‘মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়’

কলকাতার পার্ক স্ট্রিট থেকে ভূমিষ্ট হওয়ার অল্পকাল পরই মাতৃবিয়োগের অকাল ধাক্কা তার মনোজগতকে অনেক বেশি একাকী, পরিত্যক্ত আর শ্রীহীন করে তুলতে লাগলো। নিজকে যখন আবিষ্কার করলেন পরিত্যক্ত অবস্থায় তখনই মেলে ধরার এক সুতীব্র বাসনা পেয়ে বসলো তাঁকে, এভাবেই তিনি প্রচ্ছন্নতার বলয় থেকে অতি উজ্জ্বল আলোর বলয়ে আসতে লাগলেন।

মো. মহিবুবুল হক ছোটনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 July 2019, 09:33 AM
Updated : 30 July 2019, 09:33 AM

মুন্সিগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজ থেকে শিক্ষক জীবনের গৌরব রথযাত্রা শুরু করে ঢাকা কলেজে এসে দাঁড়ি টানলেন স্বেচ্ছায়। দীর্ঘ ত্রিশ বছরের (১৯৬২-১৯৯২) শিক্ষক জীবনের কোন অংশেই নিজেকে অপ্রাসঙ্গিক লাগুক তা তিনি হতে দেননি। ঢাকা কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট অসন্তোষের মাঝে তিনি তার ভেতরের সৃজনশীলতার শ্রেষ্ঠ আওয়াজ শুনেছিলেন। ছাত্রদের অন্যায় প্রতিবাদের জবাবে তিনি সেইদিন ইস্তফা দিয়েছিলেন।

অধ্যাপক সাঈদ থামলেন না, হাঁটলেন আরো মহত্তর পথে। সেই মহত্তর পথের শেষ প্রান্তেই প্রস্তরশোভিত বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, যেখানে লাখো স্বপ্নের হাতছানি। ‘আলোকিত মানুষ চাই’ এই শিরোনামে চলতে লাগলো নানা পদের, নানা দিকের জ্ঞান ও তথ্যসমৃদ্ধ বইপাঠের মহোৎসব।

অধ্যাপক সাঈদ ২৫ জুলাই ১৯৩৯ সালে এক আলোর পথের এক অভিযাত্রী হয়ে জন্মালেন। বাংলা সাহিত্যের ছাত্র ও শিক্ষক হিসেবে নিজেকে জানান দিলেন তার বহু প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত রচনার মধ্য দিয়ে। তার গ্রন্থভাণ্ডারে আছে কবিতা, প্রবন্ধ, ছোটগল্প, নাটক, অনুবাদ, জার্নাল ও জীবনীমূলক বহু সৃষ্টি।

এ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ২৭। ‘অন্তরঙ্গ আলাপ’, ‘ভাংগো দুর্দশার চক্র’, ‘স্বপ্নের সমান বড়’, ‘আমার বোকা শৈশব’, ‘বহে জলবতী ধারা’, ‘ওড়াউড়ির দিন’, ‘নদী ও চাষীর গল্প’, ‘খর যৌবনের বন্দী’, ‘বিদায় অবন্তী’, ‘রোদন রূপসী’, ‘নিষ্ফলা মাঠের কৃষক’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

‘নিষ্ফলা মাঠের কৃষক’ এই প্রবন্ধগ্রন্থে তিনি গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের শিক্ষার মূল্যবোধের গতিপ্রকৃতি ও নীতিভ্রষ্টতার কথা নিজের জীবন থেকে তুলে এনেছেন অত্যন্ত সত্যনিষ্ঠতা ও সাহসের সাথে। তিনি ছাত্র হিসেবে তাঁর অপ্রাপ্তি আর শিক্ষক হিসেবে দানের অপারগতার অনেক সত্য প্রকাশ করেছেন সাবলীল শব্দের গাঁথুনিতে।

এই বইয়ে তিনি তাঁর শৈশবের প্রিয় শিক্ষাগুরুদের কথা যেমন কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করেছেন ঠিক তেমনি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বহু মেধাবী ও খ্যাতিমান শিক্ষকদের আপোষকামিতার কথাও বলেছেন দায়িত্ব নিয়ে।

তার বক্তৃতামালা জুড়ে থাকে জীবনের বাস্তব উপলব্ধি। তিনি বোঝাতে চান জীবন যাপনের নয়, জীবন উপভোগের। জীবনকে আমি যা দিব জীবন আমাকে তাই ফিরিয়ে দিবে। তিনি তুরস্কের কবি নাজিম হিকমতের কথা প্রায়ই বলেন যিনি প্রায় ১৩ বছর শাসকবর্গের কঠিন রোষে কারাভোগ করেছিলেন। সে সময় লেখার জন্য তাকে একটি পেন্সিল দেয়া হয়েছিল। এক সপ্তাহ না যেতেই সেটি শেষ হয়ে যায়। তিনি ভাবলেন আমি হিকমত মহাকালের কাছে খুবই সামান্য আর পেন্সিলের আয়ু আমার বয়সের সামান্য। এ স্বল্প সময়কে অর্থবহ করাই সার্থকতা।

এ আশি বছরের জীবনে কখনো সাহিত্যকর্মী, কখনো কথাশিল্পী, কখনো সমাজকর্মী আবার কখনো বিপ্লবী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সাঈদ। তাঁর শত গুণের নির্যাস ও ব্যাক্তিত্বের সবটাই প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সংগঠক সত্তায়। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন যে সমৃদ্ধি ও সুষম বাংলাদেশ গড়ে তুলতে আমাদের প্রয়োজন অসংখ্য উচ্চায়ত আলোকিত মানুষ। সেজন্য তিনি বলেন ‘মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়’।

অন্তরে শিক্ষক সত্তাটা তিনি লালন করেন অত্যন্ত গৌরবের সাথে। তিনি মনে করেন তারুণ্যের মাঝে বই বিপ্লব দিয়েই সামগ্রিক বিশ্বের মানবতার আবাদ সম্ভব। আর এজন্যই তিনি এশিয়াতে নোবেল পুরস্কার খ্যাত ম্যাগসাইসে পুরস্কার লাভ করেন। তিনি ধারণ করেন শিক্ষকতা করাই পৃথিবীর মহত্তম ব্রত, কারণ মনীষীরা সবাই শিক্ষক, ঈশ্বর তাঁদের পাঠিয়েছেন মানবজাতির পথপ্রদর্শক রূপে।

বাংলাদেশে টেলিভিশনকে মানুষের কাছে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য করেছিল অধ্যাপক সাঈদের ‘সপ্তবর্ণা’ ও ‘ঈদ আনন্দমেলা’ নামে অনুষ্ঠান দুটো। তার উপস্থাপক জীবন কতটা বিচিত্র ও নান্দনিক তার প্রমাণ এ দুটো অনুষ্ঠানের প্রতিটি ছত্র। সেজন্য পেয়েছেন ‘জাতীয় টেলিভিশন পুরস্কার’ (১৯৭৭)। সাহিত্যের পরিশ্রমী সেবক হিসেবে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও একুশে পদক (২০১৫)।

শতভাবনার শতহৃদয়ে অহর্নিশ শতদল ফুটিয়ে চলছেন আপনি। আপনি বিশ্বাস করেন ‘মৃত্যু তার কাজ করুক আর আমি আমার কাজ করি’। আপনি আরো বলেন ‘মানুষের জীবনের ৪০ বছর হলো পরিণতির সূচনা আর আশি বছর হলো পরিণতির শেষ। এরপর শুধু পুনরাবৃত্তি’’। হতাশায় ক্ষয় হয় আর আশায় লাভ হয়। এটাই সাহসের সাথে বলেন, কারণ আপনি তো সিংহ রাশির জাতক, আল্লামা ইকবালের কবিতায় লয়ে বলতে হয়-

দুর্বার তরঙ্গ এক বলে গেল তীর তীব্র বেগে

আমি আছি যতক্ষণ আমি গতিময়

যখনই হারাই গতি

আমি আর নাই।

অযুত প্রদীপের উৎস শলাকা হয়ে আরও কিছুদিন সৃষ্টিতে, স্বস্তিতে সার্থকতার কাটুক আপনার অর্থপূর্ণ জীবন। আপনার প্রাণবায়ুর আশি বছর পূর্তিতে একজন ভাবশিষ্যের এটাই চাওয়া।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ভান্ডারিয়া সরকারি কলেজ, পিরোজপুর

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com । সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!