ঢাকার গল্প

আজ পথে নাকি অনেক জ্যাম। মা বলল, টুনু জ্যামের মধ্যে আজ স্কুলে গিয়ে কাজ নেই। এটা শুনে টুনুর খুশি আর ধরে না। সে ঠিক করল সকালবেলাটা দাদাই বাড়িতে কাটাবে। হালকা শীতের সকালে দাদাইর বাটিটা খুব শুনশান লাগছে। নীচের দাদুর পড়ার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখল, দাদু ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে চোখ বন্ধ করে আছেন, হাতে কী একটা বই।

শারমিন রেজওয়ানাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Oct 2016, 07:58 AM
Updated : 23 Oct 2016, 07:59 AM

টুনু ভাবল, আচ্ছা বাসায় ফিরে যাই। এই ভেবে যেই না পা টিপে টিপে নামতে গিয়েছি ওমনি দাদু বলে উঠলেন- ‘এই টুনু যাচ্ছিস কোথায়? এদিকে এসে একটা বই খুঁজে দিয়ে যা তো!’

ঘরে ঢুকে টুনু বেশ ঝাঁঝের সাথে বলল, দাদাই তোমার এত বইয়ের মধ্যে কোন বই খুঁজে বের করব? ঝটপট বল, আমার হাতে সময় নেই।

তোর বড় ভাগ্য টুনু আমি এখন আর সেভাবে নড়াচড়া করতে পারি না, হাঁটতে পারলে তোর কপালে আজ দুঃখই ছিল। দেখ পশ্চিমের দেয়ালে, একদম উপরে তাকে থাকার কথা, বইয়ের নাম টপোগ্রাফি অব ঢাক্কা, লেখকের নাম জেমস টেলর। মই টান দিয়ে নে, সাবধানে, আবার হাত পা ভাঙ্গিস না।

বই নামিয়ে টুনু বিশাল বিরক্তি নিয়ে বলল, দাদাই তোমার বাসাটা একটা ভুয়াপুর, এত আগোছালো করে রাখো!

- আমার বাড়ি ভুয়াপুর হবে কেন? সে তো টাঙ্গাইলের একটা উপজেলা।

- ইস বলে দিলে আর-কি, ভুয়াপুর কোনো জায়গার নাম হয় নাকি?

- জায়গাটার নাম আসলে ভূঞাপুর। লোকে ঠিকঠাক উচ্চারণ করতে না পেরে নামই বদলে ফেলেছিল।  তারপর শফি উদ্দিন আহমেদ নামের একজন ইতিহাসবিদ গবেষণা করে বের করলেন আসলে শব্দটি হবে “ভূঞা”,  বারো ভূঞাদের স্মৃতি বিজড়িত জায়গা বলে নাম হয়েছে ‘ভূঞাপুর”! সব জায়গারই নামকরণের সময় এমন অনেক দল-বদল হয়ে থাকে।

দাদাইর কথায় টুনুর একটু আগ্রহ জাগল, সে সন্দেহভরে বলল, তাহলে ঢাকা কি 'ঢাক' থেকে এসেছিল?

দাদু চশমার উপর দিয়ে টুনুর দিকে তাকিয়ে বলেন, আরে টুনু বাবু, তোমাকে তো ম্যালা বুদ্ধি।

দাদাইর কাছে প্রশংসা শুনে টুনু একটু জমিয়ে বসলো, দাদাইর হাত ধরে ঝাঁকিয়ে বলল, আরে বলই না ঢাকার নাম কি ঢাক থেকেই এসেছে।

গল্প বলার সুযোগ ছাড়ার লোক দাদাই না। তিনিও বেশ আয়েশ করে শুরু করলেন, টুনু বাবু পলাশ ফুল চেনো নাকি?

- কোন ফুলটা বলোতো, বড় গাছে থাকে গরমকালে ফোটে আর আগুনের শিখার মতো দেখতে যে শক্ত শক্ত ফুলটা, সেটা?

- আরে তুই দেখি একেবারে সব বলে দিলি। হ্যাঁ, সেই ফুলটাই। আমাকে যে বইটা নামিয়ে দিলি, তার নাম “টপোগ্রাফি অব ঢাক্কা”, লিখেছেন জেমস টেলর। ১৮৪০ সালে প্রকাশিত এই বইয়ে তিনি বলেছেন, সে সময়ে নাকি এই অঞ্চলে প্রচুর পলাশ বা ঢাক বৃক্ষের অস্তিত্ব ছিল। এই “ঢাক” নামের গাছের থেকেই এসেছে “ঢাকা” নামটি। এর সঙ্গে একটি উপাখ্যানও উল্লেখ করে গিয়েছেন, “প্রাচীনকালে বিক্রমপুরে আদিশুর নামের একজন রাজা ছিলেন। কোনো এক কারণে রাজা আদিশুর তাঁর সন্তানসম্ভবা রাণীকে প্রাসাদ থেকে বনবাসে পাঠান। পরে, বুড়িগঙ্গার তীর থেকে দুর্গাদেবী তাকে উদ্ধার করে আশ্রয় দেন। তখন বুড়িগঙ্গার আশেপাশে তো এখনকার মতো এমন দালানকোঠা ছিল না, ছিল গাছপালা ঘেরা জঙ্গল। সেই জঙ্গলেই রানীর ছেলে জন্মালো, নাম তার বল্লাল সেন। বল্লাল সেন এই জঙ্গলেই দুর্গা দেবীর আশ্রয়ে বড় হতে থাকেন। কোনো এক সময়ে তিনি সেই জঙ্গলে গাছপালা ঢাকা অবস্থায় দুর্গাদেবীর একটি মূর্তি পেয়েছিলেন। পরে তিনি এখানে একটি মন্দির তৈরি করে তাতে সেই দেবীর মূর্তিটি স্থাপন করেন। যেহেতু গাছপালায় “ঢেকে যাওয়া দেবী” মূর্তি এই মন্দিরে রাখা হয়েছিল তাই মন্দিরটির নাম হয়ে গিয়েছিল "ঢাকা ঈশ্বরী", সেখান থেকে ঢাকেশ্বরী। পরবর্তীতে বনজঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে সেই জায়গায় নগর প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে এবং সেই নতুন নগরের নাম হয় “ঢাক্কা বা ঢাকা”!

- আরে বাবা এ তো দেখি বিশাল ব্যাপার।

- ওরে টুনু বিশালের আর দেখলি কী? গল্প কি আর একটা আছে? ঢাকার বয়স ৪০০ বছরেও অনেক বেশি, এত বছরে গল্পের কোনো অভাব নেই। যেমন ধর ইসলাম খাঁকে নিয়েও গল্প আছে একটা।

- ইসলাম খাঁ মানে কি সেই মুঘল সুবাদার?

- আরে হ্যাঁ!  মুঘল সম্রাট আকবরের নাম তো জানিস। তিনি কিন্তু আমাদের এই বাংলাদেশকে কখনও পুরোপুরি জয় করতে পারেননি। বাংলাদেশের স্বাধীন রাজা বারোভূঁইয়াদের সাথে তাই মুঘলদের যুদ্ধ লেগেই থাকতো। সম্রাট আকবর তাঁর অনেক জাহাঁবাজ সেনাপতিদের পাঠিয়েছিলেন বারো ভূঁইয়াদের দমন করতে, কিন্তু তারা সবাই ব্যর্থ হন। এরপর সম্রাট আকবরের মৃত্যুর পরে রাজা হলেন তাঁর পুত্র সম্রাট জাহাঙ্গীর। নতুন সম্রাটও বারো ভূঁইয়াদের কথা ভুললেন না, তিনি বাংলার সুবাদার হিসেবে পাঠালেন ইসলাম খাঁকে। সেই সময়ে আবার এই অঞ্চলে মগ ও পর্তুগীজ জলদস্যুরা খুব বেয়াড়া হয়ে উঠেছিল।তো এদের দমন করার জন্য ইসলাম  বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে ঘাটি গাড়লেন রাজমহলে,সেখান থেকেই যুদ্ধ করতে লাগলেন বারোভূঁইয়াদের অন্যতম মুসা খানের সাথে।একের পর এক যুদ্ধে মুসা খান পরাজিত হতে থাকেন, তাঁর দুর্গ গুলো দখল হয়ে যেতে থাকে।শেষ পর্যন্ত বাংলার সবচেয়ে শক্তিশালী ও সুরক্ষিত ঢাকা দুর্গও ইসলাম খাঁ দখল করে ফেলেন।

-দাদা ভাই যুদ্ধের কথা শুনতে আমার একটুও ভাল লাগে না। কত কত মানুষ মারা যায় যুদ্ধে!

-আচ্ছা, যুদ্ধ এখনেই শেষ, এবার শোনে কিভাবে ইসলাম খাঁ ‘ঢাকা’র নামের সাথে কিভাবে জড়ালেন! যুদ্ধে তো তিনি জিতলেন কিন্তু বারো ভূঁইয়ারা তো আর সবাই পরাজিত হননি, ওদিকে আবার যখন তখন মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুরা আক্রমণ করে এই অঞ্চলে। কীভাবে এদের ঠেকানো যায় তা নিয়ে সবাই চিন্তিত। অবশেষে সবাই মিলে  সিদ্ধান্ত নিলেন যে, রাজধানীটা মুর্শিদাবাদ থেকে সরিয়ে নিয়ে এসে যদি এই অঞ্চলে করা হয় তবে এদের উপর নজর রাখা খুব সুবিধা হয়।

তখন ইসলাম খাঁ রাজধানীর জন্য জায়গা খুঁজে বের করতে নৌবহর নিয়ে ঘুরতে বের হলেন। চলতে চলতে এক সময়ে এসে উপস্থিত হলেন বুড়িগঙ্গার তীরে। জায়গাটা তাঁর খুব পছন্দ হয়ে গেল, তিনি নৌকা ভিড়াতে বললেন। তীরে নেমে দেখেন একদল লোক কী একটা পূজার জন্য ঢাকঢোল বাজাচ্ছে। এদিকে ইসলাম খাঁ কিন্তু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছেন যে এখানেই হবে মুঘল সুবার নতুন রাজধানী। তিনি ঐ ঢাকিদের বললেন আরও জোড়ে ঢাক বাজাতে আর নিজের চারজন অনুচরকে পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ দিকে পাঠিয়ে দিলেন কত দূর থেকে এই শব্দ শোনা যায় তা দেখতে। কারণ তিনি নাকি ঠিক করেছিলেন যতদূর পর্যন্ত এই ঢাকের শব্দ যাবে তত-দূরই হবে নতুন রাজধানীর সীমানা!

- আমি বলছিলাম না যে ‘ঢাক’ থেকেই ঢাকা নামটা এসেছে!

- তোর আন্দাজ তো কিছুটা মিলেছে। কিন্তু ইতিহাস নিয়ে যারা চর্চা করেন তারা কিন্তু ইসলাম খাঁর এই গল্প মানতে নারাজ। কারণ ইসলাম খাঁ নিজেই তো ১৬০৮ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীরের নামানুসারে নতুন রাজধানীর নাম রেখেছিলেন “জাহাঙ্গীর নগর”!

-ওহ! তবে কী এটা গল্প?

-হতে পারে! আরও একটা কাহিনী আছে, শুনবি?

- হ্যাঁ, সবগুলো শুনতে চাই।

-আবার কোনো কোনো ইতিহাসবিদ বলেন, ঢাকা নামটি এসেছে ‘ডাক্কা’ থেকে।

- ‘ডাক্কা’, এটা আবার কেমন শব্দ, এর অর্থ কী দাদাই?

- “ডাক্কা” একটা সংস্কৃত শব্দ, এর অর্থ হলো ‘পর্যবেক্ষণ মঞ্চ’। খ্রীঃ ১২ শতকে ক্লহন নামের একজন ব্রাহ্মণ ‘রাজ তরঙ্গিনী’ নামের একটি বই লিখেছিলেন যেখান পর্যবেক্ষণ মঞ্চ হিসেবে ‘ডাক্কা’র উল্লেখ আছে। এই থেকে দীনেশ চন্দ্র সরকার নামের

আমাদের দেশের একজন বিখ্যাত ইতিহাসবিদ বলেছেন যে, ঢাকার এই অঞ্চলটি অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গায় অবস্থিত হবার কারণে পার্শ্ববর্তী গুরুত্বপূর্ণ নগর বিক্রমপুর এবং সোনার গাঁওয়ের উপর নজর রাখতে এখানে একটি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল, আর এই কারণে এর নাম হয়ে যায় ‘ডাক্কা’, যা পরবর্তীকালে মানুষের মুখে মুখে ঢাকায় পরিণত হয়!

-ওরে বাবা! কত মতভেদ!

টুনু একদম আগ্রহে পপপকর্ণের মতো ফুটছে, এরমধ্যে হঠাৎ দাদাইয়ের কী হল কে জানে! বড় হাই টেনে বললেন, ওরে টুনু তুই এখনও বসে বসে কী করিস? যা খেলতে যা, আমি একটু ঘুম দেই। তোদের জ্বালায় ঘুমাতেও পারি না। দরজাটা ভিজিয়ে যাস।

টুনু দাদাইকে বুঝে কিছুতেই। বুড়োটাকে মাঝে মাঝে এত ভালো লাগে, আবার কখনও খুব রাগ হয়। হাজার হোক দাদাই তো তাই ছেড়েও যাওয়া যায় না। এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে টুনু অবন্তীদের বাড়িতে বেল দেয়। অবন্তী যদি বাড়ি থাকে তবে বেশ করে ঢাকার গল্প শোনানো যাবে।

ছবি কৃতজ্ঞতা: ভিক্টোরিয়া এন্ড এলবার্ট মিউজিয়াম। শিল্পীর নাম ফ্রেডরিক উইলিয়াম আলেক্সান্ডার ডি ফেবেক