বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর কার্যালয়ে বসে কচি-কাঁচার মেলার খুদে শিল্পীদের আঁকা মুক্তিযুদ্ধের ছবি দেখছেন উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে। ছবির ডানে বঙ্গবন্ধুর কাঁধ ঘেঁষে দাঁড়ানো বালকটির নাম লুৎফর রহমান রিটন। ছবিটি ১৯৭২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ছাপা হয়েছিলো দেশের সবক'টি বাংলা ও ইংরেজি দৈনিকের প্রথম অথবা শেষের পাতায়।

লুৎফর রহমানরিটন, যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Dec 2019, 09:52 AM
Updated : 18 Dec 2019, 09:52 AM

যেভাবে শুরু

বাকাট্টা হয়ে যাওয়া একটা মেজেন্টা রঙ ঘুড়ির পেছনে ছুটতে গিয়ে ওয়ারির হেয়ার স্ট্রিট ও র‍্যাংকিন স্ট্রিট ইন্টারসেকশনের কাছে দাদাভাইয়ের হাতে ধরা পরার পর দাদাভাই আমাকে সিলভারডেল কিন্ডারগার্টেন স্কুলের ভেতরে একটা ছবি আঁকার ক্লাশে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিয়েছিলেন। নতুন একজন শিক্ষার্থী হিশেবে। আমার বয়েসী অনেকগুলো ছেলেমেয়ে ওখানে ছবি আঁকছিলো।

ক্লাশে শিক্ষক হিশেবে পেলাম হরিদাশ বর্মনকে। দাদাভাই বললেন- বর্মন বাবু, আপনার জন্যে নতুন একটা ছাত্র নিয়ে এলাম। হরিদাশ বর্মন স্যার খুব আদর করে আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন কয়েকটা তুলি আর বড় একটা কার্টিজ পেপার। ক্লিপ আঁটা একটা বোর্ডও দিলেন। আর দিলেন চ্যাপ্টা একটা শুভ্র থালা।

থালায় নির্দিষ্ট একটা গ্যাপে গ্যাপে প্যালিকেনের ঝকঝকে কৌটো থেকে তুলে দিলেন কিছু লাল, নীল, হলুদ, শাদা আর কালো রঙ। শুরু হলো আমার ছবি আঁকা। কচি-কাঁচার মেলার ছবি আঁকার ক্লাশ ‘শিল্পবিতান’ এর নিয়মিত ছাত্র হয়ে উঠলাম আমি। সময়টা ১৯৭২।

বাহত্তুরের ফেব্রুয়ারির এক বিকেলে দাদাভাই আমাদের ক্লাশে এসে বললেন-তোমাদের সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের ছবি আঁকতে হবে। একাত্তরের ছবি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনির গণহত্যার ছবি। খানসেনা আর ওদের দোসরদের নির্যাতন, নিপীড়ন, অগ্নিকাণ্ড, মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াই ও প্রতিরোধের ছবি।

মহাউৎসাহে আমরা লেগে পড়লাম মুক্তিযুদ্ধের ছবি আঁকায়। কী বিপুল উদ্যম আমাদের! কতো ছবি যে আঁকলাম আমরা! হরিদাশ স্যার আমাকে উৎসাহ দেন। আমাকে শিখিয়ে দেন রঙের সঙ্গে রঙ মিশিয়ে নতুন একটা রঙ তৈরির তড়িৎ পদ্ধতি।

আমার জানা হয়ে যায়- লালের সঙ্গে হলুদ মেশালেই কমলা রঙের আবির্ভাব ঘটে। নীলের সঙ্গে হলুদ মেশালে সবুজ কলাপাতা রঙ। লালের সঙ্গে শাদা মেশালে গোলাপি। শাদার সঙ্গে কালো মেশালে ধূসর। কালোর সঙ্গে লাল মেশালে চকোলেট। এবং লাল আর নীল মেশালে বেগুনি। অপরূপ ঝলমলে বর্ণাঢ্য এক পৃথিবীর সন্ধান পেয়ে গেলাম আমি।

দাদাভাইয়ের নির্দেশ অনুযায়ী একের পর আঁকলাম মুক্তিযুদ্ধের ছবি।

আমাদের আঁকা ছবিগুলো বড় একটা প্যাকেটে ভর্তি করে দাদাভাই এক সন্ধ্যায় (২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২) আমাদের নিয়ে গেলেন গণভবনে, বঙ্গবন্ধুর কাছে। সেই প্রথম বঙ্গবন্ধুকে আমি দেখলাম একদম কাছ থেকে, যাকে বলে ছুঁয়ে দেয়া দূরত্বে। খুব মনোযোগ দিয়ে আমাদের আঁকা ছবিগুলো দেখলেন বঙ্গবন্ধু। কোন্ ছবিটা কে এঁকেছে দাদাভাই সেটা দেখিয়ে দিচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধুকে।

আমার আঁকা একটা ছবি দেখে বঙ্গবন্ধু খুব অবাক হবার মতো ভঙ্গি করে প্রশ্ন করলেন- ওওও এটা তুমি এঁকেছো!

সগর্বে মাথা দোলালাম আমি- হ্যাঁ আমিই তো আঁকলাম। এই যে ভয়ংকর পাকিস্তানি মিলিটারিরা গ্রামের একটা বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে! একজন মিলিটারি পরিবারের বাবাটিকে গুলি করে মেরে ফেলেছে, উঠোনে বাবার লাশ। একজন মিলিটারি যুবক ভাইটিকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারছে! ছোট্ট একটা কোলের শিশুকে রাইফেলের ডগায় বেয়নেটে গেঁথে আকাশের দিকে উঁচু করে তুলে ধরেছে একজন মিলিটারি।

একজন মিলিটারির পা জড়িয়ে মা কাঁদছে। বোনটিকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে একজন মিলিটারি। বোনটির গায়ের শাড়ি অর্ধেক খুলে গেছে, বাবার রক্তে বোনটির শাদারঙের শাড়িটার কিছু অংশ লাল হয়ে গেছে...।

ছেলেবেলা থেকেই খুব চটপটে আর ছটফটে ছিলাম আমি। বড়দের সঙ্গে কথা বলতে একটুও ভয় পেতাম না। ভয় পাইনি বঙ্গবন্ধুকেও। আর বঙ্গবন্ধু আমার সঙ্গে এমন আন্তরিকতা মিশিয়ে কথা বলছিলেন যে আমার মনে হচ্ছিলো তিনি আমাকে চেনেন। এই প্রথম আমাদের দেখা হচ্ছে না। এর আগেও দেখা হয়েছে বহুবার, এতোটাই পরিচিত আমি তাঁর কাছে। সুতরাং তাঁকে ভয় পাবো কেনো?

রাতে ঘটলো বিশাল ঘটনা। বিটিভির নিউজে আমাদের দেখালো! শাদাকালো টিভি তখন। দাদাভাই ছাড়াও আমাদের সঙ্গে ছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, শিল্পী হাশেম খান এবং ডক্টর আবদুল্লাহ আলমুতী শরফুদ্দিন।

পরদিন সবকটা দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছিলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে একদল খুদে আঁকিয়ের ছবি, যারা একাত্তরের গণহত্যার ছবি এঁকেছে। মুক্তিযুদ্ধের ছবি এঁকেছে।

আইডিয়াটা ছিলো শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের। মাঝে মধ্যেই কচি-কাঁচার মেলার ছবি আঁকার ক্লাশে আসতেন তিনি। প্রথমে র‍্যাংকিন স্ট্রিট সিলভারডেল কিন্ডারগার্টেনের ক্যাম্পাসে, পরে জয়কালী মন্দির রোডে কেন্দ্রীয় মেলার ছবি আঁকার ক্লাশে। ইজেলে পিসবোর্ডের ক্লিপে কার্টিজ পেপার সাঁটিয়ে ছবি আঁকতাম আমরা সারিবদ্ধ হয়ে।

কতোদিন শিল্পাচার্য আমার স্কেচ ঠিক করে দিয়েছেন- এইভাবে না, এইভাবে আঁকো। কতোদিন ওয়াটার কালারে জল মেশানোর পদ্ধতির পাশাপাশি তার প্রয়োগও দেখিয়ে দিয়েছেন- তুলিটা এইভাবে ধরবা, তারপর এম্‌নে রঙ মিশাইবা, তারপর এইভাবে চালাইবা তুলি...। ময়মনসিংহের আঞ্চলিক টানে কথা বলতে খুবই স্বাচ্ছন্দবোধ করতেন তিনি। তো, সেই শিল্পাচার্যই চাইছিলেন আমরা শিশুকিশোররা যেনো মুক্তিযুদ্ধের ছবি আঁকি। শিল্পাচার্যের পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের আঁকা ছবি থেকে তিনশ ছবি বাছাই করা হয়েছিলো।

আমাদের আঁকা মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলোর একটা প্রদর্শনীও হয়েছিলো জয়কালী মন্দির মেলা ভবনেই। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ সেই প্রদর্শনীটি উদ্বোধন করেছিলেন বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক তাজউদ্দীন আহমদ। আমাদের আঁকা তিনশ ছবি থেকে সত্তরটি ছবি বাছাই করেছিলেন শিল্পাচার্য।

সেই ৭০টি ছবি নিয়েই আমরা গিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর কাছে। শিল্পাচার্য বিদেশ সফরে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ করেই তাঁর মাথায় আইডিয়াটা এসেছিলো। তিনি সঙ্গে করে ছোটদের আঁকা কিছু মুক্তিযুদ্ধের ছবি নিয়ে যেতে চান। তিনি চান বিশ্ববাসী দেখুক শিশুদের চোখে একাত্তরের ভয়াবহতা। নৃশংসতা। বঙ্গবন্ধুকে তিনি তাঁর পরিকল্পনার কথাটা বলেছিলেন। শুনে, বঙ্গবন্ধুও একমত পোষণ করেছিলেন- হ্যাঁ, আমাদের শিশুদের আঁকা মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলো দেখে বিশ্ববাসী বলুক বাংলার মানুষের স্বাধীনতার সংগ্রাম, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য ছিলো কী না।

আমাদের আঁকা ছবিগুলো শিল্পাচার্য নিয়ে গেলেন লন্ডনে। লন্ডনের কমনওয়েলথ ইনস্টিটিউটে ছবিগুলোর প্রদর্শনী হলো ১৯৭২ সালের ২২ জুন থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত। এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেছিলেন বাংলাদেশ সরকারের তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডক্টর কামাল হোসেন। প্রদর্শনী উপলক্ষ্যে শিল্পী হাশেম খানের তত্ত্বাবধানে দু’তিন ভাঁজের দৃষ্টিনন্দন একটা ফোল্ডার ছাপা হয়েছিলো। সেই ফোল্ডারে আমার আঁকা একটা ছবিও স্থান পেয়েছিলো। ছবির ক্যাপশনে খুদে হরফে ছাপা হয়েছিলো আঁকিয়ের নাম- রিটন, বয়স ৯ বছর।

লন্ডনে বাংলাদেশ হাই কমিশনের উদ্যোগে পরবর্তীতে কানাডাসহ আটটি দেশের আটটি শহরে ছবিগুলোর প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। বিপুল দর্শক সমাগম হয়েছিলো সর্বত্র, সবকটি প্রদর্শনীতেই। ওখানকার পত্র-পত্রিকায় ছাপা এ সংক্রান্ত রিপোর্ট এবং বিশেষ প্রতিবেদনের সঙ্গে ছাপা হয়েছিলো বাংলাদেশের শিশুদের আঁকা মুক্তিযুদ্ধের ছবি।

খুব সাড়া পড়ে গিয়েছিলো বিদেশের মাটিতে। শিশুদের আঁকা মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যার ছবিগুলো রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো মিডিয়াসহ নানা পেশার মানুষের হৃদয়ে। বিবিসিসহ অন্য সংবাদমাধ্যমগুলোও যথেষ্ঠ গুরুত্ব দিয়েছিলো অভিনব এই বিষয়টিকে। আমাদের মতো খুদে শিল্পীদের তুলিতে ইতিহাসের নিষ্ঠুরতা প্রত্যক্ষ করে হতভম্ব হয়েছিলেন ভিনদেশিরা। সেটা অবহিত হয়ে ভীষণ খুশি হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।

শিল্পাচার্যের পরিকল্পনা অনুযায়ী রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের নেতৃত্বে যেদিন সন্ধ্যায় আমরা বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়েছিলাম, সেদিন রাতে বাংলাদেশ টেলিভিশনের খবরে আমাদের দেখিয়েছিলো। শাদা কালো টিভিতে বঙ্গবন্ধুর পাশে নিজেকে অবলোকন করে ছোট্ট আমার কী যে আনন্দ, কী যে আনন্দ!

তখন তো আর এখনকার মতো এতোগুলো প্রাইভেট টিভি চ্যানেল ছিলো না। ছিলো শুধু একটাই, সবেধন নীলমণি ‘বাংলাদেশ টেলিভিশন’। কোটি কোটি দর্শক ছিলো বিটিভির। ন্যাশনাল নিউজের কয়েক সেকেন্ডের ফুটেজ রীতিমতো ‘বিখ্যাত’ বানিয়ে দিয়েছিলো আমাকে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কয়েক সেকেন্ডের দৃশ্য আমাকে প্রায় তারকার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলো। স্কুলে, রাস্তায় চেনা-অচেনা মানুষগুলো আমাকে আবিষ্কার করে বিস্মিত হয়- আরে! এই ছেলেটাকেই দেখলাম না টিভিতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে!

গর্বে আমার পা পড়ে না মাটিতে। সেই রাতের টেলিভিশন ছাড়াও পরেরদিন সকালে প্রায় সবকটা দৈনিক পত্রিকার ফ্রন্টপেজে (কোনোটায় শেষের পাতায়) ছাপা হয়েছিলো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একদল শিশুর একটি ছবি। বঙ্গবন্ধুর পাশে তাঁর কাঁধ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছি আমি! দৈনিক বাংলার প্রথম পাতায় ছাপা হওয়া তিন কলাম সাত ইঞ্চি মাপের ছবিটা কেটে রেখে দিয়েছিলাম, অনেক যত্ন করে।

ইত্তেফাক, অবজারভার, টাইমস-এও ছাপা হয়েছিলো ছবিটা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে। কয়েক বছর পর ‘সাপ্তাহিক খবর’ প্রকাশিত সৈয়দ আলী নওয়াব রচিত ‘আমি রাসেল বলছি’ নামের বইতেও সেই ছবিটা মুদ্রিত হতে দেখেছি।

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!