একটি মৌমাছির আত্মকাহিনী

আমার নাম ইতলি। আমি একটি মৌচাকের প্রধান। সবাই যাকে রাণী মৌমাছি বলে জানে।

সাদিক আল আমিনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Feb 2019, 05:44 AM
Updated : 28 Feb 2019, 05:44 AM

আমার জীবনের দুঃখ-কষ্ট সবই আমার কর্মী মৌমাছিদের নিয়ে। ওদের সঙ্গে সারাদিন মেতে থেকে, আহার সেরে রাতে নাচ-গানের আয়োজনের মাধ্যমে কিংবা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আমার দিনকাল ভালোই চলে। ওরা অন্য মৌচাকের কর্মীদের সামনে আমার নামে অনেক প্রশংসা করে। আমার মতো এমন লক্ষ্মী দায়িত্ববান রাণী নাকি ওরা দ্বিতীয়টি পায়নি।

আমারও এ নিয়ে অনেক গর্ব হয়। কিসমত সাহেবের বড় বাগানটাতে যতগুলো গাছে মৌচাক আছে, তার মধ্যে আমাদের মৌচাকটাই সবচেয়ে বড় এবং সেরা। কর্মীরা ওদের বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে আমাকে প্রধান অতিথির মর্যাদা দেয়। রাণী হওয়ার সুবাদে অনেক জায়গায় দাওয়াতও পাই। এইতো গেলো সপ্তাহে কুক্কুরীর বিয়ে হলো বতুলের সঙ্গে। কন্যা সম্প্রদানের সময় কুক্কুরীর বাবা কি যে একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেললো আমি না গেলে হয়তো তার সমাধানই হতোনা।

বতুলের বাবার সঙ্গে কুক্কুরীর বাবা ঝগড়া লাগিয়ে দিয়েছে। কারণ হলো বতুলের বাবা আধ মৌচাক মধু যৌতুক চেয়েছে। এতোগুলো মধু দেওয়া কি আর মুখের কথা! একটা মৌচাক বানাতে আমাদের অনেকদিন লেগে যায়। তাও আবার আমরা একা বানাই না, অনেকগুলো মৌমাছির সমন্বয়ে একটা মৌচাক হয়। সেটা যে কতো কষ্টের ফল তা বতুলের বাবা ভালোভাবেই জানে। তবুও কেন এতো বড় চাহিদা জিজ্ঞেস করায় বতুলের বাবা বলে আমরা নাকি বাগানের সেরা মৌমাছি ওদের সবার তুলনায়। সবার চাইতে আমাদের মৌচাক তাড়াতাড়ি তৈরি হয়।

আধ মৌচাক যৌতুক দেয়া যে আমাদের জন্য কোনো ব্যাপারই না তা ভালোভাবে আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেয় বতুলের বাবা। আমি আর উপায়ান্তর না দেখে ঘোষণা দিলাম যে সবাই কুক্কুরীর বাবাকে যথাসাধ্য মধু দিয়ে সাহায্য করবে। সবাই সম্মতিও জানালো। কারণ কুক্কুরীর বাবার একার পক্ষে এতোগুলো মধু দেওয়া যে সম্ভব নয় সেটা সবাই জানে। শেষমেশ অনেক কষ্টে বিষয়টা সমাধান করলাম। কুক্কুরী কাঁদতে কাঁদতে আমাদের রাজ্য থেকে বিদায় নিলো। বতুল ওকে পিঠে চাপিয়ে উড়তে উড়তে ওদের মৌচাকরাজ্যে নিয়ে গেলো।

এরকম বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব আমাকে পালন করতে হয়। আমার সহকর্মীরাও আমাকে সব কাজে সহযোগিতা করে। কিন্তু এতো সুখের মাঝেও আমাদের জীবন আসলে অনেক দুঃখময়৷ এর অনেক কারণ আছে। যেমন, মধু সংগ্রহে ফুলের কাছে গেলে প্রজাপতি আমাদের তাড়া করে। আবার কিছু কিছু পতঙ্গভুক ফুল আছে যেগুলোতে মধু সংগ্রহে গেলে ওরা বিষাক্ত আঠা দিয়ে আমাদের মেরে ফেলতে চেষ্টা করে। কিছু কিছু ফুল আছে আমরা তাদের ওপর গিয়ে বসতেই ওরা ঢাকনা ঢেকে আমাদের বন্দি করে ফেলে।

এভাবে আমার মৌচাকের অনেক কর্মী মৌমাছি প্রাণ হারিয়েছে। আবার আমরা কোনো বাগানেই বেশিদিন টিকতে পারিনা। আমাদের কষ্ট করে জমানো মধু মানুষ কেড়ে নেয়। অন্যান্য মৌচাকের তুলনায় আমাদেরটা একটু বেশি বড় দেখে সবার নজর এখানেই পড়ে। মুখে গামছা পেঁচিয়ে ধোঁয়া দিয়ে বদমাশ মানুষগুলো আমাদের তাড়িয়ে সব মধুর চাক কেটে নিয়ে যায়। আমরা ধোঁয়াতে কিছু দেখতেও পাইনা, তাই কিছু করারও থাকেনা। দেখতে পেলে যে মানুষগুলোর বারোটা বাজিয়ে দিতাম সবাই মিলে হুল ফুটিয়ে, তাতে কোনো সন্দেহ ছিলো না।

অনেকদিন আগে একবার এক ঘটনা ঘটে। আমরা তখন এই বাগানে থাকতাম না। এখান থেকে পূর্ব দিকে পাঁচ ঘণ্টা উড়ে গেলে একটা বাগান পড়ে; সেই বাগানে থাকতাম। বাগানটা ছিলো মাঝারি সাইজের। আশপাশে কোনো বাগানও না থাকায় ওটাই ছিলো তখন আমাদের একমাত্র ভরসা। একদিন গুণ্ডার মতো দেখতে দশ-বারোটা লোক এসে আমাদের চিরতরে ধ্বংস করার পদক্ষেপ নিলো। আমরা তখন সবাই দুপুরের খাবার খেয়ে ঘুমিয়েছি।

তখন রাণী ছিলো আমার মা। কেউ বুঝতেও পারিনি কী হতে যাচ্ছে। হঠাৎ করে গাছ কাটার আওয়াজ পেলাম। লোকগুলো সবাই গণহারে গাছ কাটছে। গাছ কাটলে আমাদের যতটা দুঃখ হয় তত দুঃখ মৌচাক কাটলেও হয়না। মৌচাক কাটলেও আমরা আবার একটা নতুন মৌচাক বানাতে পারি, কিন্তু গাছ কাটলে আমাদের মৌচাক বানানোর জায়গাই থাকেনা। আর আশপাশে গাছ না থাকলে নিঃশ্বাস নিতেও খুব কষ্ট হয় আমাদের। শুধু গাছ কেটে ক্ষান্ত হলেও একটা কথা ছিলো। কিন্তু মানুষগুলো সেদিন যা করেছিলো তা ভাবলে এখনো আমার গা শিউরে ওঠে।

আমাদের মৌচাকের ডালটা কাটার আগে মধুগুলো সংগ্রহ করে নেবে এমন পরিকল্পনা নিয়ে ওরা আমাদের ওপর অ্যারোসল স্প্রে করতে লাগলো। সামান্য আগুনের ধোঁয়া হলেও আমরা সহ্য করতে পারতাম। কিন্তু কীটনাশক অ্যারোসলে খুব কম মৌমাছিই বাঁচতে পারলো সেদিন। মা অবস্থা বুঝতে পেরে আগেভাগেই আমাকে বাঁচানোর নির্দেশ দিল বাকি মৌমাছিদের। আমি মাকে ছেড়ে যেতে না চাইলেও ওরা জোর করে আমাকে অন্য একটা গাছে রেখে এলো। আর বাকি কর্মীদের বাঁচাতে মা কতো সংগ্রাম করে শেষমেশ নিজের জীবনটাকেও উৎসর্গ করে দিলো তার বর্ণনা সেদিন যারা পালিয়ে বাঁচতে পেরেছে তাদের কাছে শুনেছি।

এই ঘটনার পর থেকে স্বভাবতই মানুষের ওপর আমার প্রচণ্ড ক্ষোভ থাকার কথা। কিন্তু আমরা সবাই একইরকম দেখতে-শুনতে হলেও সব মানুষেরা এক না। মানুষের মধ্যে কেউ কেউ ভালো আবার কেউ কেউ খারাপ আছে। খারাপ মানুষগুলোর ওপর রাগ হলেও যখনি নিষ্পাপ ছোট ছোট বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোকে বাগানে খেলতে দেখি তখনি আমার সব রাগ-অভিমান উধাও হয়ে যায়। আমাদের মৌচাকে বল লাগতে পারে ভেবে ওরা কিছুদিন হলো বাগানে আর খেলতে আসেনা। বাড়ির উঠোনেই খেলে। কি জানি! হুল ফুটিয়ে দেবো ভেবেই হয়তো ভয়ে আর খেলতে আসেনা। কিন্তু ওরা খেলতে আসলেই যেন মনে একটা প্রশান্তি আসে আমার। ওদের মাঝেই যেন আমার মমতাময়ী মায়ের চেহারাটা দেখতে পাই।

এভাবেই সুন্দর চলছিলো দিনকাল। বাকি মৌমাছিদের মুখে আমি যে একদম আমার মায়ের মতো যোগ্য রাণী হতে পেরেছি শুনে খুব আনন্দ পাই। আরো তিন-চারটা মৌচাকের নেতৃত্ব আমি সফলতার সাথে দিতে পারতাম; কিন্তু আমার ফুসফুসে সেদিনের ঘটনার পর একটু বিষ চলে যাওয়ায় ইদানীং খুব অসুস্থ আমি। ডাক্তার মৌমাছি এসে দেখে গেছে আমাকে গতকাল। বলেছে সম্পূর্ণ বিশ্রাম নিতে। কোনোরকম চলাফেরা না করতে। নির্দেশনা দিতে হলে শুয়ে থেকেই দিতে হবে।

বাকি মৌমাছিদের বলে দিয়েছে আমার সঠিক পরিচর্যা করতে। কিন্তু আমি যে অনেক ঋণী ওদের কাছে! ওরাই আমাকে রাণী বানিয়েছে, ছোট থেকে আদর-যত্ন করে বড় করে তুলেছে। ওদের প্রতিই তো আমার সব দায়িত্ব-কর্তব্য। ছোট বাচ্চাগুলোর প্রতিও আমাদের মৌমাছি সম্প্রদায়ের যত দায়িত্ব। এতো দুঃখ-কষ্ট-পরিশ্রম-সংগ্রামের পরও ওরা যখন নরম হাতের তালুতে চেটে চেটে আমাদের কষ্টের সংগ্রহ করা মধু খায় আর মৌচাকের দিকে তাকিয়ে আত্মতৃপ্তির সঙ্গে মৌমাছি ভাইবোনদের ধন্যবাদ জানায়, তখন মনটা আনন্দে ভরে যায়। কোনো কষ্টই তখন আর কষ্ট থাকেনা।

লেখক: শিক্ষার্থী, প্রথম বর্ষ, কৃষি অনুষদ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!