু। আমি বলেছি, আমার দাদু তোমাকে স্যার বলে; বাবা তোমাকে স্যার বলে। মা তোমাকে স্যার বলে। আমিও স্যার বলব, ‘আনিস স্যার’। সেই থেকে তিনি আমারও ‘আনিস স্যার’।

হা রে পুটু, তাহলে তো তিনি আমারও ‘আনিস স্যার’। আচ্ছা আনিস স্যার সম্পর্কে তুই কি কি জানিস? উনি এত বড় হলেন কীভাবে?

হা রে টিয়া, তুই যে কি বলিস। তিনি বড় হলেন কীভাবে? তিনি তো বড়ই ছিলেন। তাঁর জন্ম পশ্চিমবঙ্গে ১৯৩৭ সালে। ব্রিটিশরা যখন চলে গেলো এই দেশ ছেড়ে উনি তাঁর বাবা মায়ের সঙ্গে ঢাকায় চলে এলেন।

তাঁর পুরো নাম আবু তৈয়ব মুহম্মদ আনিসুজ্জামান। ১১ বছর বয়সে ভাষা আন্দোলনে অংশ নিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে পড়াশোনা করলেন। পিএইচডি করলেন। দেশে বিদেশের নানা বই পড়লেন। চট্টগ্রাম আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেন, গবেষণা করলেন, অনেক বই লিখলেন। স্যারের কিছু গবেষণার বই হলো ‘স্বরূপের সন্ধানে’, ‘আমার একাত্তর’, ‘মুক্তিযুদ্ধ এবং তারপর’, ‘আমার চোখে’, ‘বিপুলা পৃথিবী’ ও ‘কাল নিরবধি’ ইত্যাদি। এছাড়া রয়েছে বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদ, একক ও যৌথ সম্পাদিত প্রচুর বই।

বাংলাদেশের সংবিধানের বাংলা ভাষারূপ পর্যালোচনা কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন আনিসুজ্জামান স্যার, কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনেরও সদস্য ছিলেন। আমার মা আমাকে এসব বলেছেন অনেক আগেই। আমার মা তো তাঁর ক্লাস করেছে। আমার মায়ের বিয়েটা আমার বাবার সঙ্গে তিনিই ঠিক করেছেন। যখন ছোট ছিলাম স্যারকে আমি বলেছিলাম, স্যার একটা কাজ তুমি ঠিক করনি। তুমি যদি আমার মায়ের সঙ্গে বাবার বিয়েটা আরো পরে ঠিক করতে তাহলে আমি বিয়ের দাওয়াত খেতে পারতাম।

তখন আনিস স্যার কী বললেন?

কী আর বলবেন? বললেন ঠিক বলেছ।

তিনি যখন নানা পুরস্কার পেতেন; এই ধর, ভারত সরকারের পদ্মভূষণ, বাংলাদেশের একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক, তারপর জাতীয় অধ্যাপক, বাংলা অ্যাকাডেমির সভাপতি, প্রতিবারই বাবা আর মায়ের সঙ্গে ফুল নিয়ে আমি তাঁর বাসায় গিয়েছি। তিনি আমাকে কাছে নিয়ে কখনও মজার মজার বই দিতেন। আবার সুন্দর ছবি, কখনও নানা দেশ থেকে আনা চিঠিপত্রের খামের সুন্দর সুন্দর ডাকটিকেট দিতেন।

তিনি বলতেন, পুটু একদিন তুমিও কিন্তু এসব পুরস্কার পাবে। তখন কিন্তু আমাদের সবাইকে বসুন্ধরায় ছবি দেখাতে হবে। আমি বলেছিলাম, আচ্ছা স্যার, তুমি কি সত্যজিৎ রায়কে চিনতে? তিনি বেঁচে থাকলে তোমাকে বলতাম তাঁর কাছে নিয়ে যেতে। আমি ছবি বানাতে চাই।

স্যার বলেছিলেন, সত্যজিৎ রায় তো নেই। তাঁর ছেলে আছে, নাম সন্দীপ রায়, সেও ছবি বানায়। আমি তাঁর কাছে তোমাকে নিয়ে যাব। আর স্বপ্নে বা মৃত্যুর পর যদি সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে দেখা হয় তাহলে তোমার কথা বলব। সেই আমার ‘আনিস স্যার’ আর নেই, গত ১৪ মে ঢাকার একটি হাসপাতালে ৮৩ বছর বয়সে মারা যান তিনি।

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি,সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!