সুমাইয়া বরকতউল্লাহর গল্প: ঘুড়ির লড়াই

এ আবার কেমন আবদার! এটা তো ছেলেদের খেলা, তুমি ঘুড়ি উড়াতে চাও কোন শখে? ছাদে উঠে ঘুড়ি উড়াবার বায়না করতেই মা এমন করে কথাগুলো শোনালেন। আমি অবাক হয়ে ভাবছি, ঘুড়ি উড়ানোর মধ্যে ছেলে আর মেয়ে বলে কি কোনো কথা থাকতে পারে?

সুমাইয়া বরকতউল্লাহ্বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 May 2020, 06:46 AM
Updated : 28 May 2020, 07:33 AM

ঘুড়ির আবার জাত কী? আমার আগ্রহ আরও বেড়ে গেলো। ঘুড়ি আমি ওড়াবোই। ছাদের উপর গিয়ে ঘুড়ি উড়ায়ে দিলাম। আশপাশের ছাদে ছেলেরা ঘুড়ি উড়াচ্ছে। ঘুড়িতে বিকেলের আকাশটা রঙ্গিন হয়ে গেল। লাটাই ঘুরাতে ঘুরাতে ছাদের এপাশ থেকে ওপাশে ছোটাছুটি করছি। হই হই কাণ্ড। বেজায় আনন্দ করছি আমরা।

পাশের ছাদের ছেলেগুলো বেজায় দুষ্টু, গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে চায়। ওরা ওদের ঘুড়ি লেলিয়ে দিল আমার ঘুড়ির পেছনে। তাদের ঘুড়িগুলো ডাকাতের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ঘুড়ির ওপর। ওরা নানা কায়দা করে সুতা প্যাঁচিয়ে আমার ঘুড়িটাকে আটকে ফেলল। আমার ঘুড়ির অবস্থা পুলিশের হাতে ধরা পড়া আসামীর মতো। আমি অনুরোধ করে বললাম সুতার প্যাঁচ খুলে দিতে। ওরা প্যাঁচ খুলবে তো দূরের কথা; নেচে গেয়ে আনন্দ করতে লাগল।

ওরা শিস দিয়ে চোখ পাকিয়ে আমার ঘুড়িটাকে টেনে নিল হাতের মুঠোয়। আমার ঘুড়িটা হাতে পেয়ে ওরা রীতিমতো জেরা করতে লাগল। মনে হলো আমার ঘুড়িটা আকাশে উড়ে বিরাট অপরাধ করেছে। একেকজন একেক ধরনের কথা বলছে। সব কথাই আমি শুনছি। আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেল।

ওরা আঙুল খাড়া করে ধমকিয়ে আমার ঘুড়িকে বলছে, তোর এত্ত বড় সাহস, আমাদের সঙ্গে টেক্কা মারস? এই আকাশে শুধু আমাদের ঘুড়িই উড়বে। কোনো মেয়েঘুড়ি এখানে উড়তে পারবে না। যদি ওড়ে তো বুঝতেই পারছিস তোর কপালে কী জুটবে। এখন নিয়ে এলাম কানে ধরে এরপর নিয়ে আসব অ্যারেস্ট করে। তারপর বন্দি করে রাখব ওই কবুতরের খোপে। তখন তুই কবুতরের ল্যাদার সঙ্গে থাকবি আর বসে বসে ল্যাদা খাবি। বুঝলি মেয়েঘুড়ি, মনে থাকবে আমাদের কথাগুলি? তবে তোকে আজ আটকে রাখব না। তোর গায়ে আমাদের কথাগুলো লিখে তোর মালিকের কাছে পাঠিয়ে দেব। সে যেন জীবনেও ঘুড়ি উড়াবার সাহস না করে, বুঝলি? যা এবার।

ওরা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ঘুড়িটা ছুড়ে মারল আমাদের ছাদে। আমি মন খারাপ করে ঘুড়িটা হাতে নিলাম। ঘুড়ির গায়ে ওরা যা লিখেছে তা এখানে লিখতে পারছি না। রাগে আমার শরীর কাঁপতে লাগল। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, আমি যদি এই ফাজিল ছেলেদের বিচার না করতে পারি তো আমার নাম টুইংকেল না।

দুই.

কীভাবে এদের বিচার করা যায়! এ নিয়ে খুব ভাবতে লাগলাম আমি। হঠাৎ ছোটমামার কথা মনে পড়ে গেল। আমি পেয়ে গেছি, পেয়ে গেছি বলে লাফিয়ে উঠলাম। মামা ছিল ঘুড়িপোকা। এলাকায় ঘুড়িবাজ হিসেবে মামার বেজায় নাম ডাক ছিল। মামাকে ফোন দিলাম। মামা, মামা তাড়াতাড়ি আসো।

কিরে বিপদে আছিস নাকি, কী হয়েছে বল তো।

ভীষণ বিপদ, তুমি তাড়াতাড়ি আসো।

মামা ব্যস্ত হয়ে বলল, আরে আগে বল না কী হয়েছে?

মামা বিষয়টা এমন যে এখন বলা যাবে না। আগে বাসায় চলে আসো। এ কথা বলেই রিসিভার রেখে দিলাম।

সন্ধ্যায়ই মামা এসে হাজির। বাসায় এমন কী ঘটেছে যে আমাকে আজই আসতে হলো! বল।

সব কথা খুলে বললাম মামাকে। মনে হলো মামা খুব মজা পেলেন। বললেন, এটা কোনো ব্যাপারই না। আমি যে কত বড়ো ঘুড়িপোকা ছিলাম সেটা তো জানিস।

খুব জানি আর জানি বলেই তোমাকে খবর দিলাম মামা। মামা শোনো, ছেলেরা সেদিন যে কী ব্যবহারটা করেছে যদি দেখতে! তাড়াতাড়ি এর সমাধান দাও। রাগে আমার শরীর কামড়াচ্ছে।

নো চিন্তা। এখন চুপ থাক।

আমি চুপ থাকতে পারছি না মামা। তুমি কীভাবে কী করবে না বলা পর্যন্ত আমি স্থির থাকতে পারব না।

শোন, আমি ঘুড়ির মাথায় ছোট্ট একটা টুপি পরিয়ে দেবো। দুই ইঞ্চির মতো বড় টুপি। আর তোকে এমন বিদ্যা শিখিয়ে দেবো যে, তোর ঘুড়িটা খুঁজে খুঁজে ছেলেদের ঘুড়ি বের করবে আর একটা একটা...

উফ্ মামা তারপর!

আর কী করব জানিস? এদিকে আয় কানে কানে বলি। কেউ শুনলেই কেরামতি শেষ! মামা আমার কানে কানে ফিসফিস করে বলল, কাচের গুঁড়ো আঠায় মেখে ঘুড়ির সুতোয় লাগিয়ে দেব।

বলো কি মামা! তারপর কী হবে!

হাহাহা, খেলা তো তখনই শুরু হয়ে যাবে। ওরা তোর ঘুড়িকে সুতোয় প্যাঁচাতে চাইলেই খাবে রাম ধরা। রহস্যময় টুপি পরা ঘুড়ি আকাশে উড়বে পনপন করে। আর তারই নিচে থাকবে কাচমাখা ধারালো সুতো। তোর ঘুড়িটা শক্রুর ঘুড়ি দেখামাত্র গোত্তা খেয়ে এক গুঁতোতে ওদের ঘুড়ির বুক ফেঁড়ে দিবে। তারপর ডানে বামে ছোটাছুটি করবে। আর সুতোয় ঘষা লাগার সঙ্গে সঙ্গে ওদের ঘুড়ির সুতো পটাপট কেটে যাবে। আকাশ থেকে সুতাকাটা পেট ফাঁড়া ঘুড়িগুলো শুকনো পাতার মতো হাওয়ায় ভাসবে। তখন দেখবি মজা।

মামা আমাকে হাতে-কলমে অনেক টেকনিক শিখিয়ে দিলেন। আমি ওই বজ্জাতগুলোর ডাকাত ঘুড়ি হাতের কাছে পেয়ে কীভাবে নাস্তানাবুদ করব সেটা ভেবে আনন্দে ছটফট করতে লাগলাম।

তিন.

পরের দিন ছাদে গেলাম বীরের মতো হেঁটে। পাশের ছাদের ছেলেগুলো ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। আমাকে দেখেই ওরা রিরি করে উঠল। টিটকারি আর তিরষ্কার করে খুব মজা করছে আর ট্যারাচোখে তাকিয়ে আমাকে ও আমার ঘুড়িকে উপহাস করছে। আজ ওদের উপহাসে আমার মন একটুও খারাপ হচ্ছে না। বরং ভাল লাগছে। কারণ একটু পরেই না মজাটা দেখাবো আমি!

চার.

আজকের দিনটা সত্যিই অন্যরকম। আমি ঘুড়িটা সামনের দিকে ছুড়ে মারলাম। তারপর লাটাই ঘুড়িয়ে সুতো টেনে ঘুড়িটা আকাশে উড়িয়ে দিলাম। আকাশে আমার ঘুড়ি উড়ছে। দুষ্টু ছেলেরা হই হই রই রই করতে লাগল। আর ওদের ঘুড়ি লেলিয়ে দিল আমার ঘুড়ির দিকে। ওদের ঘুড়িগুলি ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল আমার ঘুড়ির ওপর। একটা ঘুড়ি ডাকাতের মতো আসতেই মামার শেখানো টেকনিকটা কাজে লাগালাম। বাহ আমার ঘুড়িটা মাথা কাত করে এক গুঁতুতে ডাকাত ঘুড়িটার পেট ফেঁড়ে দিল। কাপড় ছেঁড়ার মতো একটা শব্দ হলো। তারপর পেট ফাঁড়া ঘুড়িটা দুর্বল হয়ে পড়ল গিয়ে একটি নারকেল গাছের ডালে।

ছেলেদের মুখ কালো হয়ে গেল। রেগে আগুন হয়ে আমাকে বলল, কাজটা ভাল করোনি টুইংকেল। এর প্রতিশোধ আমরা নেব। তুমি প্রস্তুত থেকো।

এরপরই ওরা ফিস ফিস করে পরামর্শ করতে লাগল। মনে হয় আমার ঘুড়ির বারোটা বাজাবে এখনই! আমিও প্রস্তুত হয়ে আছি। একজন বলল, আমাদের ঘুড়ির বুক ফেঁড়েছ; এখন তোমার ঘুড়ির নাম নিশানা থাকবে না, দেখো কী করি।

আমি ঠোঁট বাঁকিয়ে বললাম, উড়াও ঘুড়ি, দেখি কত বড় বাহাদুর।

আমার কথা শুনে ওরা রাগে গজর গজর করতে লাগল।

পাঁচ.

পনপন করে ঘুড়ি উড়ছে। তারা নানা কৌশল করছে আমার ঘুড়িটাকে আটকানোর জন্যে। তারা জানে না আমার লাটাইয়ের খেলায় ঘুড়ি এখন আমার কথায় চলে। আমার ঘুড়ির কাছাকাছি আরেকটা ঘুড়ি আসতেই কায়দা করে প্যাঁচ লাগিয়ে একটা টান মেরে দিলাম সুতো কেটে। এমন করে পটাপট কয়েকটা ঘুড়ির বুক ফেঁড়ে ও সুতো কেটে দিলাম।

আহাহা! ছেলেদের ঘুড়িগুলো হেলেদুলে টা টা বাই বাই করতে করতে উল্টেপুল্টে ভেসে যাচ্ছে দূরে বহু দূরে। ওরা অবাক হয়ে হা করে তাকিয়ে আছে সুতোছেঁড়া বুক ফাঁড়া ঘুড়ির দিকে। শুকনো মুখে তাকিয়ে রইল ছিন্ন ঘুড়ির দিকে। আকাশে একটি ঘুড়িই উড়ছে। আমি বাহাদুরি করে বললাম, এমন কেউ আছে যে আমার ঘুড়ির সঙ্গে লড়াই করবে এবং ঘুড়ির টা টা বাই বাই করে চলে যাওয়ার দৃশ্য দেখবে। আছে কেউ, আছে?

ছেলেরা কালো মুখে একজন আরেকজনের দিকে তাকালো। পিকুল লিমনকে আস্তে করে বলল, ভাই আমার মনে হয় এই মেয়ের ঘুড়িতে কোনো রহস্য আছে। নইলে কার এমন সাধ্যি যে আমাদের ঘুড়িগুলোকে এভাবে নাস্তানাবুদ করে! কারও মুখে রা সরল না। সবাই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

ওরা ধীরে ধীরে আকাশের দিকে তাকালো। দেখল আকাশে একটিই ঘুড়ি বীরের মতো উড়ছে যার লাটাই টুইংকেলের হাতে।

লেখক পরিচিতি: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত সুমাইয়া লেখাপড়ার পাশাপাশি সাহিত্যচর্চা করছেন। চারবার জাতিসংঘের ‘মীনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড’ সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পেয়েছেন পুরস্কার ও সংবর্ধনা। প্রকাশিত বই ‘ছোটো আপুর বিয়ে’, ‘দুই বন্ধু ও মেকাও পাখির ভালোবাসা’, ‘ভূতের পেটে টুনির বাসা’, ‘দুই টুকরো ভূত’, ‘ছড়ার বাড়ি যাই যাই’, ‘পাঁচটি পুরস্কারপ্রাপ্ত গল্প’, ‘শিয়াল যেভাবে রাজা হয়েছিল’, ‘পরিবাবু ও একুট কাঠগাছ’, ‘হাতির মেয়ে বুবুন ও অন্যান্য গল্প’।

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি,সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!