ষড়ঋতুর গল্প

বর্ষার বিরুদ্ধে শরৎ মামলা করেছে। মামলা সে এমনি এমনি করেনি, বর্ষাঋতুর অসম্ভব বাড়াবাড়িতে শরতঋতু রীতিমত ত্যক্ত-বিরক্ত। বহু চিন্তা-ভাবনার পর অন্য ঋতুদের সঙ্গে শলা-পরামর্শ করে শরৎ তার ন্যায্য অধিকার পেতে ঋতুরাজ বসন্তের দরবারে মামলা ঠুকে দিয়েছে।

>>বিএম বরকতউল্লাহ্বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 August 2018, 11:34 AM
Updated : 28 August 2018, 11:35 AM

মহামান্য ঋতুরাজ বসন্তের আদালত। একে একে সব ঋতু আদালতে হাজির হয়েছে। ঋতুরাজকে বিনম্রচিত্তে কুর্ণিশ করলো অন্য ঋতুরা। ঋতুরাজ বসন্ত বিচারকের আসনে বসে ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে ডানে-বামে তাকালেন। অভিযুক্ত বর্ষাঋতু আসামীর কাঠগড়ায় করজোড়ে দাঁড়িয়ে আছে আর অন্য পাশে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত ও শীতঋতু।

শরতঋতু মামলা ঠুকলেও অন্য ঋতুরা তার পক্ষ নিয়ে আদালতে উপস্থিত হয়েছে। কারণ এরাও বর্ষাঋতুর যন্ত্রণায় অস্থির। মহামান্য ঋতুরাজ বসন্ত গুরুগম্ভীর কণ্ঠে শরতের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বর্ষার বিরুদ্ধে তোমার কী কী অভিযোগ আছে, বলো’। শরৎ বললো, ‘মহামান্য রাজা, বর্ষার বিরুদ্ধে আমাদের অনেক অভিযোগ আছে। বর্ষাঋতুর পরই প্রকৃতিতে আমার আগমন ঘটে। আষাঢ়-শ্রাবণ এই দুই মাস বর্ষাকাল। শ্রাবণ মাসের শেষ দিনে সে ছুটি নিয়ে চলে যাবে। ভাদ্র মাসের প্রথম দিন থেকেই আমার আগমন ঘটবে। প্রকৃতির এই তো নিয়ম। কিন্তু বর্ষাঋতু তার সময় শেষ হওয়ার পরও যেতে চায় না। অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার পা ব্যথা হয়ে যায়। কিন্তু তার জন্য আমি সময় মতো প্রকৃতিতে হাজির হতে পারি না। অনেক কাকুতি-মিনতি করে বলেছি তাকে। কোনো লাভ হয়নি’।

বর্ষাঋতু মেজাজ গরম করে বলে, ‘আসা যাওয়া আমার ইচ্ছা। প্রকৃতিতে আমার প্রয়োজন বেশি। আমার সঙ্গে বাড়াবাড়ি করলে কয়েক মুহূর্তের ঢলে তোমার বসন্তভাবনার সমস্ত শখ চুলোয় দিতে হবে আর তোমার পুরো শরতকালটাই হাঁসের মতো তইতই করে কাটাতে হবে। বুঝেছ শরতবাবু?’ শরৎ অভিযোগ করে বললো, ‘জবাব দিতে গেলেই বর্ষা আমাকে ময়লা পানিতে চুবিয়ে ধরার হুমকি দেয়। আমি এই ভয়ংকর বর্ষাঋতুর অন্যায় আচরণের দৃষ্টান্তমূলক বিচার প্রার্থনা করছি, মহারাজ।

রাজা: বর্ষার জন্য তোমার আর কী কী সমস্যা হয় তা একে একে আদালতে পেশ করা হোক।

শরৎ: মহামান্য রাজা, গোস্তাগি মাফ করবেন। বর্ষাঋতুর বিরুদ্ধে আমার এতই অভিযোগ যে কোনটা রেখে কোনটা বলি তা ভেবে পাচ্ছি না। এই দেখেন, বর্ষাঋতু আমার দিকে চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে। ঠকঠক করে আমার পা আর বুক কাঁপছে মহারাজ। কথাবার্তা এলোমেলো হয়ে গেলে আমাকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন, হুজুর।

রাজা: অতি সরলভাবে ভয়হীন চিত্তে তোমার কথা বলে যাও।

শরৎ: বর্ষার সময় পেরুবার পরপরই শরতের আগমন অপেক্ষায় থাকে মানুষ, প্রকৃতি আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে প্রচণ্ড আগ্রহে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি ফুলের গন্ধ নিয়ে, স্বস্তি ও শান্তির পরশ নিয়ে মানুষ ও প্রকৃতির বুকে ফিরে আসি। অতি আনন্দে সবাই আমাকে বরণ করে নেয়। আমি আমার আপন নিয়মে, আপন বৈশিষ্ট্যে প্রকৃতিকে অপরূপ সাজে সজ্জিত করি। আমার আগমনে প্রকৃতি আনন্দে ডানা ঝাঁপটায়। আর বর্ষার অযাচিত বর্ষণে মুহূর্তে সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। অথচ আমার সময় মোটে দুই মাস।

পাশে দাঁড়ানো অন্য ঋতুগুলো শরতঋতুর বক্তব্যকে সমর্থন দিয়ে বলল, ‘বর্ষাঋতুর এই ধাক্কা আমাদের সবার গায়েই লাগে। প্রকৃতি আমাদের অমূল্য সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিলম্বে আসি বলে প্রকৃতিকে সন্তুষ্ট করতে পারছি না। দিনে দিনে প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের দূরত্ব বাড়ছে, সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে এবং বদনাম হচ্ছে। প্রকৃতির নানা অভিযোগের ভারে আমরা দিশেহারা হয়ে পড়েছি মহারাজ’।

শরতঋতু রাগে-অভিমানে বলতে লাগল, ‘মহামান্য রাজা এক বর্ষাঋতুর কাছে আমরা সবাই জিম্মি হয়ে পড়েছি। প্রতি বছর বর্ষাঋতুকে খালি ছাড় দিয়েই যাবো? আর গোঁয়ার বর্ষা যখন তখন ঝপাঝপ বৃষ্টি নামিয়ে আমাদের অবস্থানকে একদম নড়বড়ে করে দেবে, এ কেমন আচরণ? প্রকৃতি নিষ্ঠুরভাবে আমাকে দোষারোপ করে। আমাদের স্বভাবটাই নাকি খারাপ হয়ে গেছে। প্রকৃতি বর্ষা আর শরতের মধ্যে কোনো তফাৎ খুঁজে পায় না। বর্ষার কারণে প্রকৃতির বুকে এভাবে নাস্তানাবুদ হওয়ার হাত হতে আমাদের রক্ষা করুন মহামান্য আদালত!’

রাজা: (বর্ষা ঋতুর দিকে তাকিয়ে) কিহে বর্ষাঋতু, তোমার বিরুদ্ধে তো মেলা অভিযোগ যা তোমার সামনেই বর্ণনা করে গেলো, এ ব্যাপারে তোমার কি কিছু বলার আছে?

বর্ষাঋতু: আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের অধিকাংশই সত্য। আমিও নিরুপায় হয়ে প্রকৃতির আহ্বানে সাড়া দিতে গিয়ে সময় ঠিক রাখতে পারি না মহারাজ। এ রকমটি মাঝে মধ্যে ঘটে। আমি চলে যাওয়ার পর আসে শরৎকাল। সে এসে কাশফুল থেকে শুরু করে নানা জাতের ফুল-ফল আর রূপ দিয়ে প্রকৃতি সাজায়। বর্ষার পর হঠাৎ করেই শরতের তেজোদীপ্ত রোদের তাপে প্রকৃতি দিশেহারা হয়ে যায়। ভ্যাপসা গরমে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থায় আমাকে স্মরণ করে প্রকৃতি আর মানুষ। তখন আমি মেঘের কোলে হেসে-খেলে আকাশে উড়ে বেড়াই। নিচে তাকিয়ে দেখি গরমে অতিষ্ঠ হয়ে ফুলের নরম পাপড়িগুলো, গাছের কচি পাতাগুলো, কৃষকের ক্লান্ত হাতগুলো আর সোনালি ফসলের বিবর্ণ মাঠ আমাকে ডাকছে। শক্ত মেঘের ওপর ভর দিয়ে ভেসে ভেসে তাদের অসহায় আকুতি-মিনতি শুনে আর সহ্য করতে পারি না। তখন আমি প্রকৃতির মায়ায় প্রকৃতির বুকে ছুটে আসি। আমার পরশে আনন্দে নেচে উঠে প্রকৃতি। তার মায়ার জালে পড়ে ফিরে যেতে কয়েকটা দিন দেরি হয়ে যায়। প্রকৃতির মায়ায় সাড়া দিয়ে এই উপকার করে আমি কি অপরাধ করেছি মহারাজ!’

বর্ষাঋতু বলতে থাকে, ‘আমার ঝড়, বৃষ্টি আর বন্যায় প্রকৃতি যেমন কষ্ট পায় আবার আমার পরশে প্রকৃতি প্রাণও ফিরে পায়। আমি প্রকৃতিকে বৃষ্টির পরশে কোমল করে দিই। তৃষ্ণার্ত প্রকৃতির পিপাসা মেটাই। এগুলো কি আমার অপরাধ? রৌদ্র-তাপে প্রকৃতি যখন ফেটে চৌচির হয়ে যায়, তখন? আমি ছাড়া প্রকৃতিকে বাঁচায় সাধ্যি কার? আমিই প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা করে রাখি, এগুলো কি আমার অপরাধ? আপনি আমাদের রাজা। আপনার দণ্ড আমি মাথা পেতে নিতে প্রস্তুত আছি মহারাজ।’

রাজা বললেন, ‘যুক্তিতে তো কেউ আর কম যাও না। তবে শোনো, প্রকৃতির জন্য সব ঋতুরই প্রয়োজন আছে। ঋতু বৈচিত্র্যের দেশ এই বাংলাদেশ। ছয় ঋতুর দেশ হিসেবে পৃথিবীর বুকে আমাদের সুনাম-সুখ্যাতি আছে। এত ঋতুবৈচিত্র্য আর কোথাও নেই। আমাদের অবহেলা আর খামখেয়ালিপনার কারণে এই সোনার বাংলার ঋতু বৈচিত্র্যতা নষ্ট করা যাবে না- এই কথাটি মনে রাখতে হবে তোমাদের। উভয়পক্ষের অভিযোগ, যুক্তি-তর্ক শুনলাম। বর্ষাঋতুর অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি আর নির্ধারিত সময়ের পরও প্রকৃতিতে অবস্থান করা ঠিক নয় বিধায়, বর্ষাঋতুকে সতর্ক করে দেওয়া হলো। তাকে আরো সংযত হওয়ার এবং অন্য ঋতুর সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক সৃষ্টির পরামর্শ দেওয়া হলো।

সেই সঙ্গে বাদী পক্ষকেও বাস্তব অবস্থা অনুধাবনসহ আরো সহনশীল হওয়ার জন্য উপদেশ দেওয়া হলো।

রাজা এই রায় ঘোষণা করে সিংহাসন থেকে উঠে দাঁড়ালেন। আর বাদী-বিবাদী ‘মহামান্য রাজা দীর্ঘজীবী হোক’ শ্লোগানে মুখরিত করে যে যার কাজে চলে গেলো।

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!